বাড়ি নেই, ঘরও নেই। ৫০০ টাকা মাসিক ভাড়ায় থাকেন একটি টিনের ছাপরায়। তার দরজাও নেই। স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে এই ছাপরায় থাকেন আবদুল মমিন (৪৪)। তাঁর নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। তবে আচারের কারখানার জন্য চালতা কাটার টাকায় ছয় মাস সংসার চলে তাঁর।

আবদুল মমিন থাকেন পাবনার ভাঙ্গুড়ায়। তাঁর মতো হতদরিদ্র দুই শ থেকে আড়াই শ পরিবার চালতা কেটে যে আয় করে, তা দিয়ে ছয় মাসের সংসার খরচ চলে তাদের।

সম্প্রতি উপজেলার হালদারপাড়ায় আবদুল মমিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বসে চালতা কাটছেন। প্রথমে তিনি একটি চালতাকে চার ভাগ করে দিচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী লাভলী বেগম ও মেয়ে মুক্তি খাতুন সেটা কুচি কুচি করছেন। ১০০টা চালতা কুচি করলে ৮০ টাকা পাওয়া যায়। রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করলে তাঁরা ৪০০ চালতা কাটতে পারেন।

আচারের জন্য এই চালতা আসে বরিশাল ও ভোলা থেকে। ছয়জন ব্যবসায়ী চালতা নিয়ে আসেন। উপজেলার শাহপাড়ার মোড়ে চালতার আড়ত আছে। আড়তের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বরিশাল থেকে চালতা আনতে ট্রাকভাড়া পড়ে ২৯ হাজার টাকা। এক গাড়ি চালতার দাম পড়ে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। ১০০ চালতা থেকে প্রায় ৮ কেজি আচার হয়।

আড়ত থেকে বাড়ি বাড়ি চালতা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছিলেন শ্রমিক আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, তাঁরা বস্তায় ১০০টি চালতা ভরে কাটার জন্য বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার বিনিময়ে ১৬ টাকা করে পান।

কারখানায় আচার তৈরি করে সেই আচার সারা দেশে পাঠানো হয়। আর এলাকার লোকজন হাটে-বাজারে, জলসাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে খুচরা বিক্রি করেন।

এই চালতা নিয়ে সেখানে পাঁচ ধরনের ব্যবসা হয়। মহাজনেরা কাঁচা চালতা ট্রাকে করে নিয়ে আসেন। শ্রমিকেরা বাড়ি বাড়ি কাটার জন্য পৌঁছে দেন। বাড়িতে বসে সেগুলো কাটার কাজ করেন পরিবারের লোকজন। কারখানার শ্রমিকেরা আচার তৈরি করেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা সেগুলো বিক্রি করেন।  

আবদুল মমিন বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পর আর পড়াশোনা করেননি। সংসার পেতেছেন। চালতার মৌসুম শেষ হয়ে গেলে গ্যাসের চুলা সারাইয়ে কাজ করেন। চালতা কাটায় মজুরি কম, তবু কেন এই কাজ করেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা কর্ম তো কইর‌্যা খাইতে হবে। গরিব মানুষ।’

মমিনের স্ত্রী লাবনী বেগমের হাতের আঙুলগুলো কাপড় দিয়ে জড়ানো। তারপরও কেটে যায় মাঝেমধ্যে। এ জন্য বাড়িতে সব সময় ওষুধ এনে রাখতে হয়। স্বামীর কাজে মোটামুটি সন্তুষ্ট লাভলী বেগম বলেন, ‘কাজকর্ম তো করে, বইস্যা তো থাহে না।’

চালতা চার ভাগ করে কাটার পর বীজ ফেলে দেওয়া হয়। এই বীজ ভালো জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগে। হালদারপাড়ার কল্পনা রানী হালদার চালতার বীজ রোদে দিতে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, তাঁর শ্বশুর তাঁকে সহযোগিতা করেন। সারা দিনে তাঁরা ৩০০ থেকে ৪০০ চালতা কাটেন। একই পাড়ার পিংকি রানী হালদারও চালতা কাটেন। তিনি বলেন, ননদ, শাশুড়ি ও তিনি মিলে ৫০০ থেকে ৬০০ চালতা কাটেন। তাঁর স্বামী অটোরিকশা চালান। এ দিয়েই তাঁদের সংসার চলে।

ওই পাড়াতেই আলিমুদ্দিন নামের একজন আচার বিক্রেতাকে পাওয়া গেল। তিনি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ফেরি করে চালতার আচার বিক্রি করেন। তিনি বলেন, তাঁর কোনো পুঁজি নেই। বেচাবিক্রি করে মহাজনকে টাকা দেন। কোনো মাসে ৫ হাজার টাকা আয় হয়। আবার কোনো মাসে বেশিও হয়। তিনি উত্তরাঞ্চলের কোনো শহরে কোথায় চালতার গাছ আছে, মুখস্থ বলে দিতে পারেন। বলে দিলেন রাজশাহী শহরের কোথায় চালতার গাছ আছে।

শাহপাড়ার মোড়ে এসে পাওয়া গেল মহাজন স্বপন গাজীকে। তিনিসহ ছয়জন ব্যবসায়ী বরিশাল ও ভোলা থেকে পাবনায় চালতা নিয়ে আসেন। স্বপন ৩০ বছর ধরে চালতার ব্যবসা করেন। বাড়ি বরিশালে হলেও পরিবার নিয়ে রংপুরে স্থায়ী হয়েছেন। রংপুরে ‘টক ভান্ডার’ নামে তাঁর একটি আড়ত আছে। সেখানে মৌসুমি সব টকজাতীয় ফল তিনি সরবরাহ করেন। তিনি বললেন, যেখানে গরিব মানুষ আছে, সেখানেই তাঁর ব্যবসা। হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েরা চালতা কাটার কাজ করে বাড়তি কিছু আয় করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ব যবস ক জ কর বর শ ল পর ব র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ