জবির রেজিস্ট্রার ছাত্রফ্রন্টের সভাপতিকে বললেন, গেট আউট, একে বের করে দাও
Published: 24th, April 2025 GMT
‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কারো পার্সোনাল কিছু চুরি হলে সেটা তার (শিক্ষার্থীর) দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের না। বিশ্ববিদ্যালয় পার্কিংয়ের জায়গা না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি ভাত-রুটির ব্যবস্থা করা? গেট আউট, একে বের করে দাও।’ রেগে-মেগে এভাবেই নিজ কক্ষ থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. শেখ গিয়াসউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও এক ছাত্রনেতাকে বের করে দেন। ভুক্তভোগী ওই ছাত্রনেতার নাম ইভান তাহসীব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্টের সভাপতি।
গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকেল চুরির ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা যাতে কর্তৃপক্ষ নেয় সেজন্য ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিতে যান ইভান। তখন এ ঘটনা ঘটে, যার একটি রেকর্ডিং (ধারণ) এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। রেকর্ডিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও ছাত্রনেতা ইভানকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্যারেজ থেকে নিয়মিত সাইকেল চুরির সুরাহার জন্য রেজিস্ট্রারের নিকট লিখিত অভিযোগ ও নিরাপত্তা বাড়াতে আবেদন করতে যান সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্টের সভাপতি ইভান তাহসীব। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো শিক্ষার্থীর কিছু হারালে সে দায় প্রশাসনের না বলে জানান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড.
তখন ওই শিক্ষার্থী জানতে চান, ‘তাহলে স্যার এই স্টুডেন্টদের দায়িত্ব কে নিচ্ছে? এই জবাবে রেজিস্ট্রার বলেন, ডাজ নট ম্যাটার।
ইভান বলেন, ‘তাহলে সাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে না আসতে পারলে টিউশনে যাবে কিভাবে সে?’ জবাবে রেজিস্ট্রার বলেন, এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি কি খাবেন, না খাবেন এটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব?
ইভান বলেন, ‘এই ছেলেটি শুধু নিজে রোজগার করে খায় না, সে বাসায়ও টাকা পাঠায়, আপনারা শিক্ষার্থীদের সুবিধা দেখবেন না?’
তখন রেগে গিয়ে রেজিস্ট্রার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি ভাত-রুটি ব্যবস্থা করা?’
জবাবে ইভান বলেন, ‘আমি ভাত-রুটির কথা বলছি না। ওর সাইকেল হারিয়েছে, তার নিরাপত্তার কথা বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রশাসনের।’ এ সময় রেজিস্ট্রার বলেন, ‘নেভার।’
ইভান বলেন, ‘আমরা এখানে থাকি গ্রাম থেকে আসছি, টিউশনি না করলে চলব কিভাবে?’
উত্তেজিত হয়ে তখন রেজিস্ট্রার বলেন, ‘এটা আপনার আগে ভাবা উচিৎ ছিল। ওখানে স্কুল-কলেজ নাই, আর বিশ্ববিদ্যালয় নাই? ওখানে ভর্তি হতেন।’
ইভান বলেন, ‘স্যার আপনি কথা গুলো পাবলিকলি বলতে পারবেন শিক্ষার্থীদের?’
উত্তরে রেজিস্ট্রার বলেন, ‘আমি বলি না। আমি লিখে দেই। ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে লেখা থাকে এটা অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, আপনি কত সালে ভর্তি হয়েছেন?’
এ সময় রেজিস্ট্রার ইভানকে বলেন, ‘গেট আউট।’ এবং পাশে থাকা কর্মকর্তাদের তিনি আরও বলেন, ‘একে বের করে দাও।’
এ বিষয়ে কথা বলতে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. শেখ গিয়াসউদ্দীনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে শিক্ষার্থীর সাথে দুর্ব্যবহারের নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতারা। নিন্দা জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক মাসুদ রানা বলেন, ‘৫ আগস্টে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সাহসী আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রসমাজ যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছিল, তা ছিল একটি সহযোগিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনিক পরিবেশ গড়ে তোলার প্রত্যাশায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনও সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। বিশেষ করে রেজিস্ট্রারের আচরণ পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট প্রশাসনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, এটি আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তোলে। আমরা তার দমনমূলক ও অসহযোগিতামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করছি। এই পরিস্থিতি আর সহ্য করা যায় না। আমরা তার পদত্যাগ দাবি করছি, এটাই এখন সময়ের দাবি।’
জবি ছাত্রঅধিকার পরিষদের সভাপতি এ কে এম রাকিব বলেন, ‘আমরা এর আগেও স্যারের এমন দুব্যবহারের শিকার হয়েছি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলেই তিনি ওই চেয়ারে বসেছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, ‘ঘটনা শুনেছি। এই ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। আমি রেজিস্ট্রার ও ভুক্তভোগী ইভানের সঙ্গে কথা বলেছি। এ নিয়ে আলোচনা হবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জ স ট র র বল ন ব র কর
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।