দোকানিরা বললেন সয়াবিন তেল নেই, পরে অভিযানে মিলল ২০০ কার্টন
Published: 27th, February 2025 GMT
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কয়েকটি দোকানে অভিযান চালিয়ে ২০০ কার্টনের বেশি বোতলজাত সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বিক্রেতারা এসব তেল গোপনীয় স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দোকানগুলোকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
প্রায় এক মাস ধরে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট চলছে। দোকানে দোকানে ঘুরেও ক্রেতারা বোতলের তেল কিনতে পারছেন না। খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, কোম্পানিগুলো ও ডিলাররা পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করছে না। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চাহিদার তুলনায় দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত আমদানি রয়েছে। আর ভোজ্যতেল উৎপাদন ও পরিশোধন কোম্পানিগুলোর দাবি, তারা নিয়মিত বাজারে তেল সরবরাহ করছে; কিন্তু কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াতে ডিলার ও খুচরা পর্যায়ে তেল মজুত করে রাখা হচ্ছে।
এ রকম পাল্টাপাল্টি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দিন ধরে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে ভোক্তা অধিদপ্তর। সে ধরাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার ও শান্তিনগর বাজারে অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটি। কারওয়ান বাজারে অভিযানকালে সাতটি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল মজুত করে রাখার প্রমাণ পায় ভোক্তা অধিদপ্তর।
সংস্থাটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অভিযানের আগে দোকানগুলোতে সাদাপোশাকে তেল কিনতে যান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তখন দোকানিরা জানান, তাঁদের কাছে বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। পরে অভিযান পরিচালনা করে দোকানগুলো থেকে ২০০ কার্টনের বেশি বোতলজাত সয়াবিন উদ্ধার করেন কর্মকর্তারা।
এসব তেল ভোক্তাদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করে সংস্থাটি। আর দায়ী সাত প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীর শান্তিনগরেও অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিদপ্তর। এ সময় সয়াবিন তেল মজুত করে রাখার অভিযোগে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভোক্তা অধিদপ্তর জানায়, অভিযানে তারা দেখেছে যে বেশ কিছু দোকানের সহজে দৃশ্যমান স্থানে ভোজ্যতেল প্রদর্শন করা হচ্ছে না এবং ক্রেতাদের তেল নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরে তল্লাশিতে দোকানের গোপনীয় স্থানে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেলের (৫ লিটারের ২০০ কার্টনের বেশি) মজুত পাওয়া যায়।
কারওয়ানবাজারে অভিযানের সময় ২০২৩ সালের মে থেকে অক্টোবর সময়ে উৎপাদিত পাঁচ লিটারের ছয় কার্টন সয়াবিন তেলও জব্দ করা হয়। এসব তেলের মেয়াদ ২০২৪ সালের মে থেকে অক্টোবরে শেষ হয়েছে। আবার ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উৎপাদিত পাঁচ লিটারের কিছু বোতলজাত সয়াবিন তেলও পাওয়া গেছে। এসব বোতলের গায়ে ৮১৮ টাকা মূল্য লেখা থাকলেও দোকানিরা ৮৫০–৮৫২ টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
এই অপরাধে কারওয়ানবাজারের সাতটি প্রতিষ্ঠানকে মোট দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর। এর মধ্যে শুধু একটি দোকানকেই দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ওই দোকানের গোপন স্থানে ১২০ কার্টন বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অভিযানে শান্তিনগর বাজারের দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
ভোক্তা অধিদপ্তর জানায়, বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট নেই। কিছু পাইকারি ও খুচরা অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা লাভের আশায় তেল লুকিয়ে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখাচ্ছেন। রমজান সামনে রেখে তাঁরা এমনটা করেছেন। সে জন্য তদারক কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।
কারওয়ানবাজারে অভিযানের নেতৃত্ব দেন ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সংস্থাটির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো.
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।