প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের একটি লেখা ‘কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের নামে এ কোন রাজনীতি’ পড়তে গিয়ে থমকে গেলাম। আমাদের শিক্ষাঙ্গনে যে নৈরাজ্য চলছে এবং যেসব নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, তার সঙ্গে লেখাপড়ার মানের উন্নতির কোনো সম্পর্ক নেই। সব আন্দোলন আনুষঙ্গিক বিষয়ে। এসব নিয়ে ক্লাস বয়কট হচ্ছে, রাস্তাঘাট বন্ধ হচ্ছে, হানাহানি–মারামারি হচ্ছে—সবই যেন নিয়মমাফিক ঘটছে।

কিন্তু এগুলোর জন্য চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারা? রাস্তা বন্ধ—পথচারী, গাড়িঘোড়া অন্য পথে যাবে; ভিসি চাকরি হারাবেন—আরেকটা চাকরি খুঁজে নেবেন; শিক্ষাঙ্গন কয়েক মাস বন্ধ থাকবে—সরকারি টাকাকড়ির আমদানি ঠিকমতো চলবে, সবাই বেতন পাবেন।

আসল ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরা এবং অবশ্যই আমাদের জাতি। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাদীক্ষা ও আগামী দিনের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবেন, মা–বাবাকে কষ্টের উপার্জন দিয়ে সন্তানকে হয়তো আরও এক সেমিস্টার বেশি পড়াতে হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই জাতি, যে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে অঢেল টাকা ঢালছে আশা নিয়ে—তরুণেরা সুশিক্ষিত হয়ে দেশের হাল ধরবে।

আমাদের দেশে স্কুল হতে চায় কলেজ, কলেজ হতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় হতে চায় স্বায়ত্তশাসন। কেউ নিজেকে নিয়ে খুশি নয়। এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাজনীতি চায় না, আরেকটা ক্লাসে তালা মারছে রাজনীতি করতে। যে যে কাজে আছেন, সবাই প্রমোশন চাচ্ছেন। দাবিদাওয়ার আগে কেউ ভাবেন না দাবিগুলো কতটুকু ন্যায্য বা তাঁদের দাবি মেটাতে গিয়ে অন্যদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে কি না কিংবা তাঁরা যে দাবি করেছেন, তার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কি না।

এই তো কদিন আগে ঢাকার একটা কলেজ ইউনিভার্সিটি হওয়ার জন্য তুমুল আন্দোলন করল, বনানী-মহাখালীর রাস্তা অবরুদ্ধ দিনের পর দিন। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি কলেজের মানের রেটিংয়ে তারা পড়ে রয়েছে অনেক পেছনে। নটর ডেম কলেজ, আদমজী কলেজ যদি কলেজ নাম নিয়ে থাকতে পারে, তাদের আপত্তি কেন? তাদের বলা যেত, তোমরা র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে এসো, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় হবে। কিন্তু কার কথা কে শুনবে?

আমাদের ঘরে দাবি, বাইরে দাবি, শুধু দাবি আর দাবি। বাসায় গিন্নির দাবি—কেনাকাটার টাকা বাড়াতে হবে, অফিস সহকর্মীর দাবি—সিনিয়রকে ডিঙিয়ে প্রমোশন দিতে হবে। ব্যক্তিগত দাবিগুলো নাহয় আলাপ–আলোচনা করে মিটমাট করা যাবে। কিন্তু গ্রুপ দাবি? সেগুলো তো ‘মব’ হয়ে তেড়ে আসে, সবকিছু বন্ধ করে দিচ্ছে। এগুলোকে কীভাবে সুশৃঙ্খল করা যাবে? সব দাবি যে অযৌক্তিক, তা নয়, অনেক দাবিদাওয়া আছে খুব ন্যায়সংগত। কিন্তু অসংগত, অর্ধসংগত দাবিদাওয়ার ভিড়ে ন্যায়সংগত দাবিগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যায় পুরো দেশ অচল হওয়ার আগে দাবিদাওযা নিয়ে সরকারকে নতুন কিছু ভাবতে হবে।

তাই আমি দাবি করছি, ‘জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা’ গঠন করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-আধা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাঁদের দাবিদাওয়া আছে, তাঁরা রাস্তায় নামার আগে বা কক্ষে তালা দেওয়ার আগে তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে এই সংস্থায় আসবেন এবং দাবি নিবন্ধন করবেন।

আরও পড়ুনদাবি মানেই কি সড়ক–রেল অবরোধ?০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এই সংস্থা দাবিগুলোকে যাচাই–বাছাই করে যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যাবে অন্যায্য বা অগ্রহণযোগ্য, সেগুলোর উত্থাপকদের কাউন্সেলিং বা যুক্তি দিয়ে বোঝাবেন। যেমন বেতন বাড়াতে হবে ২০০ শতাংশ—এ দাবি মানলে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবে। যেগুলো ন্যায্য দাবি সেগুলো নিয়ে নিষ্পত্তি সংস্থা উত্থাপকদের পক্ষ হয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে তদবির করবেন। আইন বিভাগ আইনগত দিক খতিয়ে দেখবে। আবার যেগুলোর মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ, সেগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করবে। প্রতিটা দাবির জন্য তিন থেকে ছয় মাস সময় নির্ধারণ করা হবে।

এভাবে সংস্থা দাবিকারীদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে দাবিগুলোর একটা সুবিবেচিত সুরাহার আশা জাগাতে পারে। যেকোনো ক্ষোভ ও অস্থিরতার প্রাথমিক সময়টা যদি আগেভাগে কিছুটা সামাল দেওয়া যায়, পরবর্তী প্রতিক্রিয়া আরও যুক্তিসংগত হবে। দাবিদাওয়া সংস্থার বাইরে গিয়ে কোনো দাবি মেটানোর বা দাবি নিয়ে আন্দোলন করার সুযোগ থাকবে না। সংস্থার নিষ্পত্তি পছন্দ না হলে দাবিকারীরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। স্বাধীন বিচারব্যাবস্থায় সবারই সমান অধিকার।

জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা গতানুগতিক অন্য সব সংস্থার মতো হবে না। এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষেরা, যেমন বিচারকাজে আমাদের দেশে এককালে জুড়ি প্রথা ছিল। প্রয়োজনে রাজনীতিবিদদের জড়িত করা যেতে পারে, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বিশৃঙ্খল দাবিদাওয়ার সংক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে। এ সংস্থা সরকারের অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে সব ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবে।

জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা গতানুগতিক অন্য সব সংস্থার মতো হবে না। এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষেরা, যেমন বিচারকাজে আমাদের দেশে এককালে জুড়ি প্রথা ছিল। প্রয়োজনে রাজনীতিবিদদের জড়িত করা যেতে পারে, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বিশৃঙ্খল দাবিদাওয়ার সংক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে। এ সংস্থা সরকারের অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে সব ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবে।

এ সংস্থার প্রধান হবেন একজন ন্যায়পাল। তাঁর অধীন থাকবে—১.

যাচাই–বাছাই বিভাগ, ২. আইন বিভাগ এবং ৩. কাউন্সেলিং বা পরামর্শ বিভাগ।

একজন ন্যায়পাল নিয়োগ করে একটা অফিসে এক্ষুনি শুরু করে দেওয়া যায় এই সংস্থা। ন্যায়পালের অফিসসহ চার বিভাগে দুজন করে আটজন লোক দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। প্রচার করে বলে দেওয়া হোক, যেকোনো দাবি ছোট বা বড়, ন্যায্য বা অন্যায্য প্রথমে এ সংস্থায় জমা দিতে হবে, নতুবা কোনো দাবি কোনোভাবেই বিবেচনা করা হবে না। এ সংস্থা শুধু সংঘবদ্ধ দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবে। ব্যক্তিগত দাবির জন্য জনগণকে মন্ত্রণালয় বা থানায় যেতে হবে।

‘দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা’ সরকারের অন্যান্য সংস্থার মতো হবে না। এরা বসে বসে ফাইল আদান–প্রদানকারী লোক নিয়ে গঠিত হবে না। এরা হবে সংকট ব্যবস্থাপনা টিম, যারা জনগণকে সম্পৃক্ত করে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে যেকোনো সংকট তুঙ্গে ওঠার আগে তার সমাধানের চেষ্টা করবে।

সাধারণত দুই ধরনের দাবি নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়:

১. কর্মযোগ্য দাবি: এসব দাবি নিয়ে সরকার কিছু একটা করতে পারে। যেমন সরকারের চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা ৩৫ বছর করা, শহরের ভেতর ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে অনুমতি দেওয়া—এ রকমের। কিছু দাবি অনেক সময় সরকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নেয় সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, কোনো অনভিপ্রেত দাবি সরকারের মেনে নেওয়ার অর্থ, নতুন দাবির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। বয়সের দাবি ৩২ বছর মেনে নিলে ৩৮ বছরের দাবি আসতে কতক্ষণ?

২. অকর্মযোগ্য দাবি: সরকার কিছুই করতে পারছে না, এমন দাবি এগুলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন ছাত্রের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু নিয়ে তাঁর সহকর্মীরা ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ হন এবং অনেক ক্ষেত্রে তুমুল আন্দোলন করেন। ফলে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় দিনের পর দিন। সহপাঠীকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। শোকসন্তপ্ত ছাত্রদের বোঝাতে এবং বুঝতে সাহায্য করতে হবে কাউন্সেলিং করে। বিদেশে মানুষকে শান্ত রাখার জন্য কাউসেলিংকে একটা উপযুক্ত হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশে কেন করা যাবে না? যেকোনো শোক-ক্রোধ ও হাঙ্গামা প্রথমে শুরু হয় খুব অল্পসংখ্যক লোক থেকে। তাঁদের শান্ত করতে পারলে বড় সংকট এড়ানো যেতে পারে।

দাবি যে কখন কোত্থেকে আসবে, সেটা অনুমান করে লাভ নেই। দাবি আসতে পারে ছাত্রদের থেকে, আবার ঢাকা কলেজের দাবির সঙ্গে সিটি কলেজ বা আদর্শ কলেজের দাবির সংঘর্ষ থাকতে পারে। দাবি আসতে পারে পোশাককর্মীদের থেকে, রিকশাচালকদের কাছ থেকে বা বাসমালিক সমিতি থেকে। তবে আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ যাঁরা কৃষক, তাঁরা কোনো দাবি জানাবে না অথবা গ্রামের মানুষ তাঁদেরও তেমন কোনো দাবি নেই।

দাবি আসতে পারে আমাদের রাজনীতিবিদদের থেকে, তাঁরা অধৈর্য হলে আরও বিপদ বাড়তে পারে। তাঁরাও মিছিল, হরতাল করে দাবি জানাতে পারেন। তবে রাজনৈতিক দাবিগুলো রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করতে হবে।

মানুষের আকাঙ্ক্ষা থেকেই দাবিদাওয়ার সৃষ্টি হয়। এ দেশে আমরা যদি আমাদের দাবিগুলো একটা সুশৃঙ্খল পদ্ধতির মাধ্যমে মীমাংসা করতে পারি, আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।

আমরা যদি সুশৃঙ্খলভাবে আমাদের বড় বড় জাতীয় আকাঙ্ক্ষাগুলোকে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করতে পারি, তাহলে জনগোষ্ঠীর ছোট ছোট আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। জনগণকেও বোঝাতে এবং বুঝতে হবে—কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক, কোনটা স্বাধীনতা কোনটা অপস্বাধীনতা এবং কোনটা অধিকার আর কোনটা অনধিকার।

সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ই–মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র দ শ ক জ করব সরক র র গত দ ব র জন য র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।

জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।

‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।

ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।

শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।

ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়

শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।

এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।

গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।

এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।

এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।

জনমতে এগিয়ে মামদানি

ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।

কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।

ভূমিধস পরিবর্তন

একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।

পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।

এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।

এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’

কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বগুড়ায় বাড়িতে হাতবোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণ, আহত একজন গ্রেপ্তার
  • ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প
  • ‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’
  • যদি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে: এফ আর খান
  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন
  • তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের বিজয়ী সামিয়া
  • আমার স্ত্রী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছেন না: জেডি ভ্যান্স