স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন (এলইডি) মডেল এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আম খাতের ভূমিকা শীর্ষক আঞ্চলিক প্রচার অভিযানের আয়োজন করেছে শিবগঞ্জ পৌরসভা। মঙ্গলবার দিনব্যাপী উপজেলা পরিষদ চত্বরে এ প্রচারণা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে উদ্ভাবনী কৃষি পদ্ধতি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। আয়োজনে সহযোগিতা করেছে স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন (প্রবৃদ্ধি) প্রকল্প যা অর্থায়ন করেছে সুইজারল্যান্ড ও বাংলাদেশ সরকার, বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সুইসকন্ট্যাক্ট।

আম ব্যবসাকেন্দ্রিক নয়টি পৌরসভা এ আয়োজনে অংশ নেয়। তারা শিবগঞ্জের আম খাতকে এগিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন সেরা অনুশীলন (বেস্ট প্র্যাকটিস) সম্পর্কে জেনেছে এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর ভূমিকা অনুধাবন করেছে। পাশাপাশি, পৌরসভাগুলোর সেবার মান উন্নত করার গুরুত্ব ও করণীয় সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছে।

প্রচারণা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিবগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক আজাহার আলী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ সাহা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সামাদ, সুইসকন্ট্যাক্ট বাংলাদেশের হেড অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আলমগীর কবির, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব ও গবেষণা কেন্দ্র মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.

মোখলেসুর রহমান।   

এতে বক্তারা বলেন, অতি ঘন পদ্ধতিতে আমচাষ (ইউএইচডি) প্রযুক্তি গ্রহণ করার ফলে আম উৎপাদনে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন এসেছে যা সারাবছর পাওয়া যায়। এই জাতের আম উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ বলেন, স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন- প্রবৃদ্ধি প্রকল্প শিবগঞ্জে একটি সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে আমরা দেখেছি কীভাবে স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। 

শিবগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক আজাহার আলী বলেন, এই আঞ্চলিক ক্যাম্পেইনটি শিবগঞ্জের স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে চলমান প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বাজার উন্নয়ন ও প্রযুক্তি প্রয়োগের উদাহরণ হিসেবে এটি অন্যান্য পৌরসভাকে পথ দেখাতে পারে।

স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন (এলইডি) সেমিনারে বাংলা এলইডি মডেল এবং শিবগঞ্জ পৌরসভার সফল বাস্তবায়ন ও শিখন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সেমিনারে পাবলিক-প্রাইভেট সংলাপের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ সমাধানের গুরুত্বের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। 

ড. মো: মোখলেসুর রহমান বলেন, সঠিকভাবে অতিঘন প্রযুক্তি (ইউএইচডি) ব্যবহার করে আম উৎপাদনে শিবগঞ্জ যে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সঠিক বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া শিবগঞ্জে শুরু হয়েছে, যা সারা বছর আম রপ্তানির সুযোগ তৈরি করবে এবং রপ্তানি ব্যবস্থার বিস্তার ঘটাবে। 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরফ উদ্দিন শিবগঞ্জের মডেলের উপর ভিত্তি করে ইউএইচডি প্রযুক্তি গ্রহণের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করতে আটটি পৌরসভার ওপর তার মাঠ পর্যায়ের গবেষণা উপস্থাপন করেন। তিনি এই চ্যালেঞ্জগুলোর বাস্তব সমাধানের সুপারিশ করেন এবং আম উৎপাদন ও শীর্ষ-কার্যকর প্রযুক্তির জন্য ‘গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস’ (জিএপি) তুলে ধরেন। তার উপস্থাপনায় উচ্চ ফলন অর্জন, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও রফতানি মান পূরণের বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়।

মাঠ পরিদর্শন ও গবেষণামূলক শিবগঞ্জের পার্শ্ববর্তী ৮টি পৌরসভায় ইউএইচডি ও টপ-ওয়ার্কিং- এর চাষাবাদের ওপর সম্ভাব্য সমাধান তুলে ধরা হয়। এই গবেষণার উদ্দেশ্য- আমসেরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর সামগ্রিক আম উৎপাদনে শিবগঞ্জের সফলতাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেমিনারের পাশাপাশি আম সংক্রান্ত বাণিজ্য মেলা, বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় আম উৎপাদনকারীদের সংলাপ (বিটুবি), স্থানীয় অর্থনৈতিক উনয়নের উপরে গম্ভীরা (ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় নাটক) এবং নারী উদ্যোক্তা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু প্রতিযোগিতার আয়োজনও ছিল। অংশগ্রহণকারীরা উন্নত প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য ইউএইচডি ও টপ-ওয়ার্কিং (ডাল কেটে উন্নত জাতের আমে পরিবর্তন) শীর্ষ-উৎপাদিত আমের খামারগুলো ঘুরে দেখেন।   

সুইসকন্ট্যাক্টের বাংলাদেশের হেড অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আলমগীর কবির উল্লেখ করেন, ২০১৮ সাল থেকে প্রবৃদ্ধি শিবগঞ্জ পৌরসভার সঙ্গে কাজ করে। তাদের স্থানীয় উদ্যোগ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা উন্নত করার জন্য কাজ করছে এবং ইতোমধ্যে শিবগঞ্জ স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি মডেল পৌরসভা হিসেবে সফল হয়েছে। প্রচারণা অনুষ্ঠানে এক হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শিবগঞ্জ, বাঘা, গোদাগাড়ী, নাচোল, মুন্ডুমালা, নওহাটা, চারঘাট, পুঠিয়া এবং সাতক্ষীরা থেকে আগত বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধি, সম্ভাবনাময় আমচাষী, উদ্যোক্তা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এবং বিডা ও বারির ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ বগঞ জ প ইনব বগঞ জ শ বগঞ জ র উপস থ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে

একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।

ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।

দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।

আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।

ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।

গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।

খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।

সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।

ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।

আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার

গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।

ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।

গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ