পুতিনকে ঠেকানোর মোক্ষম অস্ত্রটা ইউরোপের হাতেই আছে
Published: 10th, March 2025 GMT
এটি এখন স্পষ্ট, রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে প্রতিরোধ লড়াই চালাতে থাকা ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বাসঘাতকতা করবে। বোঝা যাচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে ট্রাম্প হয় ভুল তথ্যের শিকার, নয়তো তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আমেরিকান জনগণকে যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিভ্রান্ত করার চক্রান্তে জড়িত।
ট্রাম্পের মিথ্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে—তিনি দাবি করছেন, এ যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনও সমান দায়ী। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির হাতে যুদ্ধ শেষ করার মতো কোনো ‘তাস’ নেই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না পেলে ইউক্রেন নিজেকে রক্ষা করতে পারত না।
কিন্তু সারা বিশ্ব জানে, এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমানভাবে দায়ী করা যায় না। কারণ, রাশিয়া বিনা উসকানিতে ইউক্রেনের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমাদের সবার মনে আছে, যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ইউক্রেনের সেনারা যখন ১ হাজার ৮০০ মাইল দীর্ঘ ফ্রন্টলাইনে বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তখনো পশ্চিমা দেশগুলোর গোলাবারুদ, সাঁজোয়া যান ও বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তাদের কাছে পৌঁছায়নি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ওভাল অফিসের ঘটনাটি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে, ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি শত্রুতামূলক মনোভাব পোষণ করেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি তাঁর গভীর পক্ষপাতিত্ব রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এর পেছনে কি শুধু এই একটি মাত্র কারণই কাজ করেছে যে ট্রাম্প স্বার্থপর ও উচ্চাভিলাষী একনায়কদের পছন্দ করে থাকেন; নাকি তার আসল কারণ হলো পুতিনের কাছে ট্রাম্পের দুর্বলতার কোনো গোপন তথ্য আছে, যা পুতিন ফাঁস করে দিলে ট্রাম্পের জন্য বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করতে পারে?
যাহোক, ট্রাম্প আইনের শাসনের মূল ধারণাটিকেই প্রত্যাখ্যান করে বসেছেন। কারণ, তিনি আইনের গুরুত্বকে রাজনৈতিক স্বার্থের অধীন করে ফেলেছেন। ট্রাম্পের মতে, আইন যতক্ষণ প্রেসিডেন্টের স্বার্থ রক্ষা করবে, ততক্ষণ আইন মানতে হবে। আর যখন আইন প্রেসিডেন্টের কাজে বাধা সৃষ্টি করবে, তখন তা মানার কোনো দরকার নেই। তাঁর দৃষ্টিতে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো (এমনকি তাঁর নিজের স্বাক্ষর করা চুক্তিগুলোও) যখন ইচ্ছা তখন ভঙ্গ করা যেতে পারে।
১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত বুদাপেস্ট স্মারক অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া একত্রে ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর বিনিময়ে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার ত্যাগ করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে ক্রিমিয়াকে বেআইনিভাবে দখল করে, তখন তারা এই চুক্তি ভঙ্গ করে। আর এখন সেই চুক্তির দুই পক্ষ—যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য—ইউক্রেনের সঙ্গে যা করছে, তা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
ইউরোপকে বুঝতে হবে, ইউক্রেন শুধু নিজের জন্য নয়, তারা পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য লড়াই করছে। এ অবস্থায় ইউরোপ আইনি জটিলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে না। এখনই সময় রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহার করে ইউক্রেনকে সহায়তা করার।ট্রাম্পের আমেরিকার প্রতিশ্রুতি না মানা লজ্জাজনক। ইউক্রেন তাদের দায়িত্ব পালন করেছে এবং তারা আশা করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রও তাদের পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কথা রাখল না, বিশ্বাসঘাতকতা করল। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকতা শুধু ইউক্রেনের জন্যই বিপদ ডেকে আনছে না, বরং এর গভীর প্রভাব ইউরোপের নিরাপত্তার ওপরও পড়বে।
বহু দশক ধরে ন্যাটোর চুক্তির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের ওপর ইউরোপের নিরাপত্তা নির্ভর করেছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ন্যাটোর কোনো সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে সেটিকে পুরো জোটের ওপর হামলা হিসেবে দেখতে হবে। কিন্তু এখন স্পষ্ট, ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ততক্ষণই ইউরোপকে রক্ষা করবে, যতক্ষণ ইউরোপ ট্রাম্পের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে সহায়ক হবে।
আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির বাধ্যবাধকতার কোনো মূল্য ট্রাম্পের কাছে নেই; ঠিক যেমন পুতিনের কাছেও তার কোনো মূল্য নেই।
ইউরোপের দেশগুলো এখন এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এখন তাদের সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা এবং ২০২২ সালে জব্দ করা রাশিয়ার ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ইউরোপের হাতে থাকা ২২০ বিলিয়ন ডলার কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নির্ধারণ করা।
২০২৪ সালের জুনে জি-৭ দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই সম্পদের সুদ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার ইউক্রেনকে সহায়তা হিসেবে দেওয়া হবে। এরপর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় কমিশন প্রথম দফায় তিন বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে এই আংশিক ব্যবস্থা আর কাজ করবে না। সে ক্ষেত্রে ইউরোপকে আরও এগিয়ে যেতে হবে এবং তার নিয়ন্ত্রণে থাকা রাশিয়ার সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
আমরা এর আগে বলেছিলাম, রাশিয়ার জব্দ করা এই সম্পদ ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহার করা উচিত। কারণ, রুশ আগ্রাসনের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা ২২০ বিলিয়ন ডলারের অনেক বেশি। কিন্তু এখন এই অর্থ আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।
যে দেশ এখনো হামলার শিকার এবং আংশিক দখলের মধ্যে আছে, সেটির পুনর্গঠনে কাজ শুরু করা সম্ভব নয়। ন্যায়বোধ ও সাধারণ যুক্তি বলে, এই সম্পদ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। ইউরোপ আইনগতভাবে যা করার দরকার তা করতে পারে। তবে মূল বিষয় হলো এই অর্থ ইউক্রেনকে দ্রুত দিতে হবে, যাতে তারা সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পারে এবং রাশিয়ার ধ্বংস করা অবকাঠামো মেরামত করতে পারে।
এখানে দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যখন রাশিয়া নিজেই আইনের শাসন ধ্বংস করছে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করছে, তখন তারা আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিতে পারে না। এ ছাড়া এই তহবিল ইউক্রেনকে দেওয়া ইউরোপের নিজের স্বার্থের মধ্যেই পড়ে। ইউক্রেন তাদের প্রতিরক্ষা খাতে যে অর্থ ব্যয় করবে, তা ইউরোপের সামরিক সক্ষমতা বাড়াবে এবং ইউরোপের দুর্বল হয়ে পড়া অর্থনীতিকেও চাঙা করবে।
সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। এই অর্থকে ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক দাবিসংক্রান্ত কমিশনের জন্য জামানত হিসেবে রাখার যে প্রস্তাব এসেছে, তা শুধু অহেতুক বিলম্ব ঘটাবে।
ইউরোপকে বুঝতে হবে, স্বৈরাচারী শক্তিগুলো আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আর ইউরোপই এখন এর বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিরোধক। ইউরোপীয় মূল্যবোধ, নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ—এসব কিছু এখন তাদের এ সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সম্প্রতি বলেছেন, ইউরোপের আবার ঝুঁকি নেওয়ার সাহস, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার স্বাদের অন্বেষণ করা উচিত।
যদি মাখোঁ এবং অন্য ইউরোপীয় নেতারা ওভাল অফিসের অপমানজনক ঘটনার পর সত্যিই ইউক্রেনকে সমর্থন করতে চান, তাহলে এখনই তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ এখনই তাঁদের রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
ইউরোপকে বুঝতে হবে, ইউক্রেন শুধু নিজের জন্য নয়, তারা পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য লড়াই করছে। এ অবস্থায় ইউরোপ আইনি জটিলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে না। এখনই সময় রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহার করে ইউক্রেনকে সহায়তা করার।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জোসেফ ই.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র প ব যবহ র কর র জন য প আইন আইন র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।