বালুমহালে হরিলুট, জড়িত একাধিক পক্ষ
Published: 26th, January 2025 GMT
কুশিয়ারা নদীতে বালুমহালে চলছে হরিলুট। মহালের দখল নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে দুটি পক্ষ। সরকারের নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সেগুলো অমান্য করে ইচ্ছেমতো বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালীরা।
ইজারা করা বালুমহালের সরকারি সীমারেখার বাইরে গিয়ে বালু তোলায় ক্ষতিগ্রস্ত নদী ও এর আশপাশের জনপদ। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার একর জমি। বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ।
নিয়মনীতি ও আইনের তোয়াক্কা না করে যৌথ বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকাশ্যে নদীর বিভিন্ন স্থানে ১৫ থেকে ২০টি কাটার মেশিন দিয়ে দিনরাত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে এসব স্থান থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও থামছে না বালু উত্তোলন। এতে করে ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে জাতীয় পাওয়ার গ্রিডের বৈদ্যুতিক সঞ্চালন কেন্দ্র বিবিয়ানা পাওয়ার প্লান্ট, কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা ও হাট-বাজারের বিভিন্ন স্থাপনা।
অভিযোগ রয়েছে বেশির ভাগ এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে এসব বালু উত্তোলন হচ্ছে। যে কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত ও অতিষ্ঠ হলেও মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
এদিকে নবীগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর চরের বালুমহালে অবৈধভাবে বালু তোলা নিয়ে শুক্রবার বিকেলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছে। ঢাকার ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি সংগঠন এ বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলনে প্রশাসনের প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে। তারা বালু উত্তোলন করার জন্য শুক্রবার লোকজন নিয়ে কুশিয়ারা নদীতে যায়। সেখানে ড্রেজার মেশিন বসানোর জন্য নদীতীরবর্তী পাহাড়পুর ও বনগাঁও এলাকায় গেলে স্থানীয়রা বাধা দেন। এ সময় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে কয়েকজন আহত হয়। এ নিয়ে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজের সুপারভাইজার রাজিবুর রহমান জানান, তারা বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি পেয়ে বালু তোলার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। পরে একটি পক্ষ সেখানে তাদের কাজে বাধা দেয়।
এ বিষয়ে বালু উত্তোলনকারী অপর পক্ষ, পারকুল গ্রামের ছাত্রদল নেতা সাজু আহমদ জানান, তারা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ সেখান থেকে বালু তোলার কথা নয়। এ সময় বালু উত্তোলন সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখানোর কথা বলা হলে তিনি জানান, এসব সময়মতো দেখানো হবে।
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নবীগঞ্জ উপজেলায় কয়েকটি বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর যে কয়েকটি বালুমহাল, তার মধ্যে কয়েক বছর ধরে কোনোটি ইজারা দেওয়া হয়নি। অথচ এ বালুমহাল থেকে অবৈধভাবে প্রতি বছর কোটি টাকার বালু উত্তোলন চলছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ মহালটি ইজারার জন্য প্রতিবছর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেট তৈরি করে নিজেরা যেমন কোনো দরপত্র দাখিল করে না, আবার অন্যদেরও দরপত্র জমা দিতে বাধা দেয়। এ সুযোগে বিনা ইজারায় ওই চক্রটি অবৈধভাবে কোটি টাকার বালু উত্তোলন করছে। এখানকার তাজাবাদ ও দীঘলবাক এ দুটি মৌজার বালুমহালের আয়তন ৪৫.
বালুমহালগুলো ঘুরে দেখা যায়, সরকার নির্ধারিত সীমানার বাইরে থেকে নিজেদের খুশিমতো বালু উত্তোলন করছে ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন সময় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে এদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেও কোনোভাবেই অবৈধ বালু উত্তোলন থামানো যাচ্ছে না।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সরকারি ইজারার বাইরে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আরও শক্তভাবে মাঠে নামছে প্রশাসন।
এরই মধ্যে ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি তিন দিন কুশিয়ারা নদী এলাকায় সেনাবাহিনী অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করেছে। এ সময় হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আব্দুল মতিন আছাবকে আটক করা হলে তিনি মুচলেকা দিয়ে ছাড় পান।
বিবিয়ানা বিদ্যুৎ পাওয়ার প্লান্ট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ১০টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু তুলে বাল্কহেডে ভরা হচ্ছে। এসব বালু বাল্কহেডে যুক্ত পাইপের মাধ্যমে শেরপুর অর্থনৈতিক জোনের পাশে খালি জমির মধ্যে রেখে অন্য জায়গায় বিক্রি করা হচ্ছে।
স্থানীয় ছলিম উদ্দিন জানান, এখন শীতকাল চলছে। সাধারণত নদী ভাঙন কম থাকে। নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলার কারণে পাড় ভাঙছে। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ভাঙন তীব্র হয়েছে।
ভুক্তভোগী মুক্তার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম ও রাজু আহমেদসহ অন্যরা জানান, বিবিয়ানা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির পাশ থেকে ১০টি কাটার মেশিন দিয়ে প্রতিদিন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এলাকার কেউ বাধা দিতে গেলে মারধরসহ বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানির হুমকি দেয় তারা। ভয়ে এখন কেউ কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না।
এ ছাড়া নদীর ওপর দিয়ে যাওয়া জাতীয় গ্রিডের ৩৩ কিলো ভোল্টের বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনটিও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। যে কোনো সময় টাওয়ারের তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনুপম দাশ অনুপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কোনোভাবেই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে দেওয়া হবে না। অভিযানে যাওয়ার আগেই তারা খবর পেয়ে সরে যায়। বালু তোলার মূলহোতাদের ধরার চেষ্টা চলছে।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক ফরিদুর রহমান জানান, হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন নবীগঞ্জ কুশিয়ারা নদী থেকে বালু উত্তোলনের কোনো অনুমতি দেয়নি। অনুমতি ছাড়া কেউ বালু উত্তোলন করার কথা নয়। বিআইডব্লিউটিএ কাউকে অনুমতি দিয়েছে কিনা বিষয়টি তাদের জানা নেই। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আরিফ আহমেদ মোস্তফার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর প্রধান সমন্বয় কর্মকর্তা আশরাফুর রহমান জানান, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কোনো তালিকা তাদের কাছে নেই। এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো অভিযোগও নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণ জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অব ধ ব ল র জন য এল ক য় সরক র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
পদ্মা নদীর ভাঙনের ঝুঁকিতে দৌলতদিয়ার তিনটি ফেরিঘাট
পদ্মা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ভাঙন বেড়ে যাওয়ায় রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার তিনটি ফেরিঘাট ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। এ ছাড়া ঘাটসংলগ্ন বহু স্থাপনা রয়েছে ভাঙনের ঝুঁকিতে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা কার্যালয় সূত্র জানায়, দৌলতদিয়ার সাতটি ফেরিঘাটের মধ্যে ৩, ৪ ও ৭ নম্বর ঘাট সচল। ৬ নম্বর ঘাট থাকলেও এখনো সচল করা যায়নি। এ ছাড়া কয়েক বছর আগে ১, ২ ও ৫ নম্বর ঘাট নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, দৌলতদিয়ার তিনটি ফেরিঘাটসহ মধ্যবর্তী এলাকার ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন রোধে ৪ ও ৭ নম্বর ফেরিঘাটে কিছু বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্র বলছে, দৌলতদিয়া ঘাটের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় বর্তমানে সচল সব ঘাটই (৩, ৪ ও ৭ নম্বর) ভাঙনের ঝুঁকিতে। এর মধ্যে ৪ ও ৭ নম্বর ফেরিঘাট বেশি ঝুঁকিতে।
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘ভাঙন দেখা দেওয়ায় ফেরিঘাট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিআইডব্লিউটিএকে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছি। তিনটি ঘাট সচল থাকলেও ভাঙন আরও বৃদ্ধি পেলে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ আরিচা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী নেপাল চন্দ্র দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফেরিঘাটের দুই কিলোমিটারজুড়ে ভাঙন দেখা দেয়। ৪ ও ৭ নম্বর ঘাট বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় জরুরি মেরামত ও সংরক্ষণকাজের অংশ হিসেবে তিন দিনে প্রায় সাত শ বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। তবে ফেরিঘাটের মধ্যবর্তী এলাকায় বস্তা ফেলা হয়নি। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ মিললে বাকি কাজ করা যাবে।
ঘাটসংলগ্ন এলাকায় ভাঙনের ঝুঁকি
ঘাটসংলগ্ন বাহিরচর ছাত্তার মেম্বার পাড়া, মজিদ মাতুব্বর পাড়া, শাহাদত মেম্বার পাড়া, বাজার, মসজিদ, স্কুলসহ একাধিক স্থাপনা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে অনেকে স্থাপনা সরিয়ে নিয়েছেন। ছাত্তার মেম্বার পাড়ার চারটি পরিবার তাদের ঘর সরিয়ে নিয়েছে।
ছাত্তার মেম্বার পাড়ার নদীর পাড়ের শেষ বসতি আলতাফ মোল্লার পরিবারের। বসতভিটা রক্ষা করতে না পেরে দুটি ঘর অন্যত্র সরিয়ে ফেলছে পরিবারটি। আলতাফ মোল্লার স্ত্রী সূর্য বেগম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘ছয়বার ভাঙনে ভিটামাটি হারায়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এইবার ভাঙলে সাতবার হইবে। এখন কোথায় দাঁড়াব বলতে পারছি না। ঘর, টিনের চাল, জিনিসপত্র ভেঙে পাশে রাখছি। এখন কোথাও জায়গা হলে চলে যাব।’
স্থানীয় আলতাফ মোল্লা, শাহাদৎ প্রামাণিক ও ময়ান সরদার বলেন, ‘কয়েক দিনে যে হারে ভাঙছে, এভাবে ভাঙন চললে ফেরিঘাট, বাহিরচর ছাত্তার মেম্বার পাড়া, মজিদ মাতুব্বর পাড়া, শাহাদত মেম্বার পাড়াসহ অনেক স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।’