ঢাকার দুই সিটিকে এক করার প্রস্তাব
Published: 23rd, April 2025 GMT
১৩ বছরে আগে উত্তর ও দক্ষিণ—এ দুই সিটিতে বিভক্ত হয়েছিল ঢাকা সিটি করপোরেশন। এখন এই বিভাজন তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। তারা সমগ্র ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য একক ঢাকা সিটি করপোরেশন করার পরামর্শ দিয়েছে। কাজের পরিধি, কাঠামো ও নির্বাচনের ধরনেও বড় রকমের পরিবর্তন করতে বলেছে কমিশন।
এ ক্ষেত্রে বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় যে ২০টি অঞ্চল আছে, সেগুলোর প্রতিটিকে ওই এলাকার ওয়ার্ডগুলো নিয়ে একটি করে স্বতন্ত্র ‘সিটি কাউন্সিল’ (যেমন মিরপুর একটি সিটি কাউন্সিল হতে পারে) করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এই সিটি কাউন্সিলই এলাকাভিত্তিক মূল কাজগুলো করবে। আর সিটি করপোরেশন মূলত সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। এখানে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর সিটি কাউন্সিল ও সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হবেন কাউন্সিলরদের ভোটে।
ভবিষ্যতে যদি মেয়র নির্বাচনে জনগণের পরিবর্তে কাউন্সিলরদের ভোট নির্ধারক ভূমিকা রাখে, তাহলে তা জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার খর্ব করার আশঙ্কা সৃষ্টি করবে।অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবীর, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত রোববার জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। গত বছরের ১৮ নভেম্বর স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে আট সদস্যের স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
বুড়িগঙ্গা নদীতীরে অবস্থিত প্রাচীন নগরী ঢাকাকে পৌরসভা করা হয় ১৮৬৪ সালে। এরপর নানা পথপরিক্রমায় ১৯৯০ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন নামকরণ করা হয়। ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশন যাত্রা শুরু করে।
এখন লন্ডনের নগর সরকারকাঠামোর আদলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের জন্য দুই স্তরবিশিষ্ট ‘মহানগর সরকার’ গঠনের সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। কমিশন বলছে, ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে একক মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় যে ২০টি অঞ্চল আছে, সেগুলোর প্রতিটিকে ওই এলাকার ওয়ার্ডগুলো নিয়ে একটি করে স্বতন্ত্র ‘সিটি কাউন্সিল’ (যেমন মিরপুর একটি সিটি কাউন্সিল হতে পারে) করার সুপারিশ করেছে কমিশন।সিটি কাউন্সিল
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একেকটি সিটি কাউন্সিল তার নিজস্ব ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে কাজ করবে, যা কতগুলো ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হবে। স্বায়ত্তশাসন থাকলেও এই সিটি কাউন্সিলগুলো কাজের দিক দিয়ে বৃহত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় একটি স্যাটেলাইট আকারে যুক্ত থাকবে এবং পরিচালিত হবে। প্রতিটি সিটি কাউন্সিলে একজন মেয়র থাকবেন।
সিটি কাউন্সিল জননিরাপত্তা (কমিউনিটি পুলিশ) এবং অগ্নিনির্বাপণ পরিষেবা, মশকনিধন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ফুটপাত, রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবসায় বা পেশার নিবন্ধন বা অনুমোদনসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সরাসরি প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে। স্থানীয় কর সিটি করপোরেশন নয়, শুধু সিটি কাউন্সিল সংগ্রহ করবে।
‘ঢাকা মহানগর সরকারে’ অঞ্চলভিত্তিক ২০টি সিটি কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে। এর সম্ভাব্য একটি তালিকাও করে দিয়েছে কমিশন। যেমন বনানী–বারিধারা–গুলশান নিয়ে হবে একটি কাউন্সিল, উত্তরা পূর্ব–পশ্চিম নিয়ে একটি, দক্ষিণ খান–উত্তরখান, মিরপুর, পল্লবী, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি–রায়েরবাজার, লালবাগ, কেরানীগঞ্জ, রামপুরা–বনশ্রী–খিলগাঁও–মালিবাগ–মুগদা–বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী–সায়েদাবাদ, রমনা–মতিঝিল–দিলকুশা, আরমবাগ–বাংলাবাজার–ওয়ারী–সূত্রাপুর–কোতোয়ালি, গাবতলী–আমিনবাজার, বসুন্ধরা–ভাটারা, কাফরুল–ক্যান্টনমেন্ট, খিলক্ষেত–কুড়িল, সাতারকুল, ডেমরা ও তেজগাঁও– আগারগাঁও– সংসদ ভবন এলাকা।
বুড়িগঙ্গা নদীতীরে অবস্থিত প্রাচীন নগরী ঢাকাকে পৌরসভা করা হয় ১৮৬৪ সালে। এরপর নানা পথপরিক্রমায় ১৯৯০ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন নামকরণ করা হয়। ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশন যাত্রা শুরু করে।নির্বাচন কীভাবে
কাউন্সিলগুলোতে নির্ধারিত সংখ্যক ওয়ার্ড থাকবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে একটি সিটি কাউন্সিলে কমপক্ষে ৯টি থেকে সর্বোচ্চ ১৫টি ওয়ার্ড থাকবে। এই ওয়ার্ডগুলোয় ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন। এক-তৃতীয়াংশ ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত কাউন্সিলররা নিজেদের ভোটে কাউন্সিলের মেয়র নির্বাচিত করবেন। আর সব সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলররা মহানগর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ভোটার হিসেবে বিবেচিত হবেন। সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন উন্মুক্ত থাকবে। সেখানে নির্বাচিত কাউন্সিলর ও বাইরের অনির্বাচিত ব্যক্তিও নির্বাচনের শর্ত পূরণ করে মেয়র পদে প্রার্থী হতে পারবেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবীর প্রথম আলোকে বলেন, জনসংখ্যা বিবেচনায় ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশন থাকা নাগরিক সেবা ও সেবার মান নিশ্চিত করতে সহায়ক। তবে এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলোকে মহানগরের যেকোনো বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যকর আইনি কাঠামো নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মেয়র জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন, যা গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি মেয়র নির্বাচনে জনগণের পরিবর্তে কাউন্সিলরদের ভোট নির্ধারক ভূমিকা রাখে, তাহলে তা জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার খর্ব করার আশঙ্কা সৃষ্টি করবে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র ব চ ত হব ন র স প র শ কর ছ নগর সরক র জনগণ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ক্ষমতার একচ্ছত্র দখলদারি বহাল রাখতে চায়: ডাকসু
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নিয়োগের সংস্কার প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিএনপি ক্ষমতার একচ্ছত্র দখলদারি বহাল রাখতে চায় বলে দাবি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)।
রবিবার (২ নভেম্বর) ডাকসুর ভিপি মো. আবু সাদিক, জিএস এসএম ফরহাদ ও এজিএস মুহা: মহিউদ্দিন খান স্বাক্ষরিত ‘রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কাৃরের বিরোধিতা এবং ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো অক্ষুণ্ন রাখার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ডাকসুর প্রতিবাদ' শীর্ষক এক প্রতিবাদলিপিতে এ কথা বলা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
ঢাবি শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে ২ কমিটি
ঢাবিতে সপ্তাহব্যাপী শিল্পকর্ম প্রদর্শনী শুরু
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, জুলাই বিপ্লব ছিল বৈষম্য, অবিচার ও ফ্যাসিবাদী শাসনকাঠামোর বিরুদ্ধে এ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার এক সম্মিলিত বিপ্লব। কেবল সরকার পরিবর্তন নয় বরং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ, স্বাধীন ও শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন, প্রশাসনিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং একটি বৈষম্যহীন-ন্যায়ভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল এই বিপ্লবের মূল ভিত্তি। নতুন প্রজন্ম চেয়েছিল এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে কোন প্রকার বৈষম্য ও রাজনৈতিক একচেটিয়া কর্তৃত্বের জায়গা থাকবে না।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ধারাবাহিকভাবে সংস্কার কার্যকর করার বিরোধিতা করে তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। বিশেষত বিএনপি এমন সব মৌলিক সংস্কারের বিরোধিতা করেছে যা সরাসরি ছাত্র–জনতার স্বপ্নের সঙ্গে জড়িত। পিএসসি, দুদক, ন্যায়পাল ও মহা-হিসাব নিরীক্ষকের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নিয়োগ নিশ্চিত করার সংস্কার প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তারা ক্ষমতার একচ্ছত্র দখলদারি বহাল রাখতে চায়।
যে বৈষম্যমূলক চাকরি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই জুলাই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল সেই কাঠামো পরিবর্তনের বিরুদ্ধাচরণ করে বিএনপি নতুন প্রজন্মের ন্যায্য দাবি অস্বীকার করছে। পাশাপাশি জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশনের বিরোধিতা, অনুচ্ছেদ–৭০ সংস্কারে আপত্তি, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান আলাদা দুজন ব্যক্তির মতো আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রস্তাবে বিরোধিতা, আইন পেশায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনে তাদের আপত্তি রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে বড় বাঁধার সৃষ্টি করছে। এভাবে বিএনপি মূলত জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে অস্বীকার করে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
প্রতিবাদলিপিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, এই সংস্কারগুলো ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ নয় বরং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তৈরির লক্ষ্যেই প্রস্তাবিত হয়েছে। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ গঠনের নৈতিক দায়িত্ব ছাত্র ও সর্বস্তরের জনগণের। তাই সংস্কারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনগণ থেকে নিতে হবে। আর গণভোটই জনগণের ম্যান্ডেট নিশ্চিতের উপযুক্ত মাধ্যম। গণভোটের মাধ্যমেই জনগণ ঠিক করবে দেশের স্বার্থে কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোকে তারা সমর্থন দিবে।
কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব যদি রাষ্ট্রগঠনমূলক সংস্কারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তবে ছাত্র-জনতা সেই বাধা অতিক্রমে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেবে জানিয়ে প্রতিবাদলিপিতে আরো বলা হয়, জুলাই বিপ্লব শুধু শাসক বা সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয় বরং জুলাই বিপ্লব হলো ফ্যাসিবাদী কাঠামো বিলোপ করে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণ।
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী