অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে রাজনীতিকদের কী লাভ?
Published: 20th, April 2025 GMT
অবাক হওয়ার ব্যাপার– রাজনীতিকরা কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছেন! এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন ‘অনির্বাচিত’ আখ্যা দিচ্ছে। যদিও নাগরিকদের বড় অংশ এই সরকারের ওপরেই আস্থা রাখছে। নাগরিকদের ধারণা জন্মেছে, সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনায় আসবে, রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের ইচ্ছা বা সক্ষমতার ঘাটতি আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব প্রকট। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এর কারণ খোঁজায় খুব আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগবিহীন রাজনৈতিক পরিবেশে বর্তমানে বিএনপির ভালো অবস্থানে থাকার কথা। কিন্তু তারা দৃশ্যত চাপের মধ্যে। এমনকি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও মানুষের একচেটিয়া সমর্থন পাচ্ছে, বলা যাবে না। তার মানে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠী ছাড়া সাধারণ নাগরিকরা রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নাগরিকদের আস্থা ক্রমে বাড়ছে। এটা স্পষ্ট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর মানুষের আস্থা আরও বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে গুণগত সংস্কার আনতে না পারলে দলীয় কর্মী-সমর্থকের বাইরে সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন কমতে থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোতে এখনও সেকেলে ধাঁচের ব্যক্তি-তোষণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি চালু আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো অভ্যন্তরীণ সংস্কার। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। নেতাকর্মীর বক্তব্যে সুস্থ ধারার রাজনীতির ছাপ থাকতে হবে। তারা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কীভাবে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তা পরিষ্কার করে বলতে হবে। রাজনীতির প্যাটার্নই বদলাতে হবে।
বস্তুত পুরোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা এখনও নব্বই দশকের রাজনীতি করছেন। তাদের বয়ানের মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। তাদের বক্তব্য সচেতন নাগরিকরাও সেভাবে শুনছেন না। বিএনপি বা জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের রাষ্ট্র গঠন নিয়ে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাবনা শোনা যায় না। এমনকি বিএনপির ৩১ দফাও নিজ দলের মধ্যে আলোচনায় আসছে না সেভাবে। আবার সরকারের বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার প্রশ্নে অনেক জরুরি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারছে না। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাই বটে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই রাজনীতি কোনো আকর্ষণ তৈরি করছে না।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সবাই আশা করেছিল, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। সেটি আসেনি। সাধারণ মানুষ যে কারণে হতাশ। তারা এক রাজনৈতিক দলের বদলে আরেক রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি ও লুটপাট দেখতে চায় না। মানুষের মধ্যে নতুন চাওয়া তৈরি হয়েছে। তারা আর রাজনৈতিক হানাহানি, মারামারি দেখতে চায় না। তাই নাগরিকদের অনেকেই এখন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গঠিত সরকার বনাম অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে তুলনা করছে। এই তুলনা অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারাবাহিক ব্যর্থতারই ফল!
বিপরীত দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ, কথা, শরীরী-ভাষা, বিবৃতি, অফুরন্ত কর্মস্পৃহা মানুষের মধ্যে, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। বিশেষত বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
আমি প্রায় প্রতিদিন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলি। জনসাধারণের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে এত প্রাণহানির পর মানুষ আর পেশিশক্তিনির্ভর, সন্ত্রাসনির্ভর, চাঁদাবাজিনির্ভর রাজনীতি দেখতে চায় না। তারা সন্ত্রাসী, চাটুকার পরিবেষ্টিত রাজনীতিবিদদের গলাবাজি শুনতে চায় না। তারা দেখতে চায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, অর্থনীতিতে গতি, বাজারের স্থিতিশীল অবস্থা, ব্যাংকে লুটপাট বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা।
প্রথমদিকে স্থবিরতা থাকলেও অর্থনীতি আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে; বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার সঙ্গে যে কৌশলী কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাও গণমানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদদের উচিত ছিল পুরোনো রাজনীতি ঝেড়ে ফেলে নতুন রাজনীতির ক্যারিশমা দেখানো। কিন্তু সেই প্রজ্ঞা, সদিচ্ছা, প্রচেষ্টা দেখা যায়নি; টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করার ব্যাপারে কর্মস্পৃহা দেখা যায় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কি অনন্তকাল থাকবে? সেটা কেউ চাইবে না; জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই হবে। তার আগে রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে এবং শাসন ব্যবস্থায় জরুরি মৌলিক সংস্কার করতেই হবে। গণঅভ্যুত্থান সেই ম্যান্ডেট এই সরকারকে দিয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতিকদের নিজের কোয়ালিটি বাড়াতে হবে, যদি তারা টিকে থাকতে চান। দলের মধ্যে ইতিবাচক সংস্কার করতেই হবে। এখনও সেকেলে ধাঁচের রাজনীতি থেকে বের হতে না পারলে এবং জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ হয়ে কাজ না করলে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে না। আর অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বসে থেকে বিশেষ কোনো ফায়দা নেই।
শেখ নাহিদ নিয়াজী: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন র র জন ত সরক র র ন র ভর ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ড. ইউনূস অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেননি, আমাদের হাতে বিপ্লবের দলিল নেই: ফরহাদ মজহার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের ফসল কিন্তু নেতা নন বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার। ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করে তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শক্তি, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ এক হয়ে লড়েছিল। কিন্তু ড. ইউনুস আমাদের জুলাই ঘোষণাপত্র দেননি। এজন্য আমাদের হাতে বিপ্লবের কোনও দলিল নেই। ড. ইউনূস জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দিতে দেননি। এটা তিনি মহাভুল করেছেন। আগামী দিনে জনতাকে এর ফল ভোগ করতে হবে।
সোমবার বিকেল ৫টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। ‘গণঅভ্যুত্থান : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ শীর্ষক সভাটি আয়োজন করে সেন্টার ফর হেরিটেজ স্টাডিজ।
গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র না থাকায় আমরা দুর্বল হয়েছি উল্লেখ করে এই চিন্তক বলেন, এই অভ্যুত্থানের গণ অভিপ্রায় হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব। এর প্রথম ধাপ হবে সংবিধানে গণসার্বভৌমত্ব উল্লেখ করা। কিন্তু আমরা হাসিনার সংবিধানটাই ছুড়ে ফেলতে পারিনি। এর বদলে আমরা করেছি একটি সংস্কার কমিশন। এর নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা অভ্যুত্থান যারা ছিলেন না তারা। কমিশনগুলো জনগণের কাছে থেকে তাদের কথা শোনেনি। এতে আমরা ক্রমশ দুর্বল হয়েছি। ফলে, যারা আপনাদের অশান্তিতে রেখেছে আপনারা তাদের বিচার করতে পারবেন না। তাই গণ সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রে নতুন স্বাধীন গঠনতন্ত্র লাগবে।
জনগণের সার্বভৌমত্বকে মূল্যায়ন করে বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং নতুন সংবিধানে তিনটি বিষয় উল্লেখ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ৭২ সালের সংবিধান জনগণ করেনি। ৭১ এর ১০ এপ্রিলের ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার বাদ দিয়ে ‘সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ’সহ ৪টি মূলনীতি করা হয়েছিল। এই সংবিধানকে বাতিল করে জনতার অভিপ্রায়ের নতুন গঠনতন্ত্র চাই। জনতার অভিপ্রায়ের জন্য ৩টি বিষয় সংবিধানে উল্লেখ করতে হবে।
দাবি তিনটি হলো- প্রথমত, রাষ্ট্র এমন কোন আইন বা নীতি করতে পারবে না যাতে ব্যক্তির অধিকার হরণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র এমন কোন আইন বা নীতি করতে পারবে না যাতে প্রাণ- প্রকৃতি- পরিবেশ ধ্বংস হয়। তৃতীয়ত, রাষ্ট্র এমন কোনো আইন বা নীতি গ্রহণ করতে পারবে না যাতে জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হয়।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সেখানে ধর্মের প্রসঙ্গে চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার বলেন, আমরা আধুনিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে ইসলামের খোঁজ করি। আধুনিক রাষ্ট্র ক্যাপিটাল দিয়ে চলে। আমরা সারাক্ষণ ক্যাপিটালের অধীনে থাকি। পুঁজিবাদের অধীনে থেকে ধর্ম প্রতিষ্ঠা হবে না। আগামী দিনের লড়াই হবে এই পুঁজির বিরুদ্ধে। এই লড়াইয়ে জাতীয়তাবাদে বিভক্ত করে আলাদা হওয়া যাবে না। কারণ দুনিয়াতে জাতীয়তাবাদের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। এই সময়ের লড়াই হবে সেটা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সেখানে কোনও জাতিবাদ থাকবে না।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থান বলতে আসলে কী বুঝায়, এটা আসলে আমাদের সমাজে পরিষ্কার ধারণা নেই। সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সামনের সাড়িতে অনেক মেয়ে ছিল, কিন্তু তারা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল? তারা আর রাজপথে নেই। কারণ, তারা রাজপথে আর নিরাপদবোধ করছে না। আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র আর সরকারের পার্থক্য স্পষ্ট না। ফলে দেশ সামনের দিকে এগোতে পারছে না।
দেশে স্টারলিংক আনার সমালোচনা করে লেখক ফরহাদ মজহার বলেন, ড. ইউনুস স্টারলিংক দেশে এনেছেন। এতে কী লাভ হবে? আপনার নিরাপত্তা, আপনার সিকিউরিটি কোনও কিছুই আর আপনার থাকবে না। সবকিছু ইলন মাস্ক জানবে। আর ইলন মাস্ককে জানেন তো? তিনি ট্রাম্পের সমর্থক। আর ট্রাম্প ইসলাম ঘৃণা করেন। উনি ঘোরতর ইসলামবিরোধী। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের কথা বলে ভাবছেন- আমি চাকরি পাবো! অনেক বেতন পাবো!
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসঊদ। উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আফরিনা আফরিনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকি।