আইএমএফের ঋণের কিস্তি পাচ্ছে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশও আশাবাদী
Published: 26th, April 2025 GMT
বাংলাদেশের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় করতে সময় নিলেও শ্রীলঙ্কার ঋণের কিস্তি ছাড় করতে প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণের পঞ্চম কিস্তির বিষয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সংস্থাটির প্রাথমিক বা কর্মী পর্যায়ের চুক্তি হয়েছে।
ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ মূল্যায়ন শেষে আইএমএফ শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করায় এই চুক্তি হয়েছে। এখন আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদন হলে পঞ্চম কিস্তির ৩৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাবে শ্রীলঙ্কা।
এ নিয়ে শ্রীলঙ্কার কিস্তি পাওয়া নিয়ে দেশটির আইএমএফ মিশনপ্রধান ইভান পাপাজর্জিও একটি বিবৃতিও দিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার তা আইএমএফের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ শেষ বা তৃতীয় কিস্তির অর্থ পেয়েছে ২০২৪ সালের জুন মাসে। তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। চতুর্থ কিস্তির অর্থ পাওয়ার কথা ছিল গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু তখন তা পাওয়া যায়নি। জুন মাসে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একত্রে পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে আইএমএফ বলেছে, কর্মসূচির অধীনে যেসব কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে শ্রীলঙ্কা সামগ্রিকভাবে ভালো করেছে। দেশটি জিডিপি সংকোচনের ধারা থেকে বেরিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে। রাজস্ব আহরণ, রিজার্ভ বৃদ্ধি ও কাঠামোগত সংস্কারের যে রূপরেখা করা হয়েছিল, সেগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। ঋণ পুনর্গঠন প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কর্মসূচির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, শ্রীলঙ্কা সরকার তা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ।
২০২২ সালে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কা। সেই সংকটের জেরে দেশটিতে সরকারের পতন হয়। এরপর দেশটির অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। তার অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আইএমএফের সঙ্গে ঋণচুক্তি করে দেশটি। সেই চুক্তির আওতায় এখন পর্যন্ত চার কিস্তিতে অর্থ পেয়েছে দেশটি। এখন তারা পঞ্চম কিস্তির অপেক্ষায়, যার প্রাথমিক অনুমোদন তারা পেয়ে গেল।
এপ্রিল মাসে শ্রীলঙ্কা সফরে আসে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। কিন্তু ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের সব দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। শ্রীলঙ্কার পণ্যে ৪৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে প্রাথমিক চুক্তি করেনি আইএমএফ।
এরপর ৯ এপ্রিল ট্রাম্প তিন মাসের জন্য পাল্টা শুল্ক স্থগিত করেন। তারপর এই প্রাথমিক চুক্তি হলো। যদিও আইএমএফ বলছে, বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে।
ট্রাম্পের শুল্কের স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হলে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ ও আইএমএফ পরিস্থিতি বুঝে কাজ করবে। অর্থাৎ শুল্কের কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিরূপণ করে নীতি প্রণয়ন করবে শ্রীলঙ্কা।
প্রাথমিক চুক্তিতে আইএমএফ আরও বলেছে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, করছাড় হ্রাস ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠনে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে দরিদ্র মানুষের সহায়তায় আরও শক্তিশালী কর্মসূচি নিতে হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ। তারা মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের কারণে শ্রীলঙ্কার পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দেশটির প্রায় তিন লাখ মানুষ এই খাতে কাজ করে।
এদিকে গত শুক্রবার বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর শ্রীলঙ্কার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। গত বছরের অক্টোবর মাসেও তারা একই পূর্বাভাস দিয়েছিল। ২০২৪ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ শতাংশ।
ওয়াশিংটনে চলমান বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকে যোগ দেওয়া শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিদল ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বিবৃতিতে বলেছেন, শুল্ক নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা চলবে।
ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশের সঙ্গেও আইএমএফের ঋণচুক্তি চলমান আছে। আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি।
সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। ঢাকা ছাড়ার আগে আইএমএফের মিশন ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, এ বিষয়ে আরও আলোচনা চলবে এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ পাওয়া যেতে পারে আগামী জুনের শেষ দিকে। সে বিষয়ে এখন আলোচনা চলছে। সামগ্রিকভাবে এই ঋণ কর্মসূচির পরবর্তী কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে আছে বাংলাদেশ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইএমএফ র
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।
পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।
সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।