প্রায় আট মাস যাবৎ ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হিসেবে কর্মরত অহিদুল প্রতিদিনের মতো সেদিন সকালেও কর্মস্থলে এসে ইন্টারকমে মালিকের অ্যাপার্টমেন্টে কল দিয়ে গাড়ির চাবি পাঠাতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চাবির বদলে মালিক নিজে এসে বললেন, ‘গাড়িতে তোমার যা যা জিনিস আছে, বের করে নাও।’ অহিদুল তাঁর পানির বোতল থেকে শুরু করে গাড়ি মেরামতের টুকিটাকি যন্ত্রপাতি যা আছে, সব বের করে নিলেন। এবার মালিক বললেন, ‘আজ থেকে তোমাকে আর লাগবে না।’

বিদ্যালয়ে যাওয়া দুই সন্তান, স্ত্রী ও অসুস্থ মা—চারজন মানুষের দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, সেই অহিদুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তবু তিনি চাকরিচ্যুতির কারণ জানতে চাইলেন না, শুধু অবাক হলেন—এভাবে বিনা নোটিশে চাকরি চলে গেল! অনুমান করলেন, গাড়িতে বসে কয়েক দিন আগে মালিকের তরুণ পুত্রের মদ্যপান নিয়ে মালিকতনয় ও তাঁর মধ্যে যে বচসা হয়েছিল, তার খেসারতই দিতে হলো তাঁকে। অহিদুল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ মাসের বেতনটা?’ মালিক বললেন, ‘এক সপ্তাহ পরে এসে নিয়ে যেয়ো।’

এক সপ্তাহের জায়গায় ৩২ সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। প্রথম কয়েকবার গিয়ে ইন্টারকমে কল করলে বলা হতো, ‘আগামী সপ্তাহে এসো।’ এখন অহিদুল সে এলাকায় যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, মালিকের ভবনের দারোয়ান বলে দিয়েছেন, ‘এরপর অহিদুলকে এদিকে দেখলে পুলিশে খবর দেওয়া হবে।’

এটি কি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি এ ধরনের ঘটনার ঘনঘটা এত বেশি যে তা আমাদের সমাজে মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে গেছে, আর আমরা এগুলোকে ‘স্বাভাবিক’ভাবে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি? ব্যক্তিগত ও বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গৃহকর্মী, মালি, দারোয়ান, নিরাপত্তাকর্মী, ব্যক্তিগত ভবনের নির্মাণশ্রমিক, কৃষি, মৎস্য ইত্যাদি শিল্পের শ্রমিক, হোম ডেলিভারির কাজে নিযুক্ত কর্মীদের কাজকে আমরা আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতায় ফেলি না। কিন্তু সমাজ ও অর্থনীতিকে সচল ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবদান কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? তাঁদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কি সরকারের নয়?

রাজনৈতিক সরকারের আমলে তাঁরা উপেক্ষিত ছিলেন। ভবিষ্যতে যে রাজনৈতিক সরকার আসবে, তারাও অতীতের নীতি অনুসরণ করবে না এবং অনেক কাজের তালিকায় এই প্রান্তিক মানুষদের মনে রাখবে—এমনটা আশা করা কঠিন। অন্তর্বর্তী সরকার, যার কাজ করার ক্ষমতা, সুযোগ ও পরিধি অনেক বিস্তৃত, সেও যদি শ্রম আইনে এই মানুষগুলোর অধিকারকে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে সুরক্ষা ও অধিকার কেবল সমাজের বিশেষ শ্রেণির জন্য প্রযোজ্য শব্দ হয়েই থাকবে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ তার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়াসহ আরও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু যে ‘শ্রমিক’ আইন দ্বারা শ্রমিক হিসেবেই স্বীকৃত নয়, তার কী হবে?

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬–এর মাধ্যমে বিদ্যমান অনেক শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা আইন বাতিল করে একটি সমন্বিত আইন পাস করা হয়। এ আইনের আওতায় শ্রমিকেরা তাঁদের কর্মসংক্রান্ত বিভিন্ন অধিকার বাস্তবায়নের জন্য শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। শ্রমিকেরা যাতে সহজে প্রতিকার পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করার জন্য এই আইনে মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো কোর্ট ফি দিতে হয় না।

শ্রম আইন, ২০০৬ কার্যকর করার জন্য আরও বিশদ বিধানাবলিসহ বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। শ্রম আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগার এবং ক্ষেত্রবিশেষে রায় পাওয়ার পরও তা বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ বিলম্ব হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এ কারণে অনেক শ্রমিক তাঁদের অধিকার লঙ্ঘিত হলেও আইনের আশ্রয় নেন না।

কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো এই আইনের আওতার বাইরে। অথচ ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রায় ৮৪ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক শ্রম খাতের অবদান রয়েছে’ (বণিক বার্তা, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪)। আনুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন থাকলেও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের তেমন কিছু নেই। তাই তাঁদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম বঞ্চনা, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল উইমেন লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন বনাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ [(২০১১) ৩১ বিএলডি (এইচচিডি) ২৬৫] মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ আক্ষেপ প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে গৃহকর্মীরা শ্রম আইন, ২০০৬–এ ‘শ্রমিক’-এর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত নন। আদালত মত প্রকাশ করেন, এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে দেওয়া উচিত নয়। গার্হস্থ্য খাতে কর্মরত ব্যক্তিরা দিনের পর দিন সেবা প্রদান করছেন, অথচ তাঁদের শ্রম আইন কোনো স্বীকৃতি দেয়নি, এটি দুর্ভাগ্যজনক।

গৃহশ্রমিকদের মতো অন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদেরও শ্রম আইনের আওতায় আনার সময় এসেছে। কেউ কেউ বলতে পারেন, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের যদি তাঁদের নিয়োগকারীর সঙ্গে কোনো চুক্তি থাকে, তাহলে তাঁরা দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এ খাতে সাধারণত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি থাকে না। তাই তাঁদের নিয়োগকারীর দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘিত হলে প্রতিকার পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, যেখানে শ্রম আদালতেই অনেক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়, সেখানে অনানুষ্ঠানিক খাতকে এই আইনের আওতায় আনলে মামলাজট আরও বাড়বে। এ আশঙ্কা অমূলক নয়। কিন্তু শ্রম আদালতে আরও বিনিয়োগ বাড়িয়ে এবং ডিজিটাল কেস ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা চালু করে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

এখনই সময় এসেছে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের শ্রম আইন, ২০০৬–এর আওতায় নিয়ে আসার। যত দিন তা সম্ভব না হয়, তত দিন অন্তত স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কিছু তদারকির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের জন্য নিয়োগপত্র বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এ–জাতীয় ব্যবস্থা বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত করা উচিত।

কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘আইন তৈরি হয় সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্য।’ বাংলাদেশ অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের আইনের আওতার বাইরে রেখে এ কথাকেই সমর্থন করছে। শ্রম আইন নিয়ে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখন জরুরি। শ্রমিকেরা করুণার পাত্র নন; তাঁদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। শ্রমিকদের ছাড়া অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়বে। তাই অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদ্যোগ নিতে আর কালবিলম্ব নয়।

ড.

ইশরাত জাকিয়া সুলতানা, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

মো. রিজওয়ানুল ইসলাম অধ্যাপক, আইন বিভাগ ও ডিন, স্কুল অব হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আইন র আওত য় র জন য সরক র বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের হাই অ্যালার্ট

পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সাথে চলমান উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে হাই অ্যালার্ট জারি করেছে ভারত। বৃহস্পতিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে এ তথ্য জানিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমটি দাবি করেছে, “ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্মকাণ্ড এবং সেখানে পাকিস্তানের আইএসআই ও পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সীমান্তে সংস্থাগুলোকে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পাকিস্তান তার বাংলাদেশি প্রতিপক্ষদের সাথে সাথে সেখানকার উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলির সাথে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছে। দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা শুরু হলে ভারতের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পাকিস্তান সম্ভবত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় সমর্থনকারী এই উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করতে পারে।”

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের প্রতি বৈরী মনোভাব প্রকাশ করছে ভারত। দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ নিয়ে নিয়মিতভাবে ভুয়া নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করছে। এর পাশাপাশি ভারতে ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নেতারা বাংলাদেশের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছেন।

ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে দাঙ্গার পর ভারতীয় সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সীমান্তের পরিস্থিতি সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মুর্শিদাবাদ জেলায় সহিংসতায় তিনজন নিহত এবং শত শত আহত হয়। 

প্রসঙ্গত, ২২ এপ্রিল ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে সন্ত্রাসী হামলায় ২২ জন নিহত হন। এ ঘটনার জন্য কোনো প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছে ভারত। গত কয়েক দিন ধরেই দুই দেশের সীমান্তে গুলি বিনিময় হচ্ছে। বুধবার পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে, ভারত আগামী ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে পারে।

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ