‘জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা’ যে কারণে দরকার
Published: 21st, April 2025 GMT
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের একটি লেখা ‘কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের নামে এ কোন রাজনীতি’ পড়তে গিয়ে থমকে গেলাম। আমাদের শিক্ষাঙ্গনে যে নৈরাজ্য চলছে এবং যেসব নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, তার সঙ্গে লেখাপড়ার মানের উন্নতির কোনো সম্পর্ক নেই। সব আন্দোলন আনুষঙ্গিক বিষয়ে। এসব নিয়ে ক্লাস বয়কট হচ্ছে, রাস্তাঘাট বন্ধ হচ্ছে, হানাহানি–মারামারি হচ্ছে—সবই যেন নিয়মমাফিক ঘটছে।
কিন্তু এগুলোর জন্য চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারা? রাস্তা বন্ধ—পথচারী, গাড়িঘোড়া অন্য পথে যাবে; ভিসি চাকরি হারাবেন—আরেকটা চাকরি খুঁজে নেবেন; শিক্ষাঙ্গন কয়েক মাস বন্ধ থাকবে—সরকারি টাকাকড়ির আমদানি ঠিকমতো চলবে, সবাই বেতন পাবেন।
আসল ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরা এবং অবশ্যই আমাদের জাতি। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাদীক্ষা ও আগামী দিনের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবেন, মা–বাবাকে কষ্টের উপার্জন দিয়ে সন্তানকে হয়তো আরও এক সেমিস্টার বেশি পড়াতে হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই জাতি, যে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে অঢেল টাকা ঢালছে আশা নিয়ে—তরুণেরা সুশিক্ষিত হয়ে দেশের হাল ধরবে।
আমাদের দেশে স্কুল হতে চায় কলেজ, কলেজ হতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় হতে চায় স্বায়ত্তশাসন। কেউ নিজেকে নিয়ে খুশি নয়। এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাজনীতি চায় না, আরেকটা ক্লাসে তালা মারছে রাজনীতি করতে। যে যে কাজে আছেন, সবাই প্রমোশন চাচ্ছেন। দাবিদাওয়ার আগে কেউ ভাবেন না দাবিগুলো কতটুকু ন্যায্য বা তাঁদের দাবি মেটাতে গিয়ে অন্যদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে কি না কিংবা তাঁরা যে দাবি করেছেন, তার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কি না।
এই তো কদিন আগে ঢাকার একটা কলেজ ইউনিভার্সিটি হওয়ার জন্য তুমুল আন্দোলন করল, বনানী-মহাখালীর রাস্তা অবরুদ্ধ দিনের পর দিন। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি কলেজের মানের রেটিংয়ে তারা পড়ে রয়েছে অনেক পেছনে। নটর ডেম কলেজ, আদমজী কলেজ যদি কলেজ নাম নিয়ে থাকতে পারে, তাদের আপত্তি কেন? তাদের বলা যেত, তোমরা র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে এসো, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় হবে। কিন্তু কার কথা কে শুনবে?
আমাদের ঘরে দাবি, বাইরে দাবি, শুধু দাবি আর দাবি। বাসায় গিন্নির দাবি—কেনাকাটার টাকা বাড়াতে হবে, অফিস সহকর্মীর দাবি—সিনিয়রকে ডিঙিয়ে প্রমোশন দিতে হবে। ব্যক্তিগত দাবিগুলো নাহয় আলাপ–আলোচনা করে মিটমাট করা যাবে। কিন্তু গ্রুপ দাবি? সেগুলো তো ‘মব’ হয়ে তেড়ে আসে, সবকিছু বন্ধ করে দিচ্ছে। এগুলোকে কীভাবে সুশৃঙ্খল করা যাবে? সব দাবি যে অযৌক্তিক, তা নয়, অনেক দাবিদাওয়া আছে খুব ন্যায়সংগত। কিন্তু অসংগত, অর্ধসংগত দাবিদাওয়ার ভিড়ে ন্যায়সংগত দাবিগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যায় পুরো দেশ অচল হওয়ার আগে দাবিদাওযা নিয়ে সরকারকে নতুন কিছু ভাবতে হবে।
তাই আমি দাবি করছি, ‘জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা’ গঠন করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-আধা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাঁদের দাবিদাওয়া আছে, তাঁরা রাস্তায় নামার আগে বা কক্ষে তালা দেওয়ার আগে তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে এই সংস্থায় আসবেন এবং দাবি নিবন্ধন করবেন।
আরও পড়ুনদাবি মানেই কি সড়ক–রেল অবরোধ?০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এই সংস্থা দাবিগুলোকে যাচাই–বাছাই করে যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যাবে অন্যায্য বা অগ্রহণযোগ্য, সেগুলোর উত্থাপকদের কাউন্সেলিং বা যুক্তি দিয়ে বোঝাবেন। যেমন বেতন বাড়াতে হবে ২০০ শতাংশ—এ দাবি মানলে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবে। যেগুলো ন্যায্য দাবি সেগুলো নিয়ে নিষ্পত্তি সংস্থা উত্থাপকদের পক্ষ হয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে তদবির করবেন। আইন বিভাগ আইনগত দিক খতিয়ে দেখবে। আবার যেগুলোর মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ, সেগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করবে। প্রতিটা দাবির জন্য তিন থেকে ছয় মাস সময় নির্ধারণ করা হবে।
এভাবে সংস্থা দাবিকারীদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে দাবিগুলোর একটা সুবিবেচিত সুরাহার আশা জাগাতে পারে। যেকোনো ক্ষোভ ও অস্থিরতার প্রাথমিক সময়টা যদি আগেভাগে কিছুটা সামাল দেওয়া যায়, পরবর্তী প্রতিক্রিয়া আরও যুক্তিসংগত হবে। দাবিদাওয়া সংস্থার বাইরে গিয়ে কোনো দাবি মেটানোর বা দাবি নিয়ে আন্দোলন করার সুযোগ থাকবে না। সংস্থার নিষ্পত্তি পছন্দ না হলে দাবিকারীরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। স্বাধীন বিচারব্যাবস্থায় সবারই সমান অধিকার।
জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা গতানুগতিক অন্য সব সংস্থার মতো হবে না। এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষেরা, যেমন বিচারকাজে আমাদের দেশে এককালে জুড়ি প্রথা ছিল। প্রয়োজনে রাজনীতিবিদদের জড়িত করা যেতে পারে, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বিশৃঙ্খল দাবিদাওয়ার সংক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে। এ সংস্থা সরকারের অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে সব ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবে।জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা গতানুগতিক অন্য সব সংস্থার মতো হবে না। এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষেরা, যেমন বিচারকাজে আমাদের দেশে এককালে জুড়ি প্রথা ছিল। প্রয়োজনে রাজনীতিবিদদের জড়িত করা যেতে পারে, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বিশৃঙ্খল দাবিদাওয়ার সংক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে। এ সংস্থা সরকারের অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে সব ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবে।
এ সংস্থার প্রধান হবেন একজন ন্যায়পাল। তাঁর অধীন থাকবে—১.
একজন ন্যায়পাল নিয়োগ করে একটা অফিসে এক্ষুনি শুরু করে দেওয়া যায় এই সংস্থা। ন্যায়পালের অফিসসহ চার বিভাগে দুজন করে আটজন লোক দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। প্রচার করে বলে দেওয়া হোক, যেকোনো দাবি ছোট বা বড়, ন্যায্য বা অন্যায্য প্রথমে এ সংস্থায় জমা দিতে হবে, নতুবা কোনো দাবি কোনোভাবেই বিবেচনা করা হবে না। এ সংস্থা শুধু সংঘবদ্ধ দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবে। ব্যক্তিগত দাবির জন্য জনগণকে মন্ত্রণালয় বা থানায় যেতে হবে।
‘দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা’ সরকারের অন্যান্য সংস্থার মতো হবে না। এরা বসে বসে ফাইল আদান–প্রদানকারী লোক নিয়ে গঠিত হবে না। এরা হবে সংকট ব্যবস্থাপনা টিম, যারা জনগণকে সম্পৃক্ত করে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে যেকোনো সংকট তুঙ্গে ওঠার আগে তার সমাধানের চেষ্টা করবে।
সাধারণত দুই ধরনের দাবি নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়:
১. কর্মযোগ্য দাবি: এসব দাবি নিয়ে সরকার কিছু একটা করতে পারে। যেমন সরকারের চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা ৩৫ বছর করা, শহরের ভেতর ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে অনুমতি দেওয়া—এ রকমের। কিছু দাবি অনেক সময় সরকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নেয় সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, কোনো অনভিপ্রেত দাবি সরকারের মেনে নেওয়ার অর্থ, নতুন দাবির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। বয়সের দাবি ৩২ বছর মেনে নিলে ৩৮ বছরের দাবি আসতে কতক্ষণ?
২. অকর্মযোগ্য দাবি: সরকার কিছুই করতে পারছে না, এমন দাবি এগুলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন ছাত্রের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু নিয়ে তাঁর সহকর্মীরা ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ হন এবং অনেক ক্ষেত্রে তুমুল আন্দোলন করেন। ফলে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় দিনের পর দিন। সহপাঠীকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। শোকসন্তপ্ত ছাত্রদের বোঝাতে এবং বুঝতে সাহায্য করতে হবে কাউন্সেলিং করে। বিদেশে মানুষকে শান্ত রাখার জন্য কাউসেলিংকে একটা উপযুক্ত হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশে কেন করা যাবে না? যেকোনো শোক-ক্রোধ ও হাঙ্গামা প্রথমে শুরু হয় খুব অল্পসংখ্যক লোক থেকে। তাঁদের শান্ত করতে পারলে বড় সংকট এড়ানো যেতে পারে।
দাবি যে কখন কোত্থেকে আসবে, সেটা অনুমান করে লাভ নেই। দাবি আসতে পারে ছাত্রদের থেকে, আবার ঢাকা কলেজের দাবির সঙ্গে সিটি কলেজ বা আদর্শ কলেজের দাবির সংঘর্ষ থাকতে পারে। দাবি আসতে পারে পোশাককর্মীদের থেকে, রিকশাচালকদের কাছ থেকে বা বাসমালিক সমিতি থেকে। তবে আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ যাঁরা কৃষক, তাঁরা কোনো দাবি জানাবে না অথবা গ্রামের মানুষ তাঁদেরও তেমন কোনো দাবি নেই।
দাবি আসতে পারে আমাদের রাজনীতিবিদদের থেকে, তাঁরা অধৈর্য হলে আরও বিপদ বাড়তে পারে। তাঁরাও মিছিল, হরতাল করে দাবি জানাতে পারেন। তবে রাজনৈতিক দাবিগুলো রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করতে হবে।
মানুষের আকাঙ্ক্ষা থেকেই দাবিদাওয়ার সৃষ্টি হয়। এ দেশে আমরা যদি আমাদের দাবিগুলো একটা সুশৃঙ্খল পদ্ধতির মাধ্যমে মীমাংসা করতে পারি, আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
আমরা যদি সুশৃঙ্খলভাবে আমাদের বড় বড় জাতীয় আকাঙ্ক্ষাগুলোকে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করতে পারি, তাহলে জনগোষ্ঠীর ছোট ছোট আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। জনগণকেও বোঝাতে এবং বুঝতে হবে—কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক, কোনটা স্বাধীনতা কোনটা অপস্বাধীনতা এবং কোনটা অধিকার আর কোনটা অনধিকার।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র দ শ ক জ করব সরক র র গত দ ব র জন য র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
কালো পতাকার মানুষ
সব গমনাগমনে কি তৈরি পথ লাগে! আলো, হাওয়া, শব্দ নিজেরা পথ তৈরি করে ছুটে চলে দিগ্বিদিক, যাদের ধরার তারা ধরে ফেলে। শব্দ আসার সম্ভাব্য ক্ষীণ পথগুলো কাপড়ের টুকরা বা কাগজের দলা দিয়ে বন্ধ করতে থাকেন ‘আম্মা’। বিছানায় ছেলেমেয়েরা ঘুমাচ্ছে। ওরা এভাবে গাদাগাদি করে শুতে অভ্যস্ত নয়। বড় ছেলেদের ঘর আলাদা, তারা নিজ নিজ বিছানায় হাত–পা ছড়িয়ে ঘুমায়। মেয়ে দুটো ছোট, তারা মায়ের ঘরে শুলেও তাদের আলাদা খাট। কিন্তু বড় মেয়েটা ভীতু হওয়ায় ও প্রায় সময় মায়ের কাছে ঘুমায়। আজও সে ছটফট করছে। ওর জন্যই জানালার পাল্লার চিকন, ক্ষুদ্র, ফাঁকও বন্ধ করার চেষ্টা করছেন তিনি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝমঝমানি ছাপিয়ে বাইরের খানকাঘরের বারান্দার সামনের তর্জন–গর্জন আর আর্তনাদের মিহিন ছিটেফোঁটা নিশুতি রাতে দ্বিগুণ হয়ে ঘরে আসছে। সেসব শব্দে তীব্র আতঙ্কে বাচ্চা মেয়েটা কেবল চমকে চমকে উঠছে। সন্তানের জন্য আম্মা শব্দের পথ একটা একটা করে বন্ধ করে চলেছেন।
শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। এত এত ঘর, প্রতিটি ঘরে মানুষ, বিপন্ন মানুষ, যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। আম্মারা নিজেরাও শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। এটি তাঁর শ্বশুরবাড়ি। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে। তাঁরা নিজেদের শোবার ঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা একটি ঘরে কোনো রকমে থাকছেন।
তাঁর স্বামী এলাকার মান্যগণ্য প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, নানা মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তাঁর বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য মানুষ আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
রাত বেড়ে গভীর হচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেব মেয়ের পাশে উদ্বিগ্ন আধশোয়া স্ত্রীকে বলেন, ‘দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, আমি বাইরে যাচ্ছি, কখন ফিরব ঠিক নেই।’
যুদ্ধের পুরো সময়টা ফেরার ঠিক নেই, খাওয়া, ঘুমের ঠিক নেই। এভাবেই কাটছে তাঁদের।
শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে।২.বাড়িতে দিনের বেলা খানসেনারা আসে মুক্তির খোঁজে। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের নানাবিধ কথা দিয়ে, ভালো খাবারদাবার দিয়ে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন, শান্ত করে বিদায় দেন। রাতের অন্ধকারে সুপ্ত আতশবাজির মতো আসে মুক্তির ছেলেরা। চেয়ারম্যান সাহেব এবং বাড়ির আম্মা তাদের বুক দিয়ে সহায়তা দিতে চেষ্টা করেন। তারা খেয়েদেয়ে কিছু রসদ, কিছু পরামর্শ নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এসব কাজে পাশে থাকেন তাঁর স্ত্রী, সবাই যাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকে। এভাবে সস্ত্রীক মানুষটি তাঁর নিজের এলাকা, এলাকার আতঙ্কিত মানুষগুলোকে রক্ষা করেন। যখন চারপাশের এলাকা যুদ্ধ নামক আগুনের করালগ্রাসে ভস্মীভূত হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিজ এলাকাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন প্রাণপণে।
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায় সেই কুলাঙ্গারের বিচার করছে। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।
রাজাকারের নাম মকবুল। সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনকে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা মানুষদের ধরিয়ে দিত। আরেকটা কাজ সে নিষ্ঠার সঙ্গে করত, মিলিটারির হাতে নিহত মানুষদের শেষ সময়ে সবাইকে নিজের পেশাব খাওয়াত, সরাসরি মুখে পেশাব করে দিত। এ জন্য তার নাম হয়েছে ‘মুতিয়া মকবুল’। এ নাম পাওয়াতে সে এতই খুশি যে কেউ এ নামে ডাকলে খুশিতে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। মনে হয় সে খান বাহাদুর উপাধি পেয়ে গেছে। আজ আর মুখে হাসি নেই।
জসিম স্টেনগানের নলটা মাথায় ঠেকিয়ে বলে, ‘দেই? ওই শালা হারামি দেই ট্রিগার টিপে?’ ঘোড়েল মকবুল আজ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। ধরা সে পড়েছে কয়েক দিন আগে। লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ধরা পড়ার পরপরই চাচার কাছে খবর যায়। তিনি জানিয়ে দেন, একেবারে মেরে না ফেলে শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় কি না। তাঁর কড়া নির্দেশ—অহেতুক কোনো প্রাণ যেন নষ্ট না হয়। দুরন্ত ছেলেরা তাঁর নির্দেশ মেনে চলে।
তবে ছেলেরা মকবুলকে ভালো রকম শিক্ষা দিচ্ছে। মারধর তো করেছেই, ক্ষণে ক্ষণে গুলি করার হুমকি, এ ছাড়া খাবার, পানীয় কিছুই দেয়নি, ঠিক করেছে ওকে পানি দেওয়া হবে না। মিলিটারিরা এই বর্ষণমুখর রাতে আসবে না জেনে তারা এই বিচার বসিয়েছে। তাদের চাচা বাড়ি থেকে এখনো বের হননি। তিনি আসার আগেই ছেলেরা ওকে যা করার তা–ই করছে। হঠাৎ দেখা যায়, এক যুবক হনহন করে আসছে। এসে হিসহিস করে বলে, ‘খবরদার, এই কুত্তার বাচ্চাক গুলি কইরবা না। অরে আমি ধারালো ছুরি দিয়া কুচি কুচি কইরব। অরে পানি দেব না। অর মুখত মুতি দেব। শালা আমার ভাইয়ের মুখত মুতি দিছিল। পাকি কুত্তারা আমার ভাইটাকে গুলি করে ঝাঁঝরা করি দিছিল, আর এই হামার পড়শি, এই জানোয়ার, শেষ সময়ে তার মুখে মুতি দিছে।’
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায়। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।এই বলে সে মাটিতে থেবড়ে বসে হু হু করে কেঁদে ওঠে। আরও একবার সবাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। মন্টু বলে ওঠে, ‘আরে এত কথায় কাজ কী, দেই শালাক শেষ করে। এই এক বালের জন্য এত সময় নষ্ট।’ সোহরাব ফিসফিস করে ওঠে, ‘এই চাচা আসতেছে।’ গুঞ্জন থেমে যায়। এর মধ্যেই একজন সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি কষলে হাত বাঁধা মকবুল একদিকে কাত হয়ে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একজন ঘুষি মেরে সোজা করে দেয়, ‘হারামজাদা, সোজা হয়া বসি থাক।’
চেয়ারম্যান সাহেব এসে বসে সব কথা শোনেন। তিনি গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও। তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো।’ তিনি এখন জানেন, এই গাদ্দার এলাকার নারীদের ক্যাম্পে নিয়ে গেছে, এলাকার তরুণ–যুবকদের ধরিয়ে দিয়েছে। যে বাড়ির ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে সে বাড়ির মানুষজনকে মিলিটারির কাছে ধরিয়ে দিয়েছে। এমনকি তার পড়শিকেও নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে, হেনস্তা করেছে। চেয়ারম্যান সাহেব ওর দিকে একটা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে চলে যান।
এবারে ছেলেরা চাপা উল্লাসে জেগে ওঠে। ওরা ওকে হাত বাঁধা অবস্থায় হাঁটিয়ে নিতে থাকে।
মকবুল ঘাড়ের ওপর প্রেশার কুকারের সিটির মতো মৃত্যুর গরম নিশ্বাস অনুভব করে। পানির তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে; কিন্তু এরা তো পানি দিচ্ছে না।
চেয়ারম্যান চাচার বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে গেছে একটি শান্ত নদী। পাড় দিয়ে অগণন বৃক্ষের সারি। সেখানে সবাই এসে হাজির হয়। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বের হয়ে এসেছে।
মকবুলের হাত বাঁধা ছিল। এবারে পা–ও বেঁধে ওকে পানির কিনারে বসিয়ে দেওয়া হয়। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।
একজন গলা তুলে বলে, ‘ফায়ার কিন্তু আমি করব।’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘না, আমি ধরছি, ফায়ার আমি করব।’ আরেকটি কণ্ঠ শোনা যায়, ‘তার আগে হারামজাদার মুখটা কেউ তুলে ধর তো, আমি অর মুখত পেচ্ছাব করে দেই, তারপর গুলি না করে জবাই করা হোক।’
মকবুলের হাত বাঁধা। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।মকবুল নিজের অবস্থা বুঝে কেঁপে কেঁপে ওঠে। এরা তো মারবেই। তা মরার সময় একটু পানিও খেতে পারবে না? ওর মনে পড়ে, ওরই বয়সের হামিদুলের কথা। হামিদুল মুক্তি। সে এসেছিল বাবা–মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে নিজে মিলিটারি ডেকে এনে ধরিয়ে দিয়েছে। গুলি খেয়ে পড়ার পর হামিদুল পানি পানি করছিল। তখন সে লুঙ্গি তুলে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা খেলার সাথি হামিদুলের মুখে ছরছর করে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। হামিদুল কী গভীরতর ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে শেষবারের মতো তাকিয়েছিল।
আজ এরা ওকে প্রস্রাবই দেবে। কিন্তু বুকটা তো ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি, হিমশীতল একটু পানি না খেলে হবে না। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে পানির জন্য হাহাকার জেগে উঠছে। জিবটা শুকনা খড়ের মতো রুক্ষ হয়ে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে, ভেতরে একটু থুথুও জমছে না। গলার ভেতরটা মরুভূমির বালুর মতো খসখসে, ঢোক গিলেতে গেলে কাঁটার মতো বিঁধছে। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে, এক ফোঁটা পানি, এক বিন্দু তরল যেন জীবনটাকে শীতল করে দিত। চোখ দুটো জ্বালা করতে থাকে, মাথার ভেতর হালকা ধোঁয়ায় ভরে যায়, ঘোর লাগে, মনে হয় এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিলে জীবনের সব যন্ত্রণা মুছে যেত। পানির পিপাসা যে এমন, তা মকবুল আগে বোঝেনি।
সে গুঙিয়ে ওঠে, ‘ভাই রে, তোমার আল্লাহর দোহাই, আমাক এনা পানি দেও। আমাক গুলি করো, জবাই করো, কিন্তু এক ফোঁটা পানি আমাক দেও। আমাক দয়া করো, তোমার পাও ধরি একনা পানি দেও...’
বৃষ্টি থেমে গিয়ে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বেরিয়ে এসে সবার ওপর সমানভাবে জ্যোৎস্না ছড়াতে থাকে।
ঠিক সে সময় বাড়ির খাস কাজের লোক স্বচ্ছ কাচের জগ ভর্তি টলটলে পানি আর ঝকঝকে একটি গ্লাস নিয়ে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘আম্মা কয়া দিছে অরে পানি খাওয়াইতে। যা করমেন করেন, কিন্তক পানি খাওয়ান।’
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের মতোই আরেক যোদ্ধা এই আম্মাকে ভালোভাবে চেনে, জানে। আম্মা ঘরের ভেতর থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন নানাভাবে। তারা সবাই থির হয়ে যায়। জগের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে ওঠে। সবার চোখ জগের দিকে।
মুতিয়া মকবুলের খড়খড়ে জ্বলুনি চোখেও কি পানি জমে! সে পানি ভরা চোখে জগটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন একটা অপার্থিব দৃশ্য। সবার জোড়া জোড়া চোখের সামনে দৃশ্যটা একটা ঐশ্বরিক ফ্রেমে আটকা পড়ে।