আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের বিগত দিনগুলোর বিভিন্ন পর্বের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। যুগ-সন্ধিক্ষণের প্রহরে দাঁড়িয়ে আমাদের জাতিকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হলে পিছু ফিরে দেখতে হবে ইতিহাসের বাঁক-পরিবর্তনের সময় কে কী করেছি, কী ভুল ছিল, সাফল্য কোথায়, ব্যর্থতা কোথায়, সীমাবদ্ধতা কী ছিল, ইত্যাদি। এ রকম ইতিহাস চর্চার ব্যাপক অনুশীলনের প্রথম লগ্ন যখন শুরু হয়েছে, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস উদ্ঘাটন তখন অতি আবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। এই কালপর্ব নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে, যেমন– মোহাম্মদ ফরহাদের উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মাহফুজ উল্লাহর অভ্যুত্থানের উনসত্তর, গোলাম কুদ্দুছের গণঅভ্যুত্থানের সুবর্ণজয়ন্তী ফিরে দেখা, লেনিন আজাদের উনসত্তরের গণআন্দোলন, মোরশেদ শফিউল হাসানের স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক, ইত্যাদি।
এ পর্যায়ে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও জনমুক্তির প্রশ্ন’ একটি অবধারিত প্রাপ্তির মতো আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারিতে। আমরা জানি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ইতিহাস পর্যালোচনার একটি স্বতন্ত্র পদ্ধতি আছে, দৃষ্টিকোণ আছে– যা আমরা তাঁর পূবর্বর্তী বইগুলো পাঠ করে জেনেছি। বর্তমান বইটিও তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আরও বেশি ব্যতিক্রম হলো এখানে তিনি শুধু উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসের কালানুক্রমিক বর্ণনা দেননি, এর পরিপ্রেক্ষিত-সংঘটন-ফলাফলকে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন একটি মানদণ্ড দিয়ে। সেটি হলো : বাংলাদেশের জনমুক্তির প্রশ্নে এই অভ্যুত্থানের জনকদের আগ্রহ, সংশ্লিষ্টতা এবং বিবেচনাবোধ কতখানি ছিল এবং সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের নাগরিক-জীবনে তার প্রভাব ও ভূমিকা কতখানি সাফল্য অর্জন করেছে। বইটি পড়তে হলে, সমগ্র বইটিতে বিধৃত লেখকের এই কৌশলের মাধ্যমেই পাঠককে এগিয়ে যেতে হবে। এবং সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে বিগত শতাব্দীর বাংলাদেশের ওপর পাঠকের প্রয়োজনীয় ইতিহাসজ্ঞান। কারণ, তার পরিচ্ছেদ-বিভাজনটি কালানুক্রমিক। কিন্তু প্রতিটি পরিচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনাবলিকে তিনি তাঁর মাপকাঠি ধরে উনসত্তরের কুশীলব, সংগঠন, নেতা, নেতৃত্বকে কখনও তৎকালীন, কখনও স্বাধীনতা-পরবর্তী, কখনও সাম্প্রতিককালের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। এজন্য এই সূক্ষ্মদর্শী আলোচনায় অংশ নিতে হলে পাঠকের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দল-নেতা-ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান ব্যতীত বইটির অনেকাংশের বক্তব্য সঠিকভাবে অনুধাবনে অসুবিধা হতে পারে।
এ রকম তুলনামূলক আলোচনার ফলে তাঁর গ্রন্থটি শুধু উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ঘটনার বিবরণের তালিকা না হয়ে একদিকে রাজনৈতিক পরিক্রমায় নেতা-নেতৃত্ব-দলের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে ব্যক্তি পাঠককে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিভিন্নমুখী চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ করেছে, অন্যদিকে পেয়েছে রেফারেন্স বইয়ের মর্যাদা।
এই বইয়ের উপসংহারে লেখক দ্বিজাতি তত্ত্বকে ভ্রান্ত বলেছেন। কারণ, ভারতবর্ষ হলো বহুজাতির দেশ। লাহোর প্রস্তাবের নিরিখে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক জটিলতার ফলে সৃষ্ট ন্যাপের ১৪ দফা, আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ডাকের ৮ দফা, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্টদের ৮ দফা ইত্যাদির বিস্তারিত আলোচনা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণের চিত্রটি তুলে ধরেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে দল-ব্যক্তি-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে দুই অর্থনীতি তত্ত্বের প্রভাব, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব আলোচনা করেছেন। আন্দোলনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর মতে : শ্রমজীবী-ছাত্র-জনতার বিপুল অংশগ্রহণ সত্ত্বেও আন্দোলন থামেনি, বুর্জোয়া নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের ফলাফল আত্মসাৎ করে আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছে, এবং পরিণামে একাত্তর পরবর্তীকালে দেশে চলেছে তাদের শাসন-শোষণ।
প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত বইটি ইতঃপূর্বে ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির বহুল প্রচারই শুধু কাম্য নয়, এর বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষণকে জাতীয় পর্যায়ে অনুশীলনের জন্য সবার সমবেত প্রচেষ্টাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বই র গণঅভ য ত থ ন র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।
আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা।
আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।
আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।
অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।
আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।
এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।
এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।
বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।
লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল