রাশিয়া ও চীনকে নিয়ে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়বেন ট্রাম্প!
Published: 1st, March 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে চুক্তি হলে ইউক্রেন ও ইউরোপের ওপর তার যে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেটা নিয়ে জোরালো আলোচনা চলছে। কিন্তু ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে যদি চুক্তি হয়েই যায়, তাহলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক কতটা ঝুঁকিতে পড়বে, তার থেকেও বড় একটা ঝুঁকি রয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন তিন বছর পার করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও সংশয় বেড়েছে। আবারও ঘটনাপ্রবাহ সেই ১৯৩৮ সালের মিউনিখের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে দুঃখজনকভাবে মিলে যাচ্ছে।
পুতিনকে সন্তুষ্ট করা যাবে, এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পরাশক্তিরা আবারও নিজেরা দুর্বল রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
১৯৩৮ সালে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল চেকোস্লোভাকিয়ার ক্ষেত্রে। জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেন মিলে চেকোস্লোভাকিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ইউক্রেন এখন যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার চাপে পড়েছে আর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়েছে।
ট্রাম্প ও তাঁর লোকেরা রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের প্রায় ২০ ভাগ ভূমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এই ভূমি রাশিয়া অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া ট্রাম্প দাবি করেছেন, অতীতে ইউক্রেনকে তারা যে সহায়তা দিয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ৫০ শতাংশ খনিজ ও বিরল খনিজ সম্পদ তুলে দিতে হবে।
ইউক্রেনকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে আমেরিকা অস্বীকৃতি জানালে সেটা শুধু ইউক্রেনের জন্যই নয়, মিত্র ন্যাটো সেনাদের জন্যও (যাদেরকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি অথবা শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে ইউক্রেনে তাদের নিয়োজিত করার আলোচনা হয়েছে) মিউনিখ চুক্তির ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি চুক্তির হওয়ার পেছনে এমন যুক্তি যুক্তি থাকতে পারে যে ট্রাম্প চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরাতেই এটা করছেন। কিন্তু চীনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা ও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিরিখে সেটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।ফ্রান্স ও ব্রিটেন সে সময় শুধু তাদের মিত্র চেকোস্লোভাকিয়াকে জাতিগত জার্মান–অধ্যুষিত সুডেটেনল্যান্ডকে নাৎসি জার্মানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়নি, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি চেকোস্লোভাকিয়ার অংশবিশেষ দখলে নিলেও তারা কিছু বলেনি।
মিউনিখ চুক্তির মাত্র ছয় মাসের মাথায় যখন হিটলার চুক্তি লঙ্ঘন করে অবশিষ্ট চেকোস্লোভিয়াকে ভেঙে পুতুল স্লোভাক রাষ্ট্র গঠন করেন এবং চেকদের ভূমি দখল শুরু করেন। তখনো ফ্রান্স ও ব্রিটেন প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হয়েছিল।
পুতিন যে ইউক্রেনেই থামবেন না, তাঁর প্রতিটি ইঙ্গিত এখন দেখা যাচ্ছে। আর এটি মনে রাখা দরকার যে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন তখন ভেবেছিলেন যে তিনি ‘আমাদের সময়ের শান্তি’ নিশ্চিত করে ফেলেছেন। অথচ ১১ মাসের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
ট্রাম্প ভাবছেন তিনি পুতিনকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করছেন না। চেম্বারলিন ও দালাদিয়ার ১৯৩৮ সালে এমন করেই হিটলার সম্পর্কে ভেবেছিলেন। আরও চিন্তার কারণ হচ্ছে ট্রাম্পের হাতে পুতিনের চেয়ে দুর্বল তাস রয়েছে।
ট্রাম্প সরল একটি দৃষ্টভঙ্গি দিয়ে চালিত হন। তিনি মনে করেন, পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বলয়ের অঞ্চল থাকবে, যেখানে অন্য পরাশক্তি হস্তক্ষেপ করবে না।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে সমস্যাটি হলো, ট্রাম্প এটিকে নিজের প্রভাব বলয়ের অঞ্চল মনে করছেন না। আর ইউরোপ ইউক্রেনকে বড়জোর তাদের প্রান্তীয় প্রভাব বলয়ের দেশ মনে করে।
ট্রাম্পের কাছে ইউক্রেন অথবা ইউরোপ কোনো বিষয় নয়। তিনি বিশ্বব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে চান, যেটা কিনা উনিশ শতকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায়। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতার জগতে ছিল এবং পশ্চিমা গোলার্ধে ছিল কার্যত চ্যালেঞ্জহীন।
ট্রাম্পের কণ্ঠে হেনরি কোবাটের বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্ত্ব প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এমন কতকগুলো অভিযানে জড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্বার্থ ঝুঁকিতে নেই।
পুতিন দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অন্যায্য আগ্রাসন নয়, এটা ইউক্রেনের ভুল। ট্রাম্পও এই যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা যে পাস করতে পারেনি, তার চূড়ান্ত পরীক্ষা হলো ইউক্রেন।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি হলে সেটা হবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপর চূড়ান্ত আঘাত। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাতে করে তাদের পক্ষে বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে কবর দেওয়া সহজ, কিন্তু নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা কঠিন।
ইউরোপ থেকে এখন পর্যন্ত যে সমালোচনা এসেছে, তার বেশির ভাগই একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিক্রিয়া। তাদের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি হলো, মহাদেশটি যেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার চেয়ে অনেক শক্তিশালী ভিত্তি থাকে।
ট্রাম্প কিংবা পুতিন—দুজনের কেউই চীনকে ছাড়া বিশ্বব্যবস্থা পাল্টাতে পারবেন না। ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি চুক্তির হওয়ার পেছনে এমন যুক্তি যুক্তি থাকতে পারে যে ট্রাম্প চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরাতেই এটা করছেন। কিন্তু চীনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা ও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিরিখে সেটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
উদার বিশ্বব্যবস্থা এ মুহূর্তে একটি প্রত্যাশা শুধু করতে পারে। সেটা হলো, পুতিন ও সি চিন পিংয়ের মধ্যকার চুক্তিটি যেন ভেঙে যায়। ১৯৩৯ সালে হিটলার–স্তালিনের মধ্যকার চুক্তির মতোও এটা যেন স্বল্পজীবী হয়। কিন্তু পুতিন ও সি চিন পিংয়ের জোট দ্রুত ভেঙে যাবে, এমন আলামত কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
স্টিফেন উলফ, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র ব যবস থ র জন য হওয় র র ওপর ইউর প করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন
টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।
এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।
গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।
প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।