গণপরিষদের বদলে সংস্কার বাস্তবায়নে সময়সীমা
Published: 19th, April 2025 GMT
সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছে– সংসদ নির্বাচন আয়োজনের আগে কি একটি সাংবিধানিক গণপরিষদ প্রয়োজন? অনেক গণপরিষদপন্থির মতে, নিয়মিত নির্বাচনী রাজনীতির আগে রাষ্ট্র ও সংবিধানের মৌলিক রূপান্তর অপরিহার্য। তবে সমালোচকেরা এতে একটি কূটাভাস খুঁজে পান– যদি বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে অসাধারণ গণতান্ত্রিক বৈধতা অর্জন করে থাকে, তাহলে সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য আলাদা ম্যান্ডেটের প্রয়োজনীয়তা কি অপ্রাসঙ্গিক নয়? এই প্রশ্নটি ‘বৈধতা’ ধারণাকে ঘিরে একটি গভীরতর বিশ্লেষণের দ্বার উন্মোচন করে।
গণপরিষদপন্থিদের মতে, ইউনূস সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ হিসেবে আখ্যায়িত করা অনুচিত। তাদের দাবি, এই সরকার একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটিয়ে একটি বিস্তৃত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। জনগণের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই বৈধতা একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটের প্রতিফলন, যা প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থায় অর্জিত যেকোনো ম্যান্ডেটের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য ও বলিষ্ঠ।
এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ভিত্তিও রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য-পরবর্তী সময়ে, তিউনিসিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের পরে এবং নেপালে রাজতন্ত্রের পতনের পর নির্বাচন ছাড়াই সরকার বৈধতা লাভ করেছে। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা গঠিত হয়েছে কেবল নির্বাচনী চক্রের মাধ্যমে নয়, বরং একটি সামষ্টিক বিপর্যয় এবং নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের সদিচ্ছা থেকে।
তবে এই বৈধতাকে স্বীকৃতি দিলেও, সাংবিধানিক গণপরিষদের দাবি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। যদি বর্তমান সরকারের গণভিত্তি সাম্প্রতিককালের যেকোনো নির্বাচিত সরকারের তুলনায় অধিক শক্তিশালী হয়, তাহলে নতুন করে কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছাড়া তাদের ওপর সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব অর্পণ করাটা কি যুক্তিসংগত নয়?
অনেকের কাছে এটি এক ধরনের বৈপরীত্য বলে প্রতিভাত হতে পারে– একদিকে শ্রেয়তর বৈধতার দাবি, অন্যদিকে সেই বৈধতা প্রমাণে একটি নতুন প্রক্রিয়াগত কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা। তবে গণতান্ত্রিক ও প্রক্রিয়াগত বৈধতার মধ্যে পার্থক্য বিবেচনায় আনলে এ আপাত বিরোধ সহজে প্রশমিত হতে পারে।
গণতান্ত্রিক বৈধতা একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে শাসনের নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করে, বিশেষত গণঅভ্যুত্থানের মতো ব্যতিক্রমী প্রেক্ষাপটে। তবে সংবিধান পুনর্লিখনের মতো মৌলিক সংস্কার কেবল নৈতিক বৈধতার ভিত্তিতে সম্ভব নয়; এর জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক পরিসরের সর্বস্তরের সম্মতি। এখানে পদ্ধতিগত বৈধতার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি নিশ্চিত করে যে গণপরিষদপন্থি সমর্থক থেকে শুরু করে সমালোচক পর্যন্ত সমাজের সকল অংশ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে, যার মাধ্যমে সকলের জন্য প্রযোজ্য শাসনব্যবস্থার ভিত্তি নির্ধারিত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে, সাংবিধানিক গণপরিষদের দাবি বর্তমান সরকারের বৈধতাকে অস্বীকার নয়; বরং সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার একটি সচেতন ও গণতান্ত্রিক প্রয়াস। এটি সেই প্রবণতার প্রকাশ, যেখানে গণঅভ্যুত্থানের অসাধারণ শক্তিকে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামোয় রূপান্তর করার চেষ্টা করা হয়। সমালোচকেরা যাকে বৈপরীত্য হিসেবে দেখেন, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য হিসেবে প্রতিভাত হয়– একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি, অন্যদিকে নিশ্চিত করা যে সাংবিধানিক পরিবর্তন একটি সম্মিলিত মালিকানার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
তা সত্ত্বেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়– একটি নির্বাচিত সরকার কি একযোগে নিয়মিত শাসনকার্য পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ এবং সাংবিধানিক গণপরিষদের ভূমিকা পালন করতে পারে? বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর উত্তর হতে পারে স্পষ্টভাবে সদর্থক, যদি প্রক্রিয়াটি সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত, সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য এবং স্বচ্ছভাবে তদারকযোগ্য হয়।
এই উদ্দেশ্যে জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো হতে পারে একটি বাস্তবসম্মত পথ। সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনের প্রস্তাবগুলো যদি বিএনপি ও অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে এবং ব্যাপক সম্মতির ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা যায়, তবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে নির্দিষ্ট একটি সময়সীমার মধ্যে–ধরা যাক ছয় থেকে বারো মাস–এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি স্পষ্ট ম্যান্ডেট দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারের গণতান্ত্রিক বৈধতা কেবল নির্বাচনী বিজয়ের ওপর নয়, বরং এই সংস্কার রোডম্যাপ বাস্তবায়নের প্রতিও নির্ভর করবে। যদি সরকার এই লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার নৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব যথার্থভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, এবং সে পরিস্থিতিতে সরকারের পদত্যাগ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
যদি এই জাতীয় রাজনৈতিক সমঝোতা প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের দ্বারা অনুমোদিত হয়, তবে তা একটি নৈতিকভাবে বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তি হিসেবে কার্যকর হতে পারে। যদিও এটি কোনো সাংবিধানিক ধারার মতো আইনগতভাবে প্রয়োগযোগ্য নয়, তবুও এটি জনমত, গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থেকেও কার্যকর শক্তি অর্জন করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই সমঝোতার ভিত্তিতে গৃহীত সংস্কার ও নির্ধারিত বাস্তবায়ন সময়সীমা নিয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করতে পারে। একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা এই পুরো প্রক্রিয়ার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে এবং নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এর মাধ্যমে সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যাবে এবং গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুদৃঢ় হবে।
এ প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে শর্তসাপেক্ষ বৈধতার মডেল– যেখানে একটি নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্ব কেবল ব্যালট বাক্সে অর্জিত বিজয় থেকে নয়, বরং পূর্বঘোষিত সংস্কার এজেন্ডার কার্যকর বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির ওপরও নির্ভরশীল। এই মডেল কল্পনাপ্রসূত বা অভিনব কোনোটি নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা, তিউনিসিয়া এবং নেপাল প্রত্যেকেই তাদের রাজনৈতিক রূপান্তরের সময় এ ধরনের কাঠামোর বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করেছিল। এসব উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বৈধতা কেবল কারা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, তা দিয়ে নির্ধারিত হয় না; বরং নির্বাচনের পর তারা কী করার ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছে, সেটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, শর্তসাপেক্ষ বৈধতা একটি বাস্তবসম্মত পথ নির্দেশ করে, যা ভুল বিকল্পের ফাঁদ এড়িয়ে চলে। এটি যেমন সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করে না, তেমনি সংস্কার ম্যান্ডেট ছাড়া তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের দিকেও ধাবিত হয় না। এটি একদিকে জনগণের পরিবর্তনের আহ্বানে সাড়া দেয়, অন্যদিকে গণতন্ত্রে ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’ বলতে সাধারণত যা বোঝানো হয়, তার প্রতিও পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
এই প্রেক্ষাপটে, শর্তসাপেক্ষ বৈধতা কেবল একটি কৌশল নয়, বরং একটি বাস্তবভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাধান, যা একদিকে গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে সম্মান জানায়, অন্যদিকে সংস্কারকে সামষ্টিক সম্মতির ভিত্তিতে প্রোথিত করে। এর শক্তি নিহিত ‘নির্বাচন বনাম সংস্কার’ এই ক্লান্তিকর দ্বৈততার সুস্পষ্ট প্রত্যাখ্যানে। বাংলাদেশের প্রয়োজন উভয়ই– একটি নির্বাচন, যা জনগণের কণ্ঠকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে; এবং এমন একটি সংস্কার প্রক্রিয়া, যা নিশ্চিত করবে এই কণ্ঠ আর কখনও স্তব্ধ করা যাবে না। এই প্রেক্ষাপটে, একটি নির্বাচিত সরকারের শর্তসাপেক্ষ বৈধতা হতে পারে সেই কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য পথ, যা বহুল আলোচিত সাংবিধানিক গণপরিষদকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে সক্ষম।
ড.
huda@du.ac.bd।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন ন র ব চ ত সরক র গণঅভ য ত থ ন র গণত ন ত র ক ন শ চ ত কর র জন ত ক কর ত ত ব ক র যকর সরক র র জনগণ র এই প র র জন য একদ ক
এছাড়াও পড়ুন:
হামাস থেকে হিজবুল্লাহ: পরাজিত মিত্ররা কি খামেনির পতনের পূর্বাভাস?
ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান এই হামলা একটি ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহের সর্বশেষ রূপ, যার সূচনা হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে হামাসের ইসরায়েলে হামলার মাধ্যমে। প্রতিটি ধাপই একদিকে তেহরানকে ক্রমাগত দুর্বল করেছে এবং অন্যদিকে অন্তত সামরিকভাবে ইসরায়েলকে আরো শক্তিশালী করেছে। এই প্রতিটি ধাপ যদি না ঘটত, তাহলে শুক্রবার ইসরায়েলের সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে নতুন এই হামলা চালানো সম্ভব হতো কিনা, তা ভাবা কঠিন।
প্রথম ধাপ ছিল গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান। এই অভিযান রক্তক্ষয়ী এবং ব্যয়বহুল, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের জন্য। তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হামাস এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, তারা আর ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য তাৎক্ষণিক বড় কোনো হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়নি।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
আরো পড়ুন:
ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করলে কী কী ঘটতে পারে?
ইরানকে পরমাণু আলোচনার প্রস্তাব জার্মানি-ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের
হামাস মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ জোটের অংশ। এই জোট ইরান গত এক দশকে গড়ে তুলেছিল আঞ্চলিকভাবে নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য এবং ইসরায়েলকে তার পারমাণবিক কর্মসূচিতে হামলা চালাতে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে। ফলে হামাসকে দুর্বল করে দেওয়ার ঘটনাটির ব্যাপক আঞ্চলিক প্রভাব পড়ে, যার সুবিধা নিচ্ছে ইসরায়েল।
এরপর, গত বছরের এপ্রিলে ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাস কমপ্লেক্সে বোমা হামলা চালায়, যাতে সাতজন নিহত হন। এর জবাবে ইরান প্রথমবারের মতো সরাসরি ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়; যদিও সেটি ছিল অকার্যকর ড্রোন হামলা। এতদিন ধরে ছায়াযুদ্ধ, গুপ্তহত্যা এবং তৃতীয় পক্ষীয় হামলার মাধ্যমে চলা ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব এবার বড় আকারে প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ নিল।
শরতের দিকে, যখন হামাস অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন ইসরায়েল তাদের দৃষ্টি দেয় হিজবুল্লাহর দিকে। লেবাননভিত্তিক ও ইরান-সমর্থিত সংগঠন হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ বলে বিশ্বাস করা হয়।
সেপ্টেম্বরে হিজবুল্লাহর পুরো শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্মূল করে ইসরায়েল, সেই সঙ্গে তাদের ভয়ংকর মিসাইল ভাণ্ডারের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস করে দেয়। এরপর তারা লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে হেজবুল্লাহর ঘাঁটিতে অভিযান চালায়, যেখানে তারা বড় ধরনের কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়েনি। এমনকি হিজবুল্লাহ-সমর্থকরাও স্বীকার করে যে, তারা একটি বড় ধরনের পরাজয়ের শিকার হয়েছে।
পুনরায় ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরেকটি দুর্বল বিমান হামলা চালায়। ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বড় একটি অংশ ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে গত শুক্রবার ব্যাপক হামলার পথ সুগম হয়।
সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, হঠাৎ করে হিজবুল্লাহর দুর্বল হয়ে পড়া অর্থাৎ তারা সিরিয়ার বাশার-আল আসাদ সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি; যা ইরানের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। যখন বিদ্রোহীরা সেখানে আক্রমণ শুরু করে, হিজবুল্লাহ পাশে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে ডিসেম্বরে সিরিয়ার বাশারের পতনের মধ্য দিয়ে তেহরান-দামেস্কের বহু দশকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অবসান ঘটে। এর ফলে ইরান-সমর্থিত প্রতিরোধ জোট আরো ভেঙে পড়ে, সিরিয়ায় ইরানি মিলিশিয়ারা একা হয়ে পড়ে এবং ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের দুর্বল লক্ষ্যবস্তুতে সহজেই পৌঁছাতে পারে।
সিরিয়া ও ইরাকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা বুঝে ফেলে যে, মুখে মুখে ইসরায়েলকে আক্রমণের হুমকি দেওয়া আর বাস্তবে আক্রমণ করা এক নয়; এটি হবে ভুল পদক্ষেপ। ফলে প্রতিরোধ জোটের একমাত্র সদস্য হিসেবে ইয়েমেনের হুথিরাই ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় থেকে যায়। তারা লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বাধা দিতে থাকে, কিন্তু যেসব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তারা তেল আবিবের দিকে ছুড়ছিল, তা কোনো কৌশলগত ক্ষতি করতে সক্ষম হয়নি।
এই বছরের শুরুর বসন্তকাল নাগাদ, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি যখন দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের মিত্র মিলিশিয়াদের (প্রক্সিদের) ওপর ছেড়ে দেন, তখন সেটি একটি ভয়াবহ ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে হতে শুরু করে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সাময়িক সুযোগকে কাজে লাগাতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন এবং বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
এই অভিযান এপ্রিলের মধ্যে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সময়সীমা পেরিয়ে যায়। তবে এই সময়সীমা যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই নির্ধারিত ছিল না; এটি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্ধারিত ৬০ দিনের সময়সীমা; যার মধ্যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে তেহরানের সঙ্গে নতুন কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে হতো। ইসরায়েল দাবি করে আসছিল, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির একেবারে দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এই সময়সীমার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত সপ্তাহে।
শুক্রবার ইরানিদের উদ্দেশে নেতানিয়াহু বলেন, তিনি আশা করেন ইরানে ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযান তোমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম করবে।
ইসরায়েল হয়তো ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব-পূর্ব যুগে ফিরে যেতে চাইছে না, যখন ইরান ছিল ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবুও ইসরায়েলি পরিকল্পনাকারীরা যে লক্ষ্যমাত্রা বেছে নিয়েছেন, তা বিপ্লব-পরবর্তী যে শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেবে, সেটিকে কার্যত ভেঙে দিতে পারে।
এর একটি বড় কারণ হলো, আজো ইরানের নেতৃত্বে সেই প্রজন্মের মানুষরাই রয়েছেন, যারা ইরানের শাহ পতনের পরপরই অথবা তারও আগে তাদের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন।
শুক্রবারের প্রথম হামলায় নিহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ইরানের ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর প্রবীণ কর্মকর্তা, যারা ১৯৮০ সালে গঠিত এই বাহিনীর প্রথম দিককার সদস্য ছিলেন। এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল কট্টরপন্থি ধর্মীয় নেতাদের নতুন শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য এবং পরে এটি ইরানের বিপ্লবী আদর্শের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। নিহতদের অনেকেই ছিলেন ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞ যোদ্ধা, যে যুদ্ধকে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন বর্তমান শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি।
প্রথম ধাক্কায় নিহতদের মধ্যে একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানীও ছিলেন, যিনি রক্ষী বাহিনীর সদস্য ছিলেন। আঘাতের লক্ষ্য হওয়া আরেকজন হলেন আলী শামখানি, যিনি খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনি ছিলেন ১৯৭০-এর দশকে তৎকালীন শাহবিরোধী ইসলামী আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ গোপন কর্মী। পরে তিনি একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। খামেনি নিজেও ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির উত্তরসূরি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন, তবে তার ইসলামী আন্দোলনের পথচলা শুরু হয় আরো আগে, ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে।
এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইরান যে আবার ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রে পরিণত হবে, তা খুবই অসম্ভব। তবে যা প্রায় নিশ্চিত মনে হচ্ছে, তা হলো যেসব পুরনো নেতা শাহকে উৎখাত করেছিলেন এবং গত চার দশক ধরে বিপ্লবী শাসনব্যবস্থার নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তাদের ক্ষমতা এবার মারাত্মকভাবে, হয়তো চিরতরের জন্যই দুর্বল হয়ে পড়বে।
জেসন বার্ক দ্য গার্ডিয়ানের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক সংবাদদাতা।
[লেখক পরিচিতি: জেসন বার্ক দ্য গার্ডিয়ানের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক সংবাদদাতা। গত ২৫ বছর ধরে একজন বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে তিনি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কভার করেছেন। তিনি ডজনখানেক সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন, পাশাপাশি আরো বহু বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি চারটি বইয়ের লেখক, যার মধ্যে সর্বশেষ বইটির নাম দি নিউ থ্রেট]
ঢাকা/রাসেল