অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা কবে আইনের আওতায় আসবেন
Published: 15th, March 2025 GMT
প্রায় আট মাস যাবৎ ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হিসেবে কর্মরত অহিদুল প্রতিদিনের মতো সেদিন সকালেও কর্মস্থলে এসে ইন্টারকমে মালিকের অ্যাপার্টমেন্টে কল দিয়ে গাড়ির চাবি পাঠাতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চাবির বদলে মালিক নিজে এসে বললেন, ‘গাড়িতে তোমার যা যা জিনিস আছে, বের করে নাও।’ অহিদুল তাঁর পানির বোতল থেকে শুরু করে গাড়ি মেরামতের টুকিটাকি যন্ত্রপাতি যা আছে, সব বের করে নিলেন। এবার মালিক বললেন, ‘আজ থেকে তোমাকে আর লাগবে না।’
বিদ্যালয়ে যাওয়া দুই সন্তান, স্ত্রী ও অসুস্থ মা—চারজন মানুষের দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, সেই অহিদুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তবু তিনি চাকরিচ্যুতির কারণ জানতে চাইলেন না, শুধু অবাক হলেন—এভাবে বিনা নোটিশে চাকরি চলে গেল! অনুমান করলেন, গাড়িতে বসে কয়েক দিন আগে মালিকের তরুণ পুত্রের মদ্যপান নিয়ে মালিকতনয় ও তাঁর মধ্যে যে বচসা হয়েছিল, তার খেসারতই দিতে হলো তাঁকে। অহিদুল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ মাসের বেতনটা?’ মালিক বললেন, ‘এক সপ্তাহ পরে এসে নিয়ে যেয়ো।’
এক সপ্তাহের জায়গায় ৩২ সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। প্রথম কয়েকবার গিয়ে ইন্টারকমে কল করলে বলা হতো, ‘আগামী সপ্তাহে এসো।’ এখন অহিদুল সে এলাকায় যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, মালিকের ভবনের দারোয়ান বলে দিয়েছেন, ‘এরপর অহিদুলকে এদিকে দেখলে পুলিশে খবর দেওয়া হবে।’
এটি কি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি এ ধরনের ঘটনার ঘনঘটা এত বেশি যে তা আমাদের সমাজে মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে গেছে, আর আমরা এগুলোকে ‘স্বাভাবিক’ভাবে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি? ব্যক্তিগত ও বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গৃহকর্মী, মালি, দারোয়ান, নিরাপত্তাকর্মী, ব্যক্তিগত ভবনের নির্মাণশ্রমিক, কৃষি, মৎস্য ইত্যাদি শিল্পের শ্রমিক, হোম ডেলিভারির কাজে নিযুক্ত কর্মীদের কাজকে আমরা আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতায় ফেলি না। কিন্তু সমাজ ও অর্থনীতিকে সচল ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবদান কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? তাঁদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কি সরকারের নয়?
রাজনৈতিক সরকারের আমলে তাঁরা উপেক্ষিত ছিলেন। ভবিষ্যতে যে রাজনৈতিক সরকার আসবে, তারাও অতীতের নীতি অনুসরণ করবে না এবং অনেক কাজের তালিকায় এই প্রান্তিক মানুষদের মনে রাখবে—এমনটা আশা করা কঠিন। অন্তর্বর্তী সরকার, যার কাজ করার ক্ষমতা, সুযোগ ও পরিধি অনেক বিস্তৃত, সেও যদি শ্রম আইনে এই মানুষগুলোর অধিকারকে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে সুরক্ষা ও অধিকার কেবল সমাজের বিশেষ শ্রেণির জন্য প্রযোজ্য শব্দ হয়েই থাকবে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ তার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়াসহ আরও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু যে ‘শ্রমিক’ আইন দ্বারা শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃত নয়, তার কী হবে?
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬–এর মাধ্যমে বিদ্যমান অনেক শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা আইন বাতিল করে একটি সমন্বিত আইন পাস করা হয়। এ আইনের আওতায় শ্রমিকেরা তাঁদের কর্মসংক্রান্ত বিভিন্ন অধিকার বাস্তবায়নের জন্য শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। শ্রমিকেরা যাতে সহজে প্রতিকার পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করার জন্য এই আইনে মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো কোর্ট ফি দিতে হয় না।
শ্রম আইন, ২০০৬ কার্যকর করার জন্য আরও বিশদ বিধানাবলিসহ বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। শ্রম আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগার এবং ক্ষেত্রবিশেষে রায় পাওয়ার পরও তা বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ বিলম্ব হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এ কারণে অনেক শ্রমিক তাঁদের অধিকার লঙ্ঘিত হলেও আইনের আশ্রয় নেন না।
কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো এই আইনের আওতার বাইরে। অথচ ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রায় ৮৪ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক শ্রম খাতের অবদান রয়েছে’ (বণিক বার্তা, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪)। আনুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন থাকলেও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের তেমন কিছু নেই। তাই তাঁদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম বঞ্চনা, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন বনাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ [(২০১১) ৩১ বিএলডি (এইচচিডি) ২৬৫] মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ আক্ষেপ প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে গৃহকর্মীরা শ্রম আইন, ২০০৬–এ ‘শ্রমিক’-এর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত নন। আদালত মত প্রকাশ করেন, এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে দেওয়া উচিত নয়। গার্হস্থ্য খাতে কর্মরত ব্যক্তিরা দিনের পর দিন সেবা প্রদান করছেন, অথচ তাঁদের শ্রম আইন কোনো স্বীকৃতি দেয়নি, এটি দুর্ভাগ্যজনক।
গৃহশ্রমিকদের মতো অন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদেরও শ্রম আইনের আওতায় আনার সময় এসেছে। কেউ কেউ বলতে পারেন, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের যদি তাঁদের নিয়োগকারীর সঙ্গে কোনো চুক্তি থাকে, তাহলে তাঁরা দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এ খাতে সাধারণত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি থাকে না। তাই তাঁদের নিয়োগকারীর দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘিত হলে প্রতিকার পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, যেখানে শ্রম আদালতেই অনেক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়, সেখানে অনানুষ্ঠানিক খাতকে এই আইনের আওতায় আনলে মামলাজট আরও বাড়বে। এ আশঙ্কা অমূলক নয়। কিন্তু শ্রম আদালতে আরও বিনিয়োগ বাড়িয়ে এবং ডিজিটাল কেস ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা চালু করে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
এখনই সময় এসেছে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের শ্রম আইন, ২০০৬–এর আওতায় নিয়ে আসার। যত দিন তা সম্ভব না হয়, তত দিন অন্তত স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কিছু তদারকির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের জন্য নিয়োগপত্র বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এ–জাতীয় ব্যবস্থা বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত করা উচিত।
কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘আইন তৈরি হয় সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্য।’ বাংলাদেশ অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের আইনের আওতার বাইরে রেখে এ কথাকেই সমর্থন করছে। শ্রম আইন নিয়ে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখন জরুরি। শ্রমিকেরা করুণার পাত্র নন; তাঁদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। শ্রমিকদের ছাড়া অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়বে। তাই অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদ্যোগ নিতে আর কালবিলম্ব নয়।
ড.
ইশরাত জাকিয়া সুলতানা, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
মো. রিজওয়ানুল ইসলাম অধ্যাপক, আইন বিভাগ ও ডিন, স্কুল অব হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইন র আওত য় র জন য সরক র বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
টেক্সটাইল শিক্ষকদের দিকে তাকান
একটা রাষ্ট্রের উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার কিছু মানদণ্ড আছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানসম্পন্ন যুগোপযোগী শিক্ষার প্রসার করা। শিক্ষকদের দুর্বল বেতনকাঠামো দিয়ে এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুধু তা–ই নয়, অনেক সময় নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শিক্ষকদের বেতনও আটকে যায়। যেমন আমরা দেখছি সারা দেশে মোট ১০টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষক–কর্মচারীরা ১৪ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। কারিগরি শিক্ষা নিয়ে গুরুত্বারোপ করা হলেও সেখানে নানা অবহেলা বিদ্যমান। এটি খুবই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০০৬ সাল থেকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বস্ত্র অধিদপ্তরের অধীন দেশের ১০টি জেলায় টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্প শুরু হয়। ২০০৮ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ছিল। এরপর তিনবার প্রকল্পের মেয়াদ বর্ধিতকরণ হওয়ার পর ২০১৪ সালের জুনে শেষ হয়। ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পেতেন। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অনিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। তবে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত ১৪ মাস ধরে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।
শিক্ষকদের অভিযোগ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় তাঁরা বেতন পাচ্ছেন না। ফলে বাড়িভাড়া, সন্তানের শিক্ষা ও চিকিৎসা—সবই ব্যাহত হচ্ছে। অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষকেরা যে আর্থিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা তাঁদের পেশাদার জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবন উভয়কেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
যে শিক্ষকেরা দেশের টেক্সটাইল শিল্পে দক্ষ জনশক্তি তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছেন, তাঁদের এমন করুণ দশা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এই শিক্ষকেরা মনোবল হারিয়ে ফেলছেন, ক্লাসে স্বাভাবিক মনোযোগ দিতে পারছেন না এবং এর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ছে। এমন অবস্থায় কীভাবে দেশের টেক্সটাইল খাতকে শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা সম্ভব, তা একটি বড় প্রশ্ন।
শিক্ষকদের এই দুর্দশা কোনো নতুন ঘটনা নয়। ২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পের অধীনে স্থাপিত এই ইনস্টিটিউটগুলো বহু বছর ধরে অনিশ্চয়তার মধ্যে চলছে। আদালতের রায়ের পরও এ অচলাবস্থা কাটছে না। ২০১৮ সালে হাইকোর্ট এবং চলতি বছরের ২১ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ শিক্ষকদের পক্ষে রায় দিলেও বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় তা কার্যকর করছে না। এই দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচার বিভাগের আদেশকে উপেক্ষা করার প্রবণতা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করে।
আমরা আশা করব টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের এ দুর্দশা দ্রুত কেটে যাবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের দিকে সুদৃষ্টি দেবেন।