আমার শৈশব আর কৈশোরের একটা বড় অংশজুড়ে ছিলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। ছোটবেলায় নজরুলের গান কেন জানি খুব একটা পাওয়া যেত না। ‘সঞ্চিতা’ ছিল, সেখান থেকে কবিতা পড়তাম কখনো কখনো। আর ছিল কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তির ক্যাসেট। বাবা আর আমি দুজনে মিলে সেই ক্যাসেট যে কতবার শুনেছি আর আবেগে ভেসেছি, তার ইয়ত্তা নেই। সেখানে নজরুলের কয়েকটি প্রবন্ধ আর অভিবাসনের অংশবিশেষ পাঠ ছিল। মনে খুব দাগ কেটে গিয়েছিল সেটি।

‘যেদিন আমি চলে যাব—সেদিন হয়তো বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা হয়তো বেরোবে আমার নামে। দেশ-প্রেমিক, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী বিশ্লেষণের পর বিশেষণ! টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে, বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশপাশে যদি একটি ঝরা-পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো—বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি—’

মিথ্যা হয়নি তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই তা ‘অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদন’ হয়েই থেকে গেছে। কিন্তু গত বর্ষায় যেভাবে নজরুল ফিরে এসেছেন তারুণ্যের কণ্ঠের শক্তি হয়ে, তাতে মনে হয় সবার বাঁচার মাঝে বেঁচে থাকার নজরুলের আকুতি বৃথা যায়নি। নজরুলকে বুকে ধারণ করেই এ দেশের সন্তানেরা বুকের রক্ত ঝরিয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে।

নজরুলের জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না মোটেই। কখনো কাফের, কখনো যবন, হেন অপবাদ নেই, যা তাঁকে সহ্য করতে হয়নি। সাপ্তাহিক সাহিত্য সাময়িকী ‘শনিবারের চিঠি’তে গালির দাপট এতটাই বেড়েছিল যে নজরুল নিজেকে বলেছিলেন সে ‘গালির গালিচায় শানেশাহ্‌’। কখনো আক্রমণ এসেছে খোদ রবীন্দ্রনাথের তরফ থেকে, আরবি–ফারসি শব্দের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে। তার উত্তর নজরুল দিয়েছেন ‘বড়র পিরিতি বালির বাঁধ’ প্রবন্ধে। কখনো আবার আক্রমণ এসেছে মুসলিম সমাজের তরফ থেকে, শ্যামাসংগীত লেখা কিংবা কবিতায় হিন্দু পুরানের ব্যবহারের কারণে। আশালতা সেনগুপ্ত বা প্রমীলা নজরুলের সঙ্গে বিয়ে ঘিরে হিন্দু-মুসলিম দুই সমাজেরই আক্রমণের শিকার হন তিনি। এই নানামুখী আক্রমণের জবাব তিনি দিয়েছেন ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায়। কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে এর চমৎকার আবৃত্তি এখন দুর্লভ নয়।

গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম—কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’

জুলাই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় শক্তি এ দেশের সব মানুষকে এক কাতারে আনা। হিন্দু-মুসলিম, পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে। সে কারণেই বোধ করি এই একতাবদ্ধ প্রজন্মের কাছে এতটা আবেদন রাখতে পেরেছেন নজরুল।

বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!

এই বিভেদ আর হানাহানি আপনিই হচ্ছে এমনটা নয়। এর পেছনে আছে নানা রহম মদদ, বিপুল অর্থের লগ্নি। কিন্তু এই সব কিছুর চেয়ে কি প্রেম বড় নয়? যে প্রেম সবাইকে এক করেছিল গত বর্ষায়? বসন্ত ফুরিয়ে এল, তার মাঝেই বর্ষা বিপ্লবের পর প্রথম ঈদ।

গত বর্ষায় আমরা তো দেখে–শুনে–খেপে গিয়েই রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলাম! সে সময় হয়তো দূরাগত কোনো স্বপ্নের কথা অনেকেরই মাথায় আসেনি। পরের দিন বেঁচে থাকব কি না, সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন। বেঁচে থাকতে হলে শেখ হাসিনাকে বিদায় করতে হবে। এ ছাড়া কোনো কিছু ভাবার অবসর সে সময় ছিল না।

৫ আগস্ট অসম্ভবকে সম্ভব করল এ দেশের কোটি জনতা। আমরা পেলাম নতুন দেশ গড়ার সুযোগ। সব বাধা-ব্যবধান ঘুচে গেল যেন। মাস পেরোনোর আগেই এল সর্বপ্লাবী বন্যা। বিপুল উদ্যমে নিবিড় ঐক্যের বন্ধনে প্রকৃতিকেও রুখে দিল এ দেশের মানুষ। গল্পটা এভাবেই চললে ভালো হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে নানা মত ও পথের মানুষ স্বৈরাচার খেদানোর আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন, তাদের স্বপ্নের দেশের রূপটা একরকম নয়।

তাই শুরু হলো নিরন্তর কাদা–ছোড়াছুড়ি। অভ্যুত্থানের চেনা মুখগুলোকে একে একে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চলতে লাগল নানা মিথ্যা প্রচারণা। স্বপ্নটা ছিল দেশের সব নাগরিকের জন্য ন্যূনতম কিছু অধিকার প্রতিষ্ঠা করার, দেশের ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারও দাঁড় করানোর। কিন্তু সময় গড়াতে বড় হয়ে দাঁড়াল ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-জাতিগত নানা প্রশ্ন। পাহাড়ে আদিবাসীদের ওপর হামলা হলো, বিভিন্ন মাজার ভাঙার ঘটনা এখনো থেমে নেই। যে নারীর অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব ছাড়া কোনোভাবেই জুলাই অভ্যুত্থান সফল হতো না, তাদের অধিকারের প্রশ্নেও নানা বাধা দেওয়া হলো।

এ কথা সত্য যে এ সমস্যার কোনোটিই আমাদের সমাজে নতুন নয়। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরাচারের বিরামহীন নিষ্পেষণে এসব প্রশ্ন আর বিতর্ক হয়তো চাপা পড়ে গিয়েছিল। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন গোষ্ঠী যার যার অবস্থান থেকে এই বিতর্কগুলো সামনে আনছে। বিতর্ক সমাজে থাকবে, কিন্তু বিষয়গুলো তিক্ততা আর নোংরামিতে গড়াচ্ছে একজনের মতবাদ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে।

নজরুল জীবনভর পরমত সহিষ্ণুতার, সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার চর্চা করে গেছেন। সে কারণেই তাঁর লেখায় সব আদের্শের উদার দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। ‘ক্ষমা কর হযরত’ কবিতাতে ইসলামের উদারতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন নজরুল:

তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি করে
আপনি তাদের করিয়াছো সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।
ভিন-ধর্মীয় পূজা মন্দির
ভাঙ্গিতে আদেশ দাওনি হে বীর,
আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারিনাকো পর-মত।
ক্ষমা করো হযরত।।

একই মিলনের বাণী শোনা যায় হিন্দুধর্মের কাঠামোতে আধারিত এই গানটিতে:
এবার নবীন-মন্ত্রে হবে জননী তোর উদ্বোধন।
নিত্যা হয়ে রইবি ঘরে, হবে না তোর বিসর্জন॥
সকল জাতির পুরুষ-নারীর প্রাণ
সেই হবে তোর পূজা-বেদী মা তোর পীঠস্থান;
সেথা শক্তি দিয়ে ভক্তি দিয়ে পাতবো মা তোর সিংহাসন॥
সেথা রইবে নাকো ছোঁয়াছুঁয়ি উচ্চ-নীচের ভেদ,
সবাই মিলে উচ্চারিব মাতৃ-নামের বেদ।
মোরা এক জননীর সন্তান সব জানি,
ভাঙব দেয়াল, ভুল্‌ব হানাহানি
দীন-দরিদ্র রইবে না কেউ সমান হবে সর্বজন,
বিশ্ব হবে মহাভারত, নিত্য-প্রেমের বৃন্দাবন॥

এই দেয়াল ভেঙে, হানাহানি ভুলে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্নের কথা দেয়ালে আঁকা অপূর্ব গ্রাফিতিগুলো থেকে এখনো মুছে যায়নি। সেখানে এখনো লেখা আছে, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!’ এই কবিতারই শেষের অংশটা আজকে সবারই মনে রাখা প্রয়োজন:
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান—
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান!
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ,
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কাণ্ডারি হুঁশিয়ার॥

সাঈদ-মুগ্ধ-রিয়ারা কিন্তু অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের জীবনের বিনিময়ে মুক্ত হাওয়ায় দম নিতে পারা এ দেশের মানুষগুলোকে। আজকের পরীক্ষা, আমরা কোনটাকে বেছে নেব, শুধু নিজের জাত বা গোত্রের স্বার্থ, নাকি গোটা জাতির? ন্যূনতম কিছু প্রশ্নে আমরা এখনো এক হতে পারি, থাকতে পারি। আর আমাদের ‘হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন’ হয়ে ওঠে, তাহলে আখেরে লাভ আমাদের কারও হবে না, হবে সীমান্তপারে ওত পেতে বসে থাকা কারও।

এই বিভেদ আর হানাহানি আপনিই হচ্ছে এমনটা নয়। এর পেছনে আছে নানা রহম মদদ, বিপুল অর্থের লগ্নি। কিন্তু এই সব কিছুর চেয়ে কি প্রেম বড় নয়? যে প্রেম সবাইকে এক করেছিল গত বর্ষায়? বসন্ত ফুরিয়ে এল, তার মাঝেই বর্ষা বিপ্লবের পর প্রথম ঈদ। ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটির পাশাপাশি নজরুলের আরেকটি গানও হয়তো এবার প্রাসঙ্গিক:

এলো আবার ঈদ ফিরে এলো আবার ঈদ, চলো ঈদগাহে।
যাহার আশায় চোখে মোদের ছিল না রে নিদ, চলো ঈদ্গাহে।।
শিয়া সুন্নী, লা-মজহাবী একই জামাতে
এই ঈদ মোবারকে মিলিবে এক সাথে,
ভাই পাবে ভাইকে বুকে, হাত মিলাবে হাতে;
আজ এক আকাশের নীচে মোদের একই সে মসজিদ, চলো ঈদগাহে।।

ভাই যেন ভাইকে বুকে পায়, হাতে যেন হাত মেলে, সেই আশাতেই বুক বাঁধছি। ঈদ মোবারক!

মানজুর-আল-মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নজর ল র

এছাড়াও পড়ুন:

পবিত্র কোরআনে ‘রুকু’ কীভাবে এল

আমরা কোরআন তিলাওয়াত করার সময় প্রতিটি সুরার শুরুতেই আয়াত সংখ্যার সঙ্গে ‘রুকু’ সংখ্যাও লেখা দেখি। পৃষ্ঠার মাঝেও রুকু লেখা থাকে। এই রুকু মানে কী? কী কাজ এই রুকুর?

এই প্রবন্ধে রুকুর ধারণা, কোরআন তিলাওয়াতের সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং কোরআনে রুকুর সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হলো।

রুকু কী

রুকু আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘নমন’ বা ‘বাঁকানো’। নামাজে রুকু বলতে কোমর ঝুঁকিয়ে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অঙ্গভঙ্গিকে বোঝায়।

তবে কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে রুকু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকলনকে বোঝায়, যা তিলাওয়াতকে সংগঠিত ও সহজতর করে। এটি বিশেষ করে হাফেজদের (যাঁরা কোরআন মুখস্থ করেন) জন্য সুবিধাজনক।

ইমাম সারাখসি (মৃ. ৪৮৩ হি.) রুকুকে রাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বলেছেন, এক রাকাতে তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকেত হিসেবে রুকু ব্যবহৃত হতো।কোরআন তিলাওয়াতে রুকুর ভূমিকা

রুকু নির্ধারণের উদ্দেশ্য ছিল তিলাওয়াতের সময় আয়াতের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং বিরতি নেওয়ার সুবিধা প্রদান। ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে হাফেজরা তিলাওয়াতের পর নির্দিষ্ট আয়াতে এসে রুকুতে যেতেন, যা এই প্রথার উৎপত্তির ইঙ্গিত দেয়।

ঐতিহাসিকভাবে রুকু নির্ধারণের প্রথা মা-ওয়ারাউন্নাহার (বুখারা, সমরখন্দ) অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এটি তারাবিহ নামাজের সময় কোরআন তিলাওয়াতকে সংগঠিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।

ইমাম সারাখসি (মৃ. ৪৮৩ হি.) রুকুকে রাকাতের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বলেছেন, এক রাকাতে তিলাওয়াতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াতের সংকেত হিসেবে রুকু ব্যবহৃত হতো। অন্য একটি মত অনুসারে, হাফেজরা নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াতের পর রুকুতে যাওয়ার কারণে এই নামকরণ হয়েছে। (আল-সারাখসি, আল-মাবসুত, বৈরুত: দার আল-মা’রিফা)

আরও পড়ুনধীরে ধীরে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণ৩০ মে ২০২৫কোরআনে রুকুর সংখ্যা

কোরআনে রুকুর সংখ্যা বিভিন্ন অঞ্চলে ও ঐতিহ্য অনুসারে ভিন্নতা দেখায়। প্রধানত তিনটি ধারা প্রচলিত: ৫৫৮, ৫৪০ ও ৪৮০।

৫৫৮ রুকু: বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসহাফে সাধারণত ৫৫৮টি রুকু ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি সুরায় রুকুর সংখ্যা উল্লেখ থাকে এবং আরবি অক্ষর ‘আইন’ দিয়ে রুকু চিহ্নিত করা হয়। এই চিহ্নে তিনটি সংখ্যা থাকে:

 ১. ওপরের সংখ্যা: সুরার মধ্যে রুকুর ক্রম।

 ২. মাঝের সংখ্যা: রুকুর আয়াতসংখ্যা।

 ৩. নিচের সংখ্যা: পারার (জুজ) মধ্যে রুকুর ক্রম।

 এই পদ্ধতি তিলাওয়াতকে সুসংগঠিত করে এবং হাফেজদের জন্য সুবিধাজনক। (সিদ্দিকি, এ, ২০১৭, কোরআনিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস অ্যান্ড দেয়ার ডিভিশনস, জার্নাল অব ইসলামিক স্টাডিজ, ২৮(২), (১৪৫-১৬৭)

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসহাফে সাধারণত ৫৫৮টি রুকু ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি সুরায় রুকুর সংখ্যা উল্লেখ থাকে এবং আরবি অক্ষর ‘আইন’ দিয়ে রুকু চিহ্নিত করা হয়।

৫৪০ রুকু: বুখারায় প্রথম রুকু নির্ধারণের সময় এর সংখ্যা ছিল ৫৪০। বুখারার মাশায়েখরা রমজানে তারাবিহ নামাজে প্রতি রাকাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াতের প্রথা অনুসরণ করতেন। এভাবে ৩০ দিনে কোরআনের প্রায় ৬ হাজার আয়াত তিলাওয়াত হতো। তবে দশ আয়াতের ভিত্তিতে তিলাওয়াত করলে বিষয়বস্তুর মাঝখানে বিরতি পড়ত, তাই তারা বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুকু নির্ধারণ করেন। (রহিম বখশ, আল-খাত্ত আল-উসমানি ফি রাসমিল কোরআন, লাহোর: মাকতাবা কুদ্দুসিয়া, ১৯৮২)

৪৮০ রুকু: সিন্ধুর হাশিম থাট্টুভি কোরআনের রুকুসংখ্যা ৪৮০ নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি সুরাভিত্তিক নয়, বরং পারাভিত্তিক রুকু নির্ধারণ করেন। প্রতি পারায় ১৬টি রুকু ধরে ৩০ পারায় মোট ৪৮০ রুকু হয়।

তিনি ‘রুকু’ শব্দের পরিবর্তে ‘মাকরা’ বা ‘মাকারি’ শব্দ প্রস্তাব করেন, যা ‘কিরআত’ (পাঠ্যাংশ) থেকে উদ্ভূত। (আজমি, এম এম, ২০০৩, দ্য হিস্ট্রি অব দ্য কোরআনিক টেক্সট: ফ্রম রেভল্যুশন টু কম্পাইলেশন, যুক্তরাজ্য: আল-কোরআন সোসাইটি)

আরও পড়ুনসহজে কোরআন বোঝার পাঁচটি কৌশল০৩ মে ২০২৫রুকুর প্রচলন

হিজাজ, আন্দালুসিয়া, মিসর, আফ্রিকা ও সিরিয়ায় রুকুর প্রচলন তেমন ছিল না। রুকুর প্রচলন মূলত মা-ওয়ারাউন্নাহার (বুখারা, সমরখন্দ), ভারতবর্ষ ও তুরস্কে ব্যাপক ছিল। ওসমানি খেলাফতের পর তুরস্কে এটা বিলুপ্ত হয়ে, তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এখনো রুকুর প্রচলন আছে।

বুখারার মাশায়েখরা রমজানে তারাবিহ নামাজে প্রতি রাকাতে ১০টি আয়াত তিলাওয়াতের প্রথা অনুসরণ করতেন। তবে এভাবে তিলাওয়াত করলে বিষয়বস্তুর মাঝখানে বিরতি পড়ত, তাই তারা বিষয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুকু নির্ধারণ করেন।

ইমাম দানি (মৃ. ৪৪৪ হি.) তাঁর গ্রন্থ আল-বায়ান ফি আদ্দি আয়িল কোরআন-এ কোরআনের বিভিন্ন ভাগ নিয়ে আলোচনা করলেও রুকু নিয়ে বিস্তারিত বলেননি। তবে ইমাম সারাখসি এবং রহিম বখশ তাঁদের লেখায় রুকুর ঐতিহাসিক বিবরণ দিয়েছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে সাহাবিরা ১০টি আয়াত করে মুখস্থ করতেন এবং এর ব্যাখ্যা বুঝে পরবর্তী আয়াত শিখতেন, যা রুকু নির্ধারণের প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। (আল-দানি, আল-বায়ান ফি আদ্দি আয়িল কুরআন, কায়রো: দার আল-মা’আরিফ)

সারকথা, রুকু কোরআন তিলাওয়াতকে সহজ ও সংগঠিত করে, বিশেষ করে হাফেজদের জন্য। এটি ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে প্রচলিত একটি পদ্ধতি, যা বুখারা, সমরখন্দ ও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। ৫৫৮, ৫৪০ ও ৪৮০ রুকুর ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হলেও বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ৫৫৮ রুকুই বেশি ব্যবহৃত হয়।

লেখক: খণ্ডকালীন শিক্ষক, আরবি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুনযে ঘটনায় কোরআনে পূর্ণ দুটি রুকু নাজিল হয়১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ