শেষ হয়নি ৭ কোটি টাকার কাজ, লাপাত্তা ঠিকাদার
Published: 5th, May 2025 GMT
জয়পুরহাটের তিন উপজেলার তিনটি হাটে ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার্থে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ সাড়ে চার বছরেও শেষ হয়নি। তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়েও প্রকল্প অসম্পন্ন রেখে লাপাত্তা হয়েছেন ঠিকাদার। এতে হাটে জায়গা সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। উন্মুক্ত স্থান ও গাছতলায় পণ্য কেনাবেচা করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
এলজিইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিপত্র বাতিল করা হয়েছে। নতুন ঠিকাদার নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আক্কেলপুরের রায়কালী, কালাইয়ের হারুঞ্জা ও ক্ষেতলাল উপজেলার লালাগড় হাটে নতুন ভবন নির্মাণে গ্রামীণ হাট-বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দরপত্র আহ্বান করে। ২ কোটি ৬৪ লাখ ৭৯ হাজার টাকায় রায়কালী, সমপরিমাণ অর্থে লালাগড় এবং ১ কোটি ৭৪ লাখ ২১ হাজার ১৮২ টাকার চুক্তি মূল্যে তিনটি হাটে ভবন নির্মাণে মণ্ডল ট্রেডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর তৎকালীন জয়পুরহাট-২ আসনের সাংসদ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ভবনগুলোর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। চুক্তি অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৯ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
পরবর্তী সময়ে ঠিকাদারের অনুরোধে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ ৩ দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রকল্পের কাজ শেষ করতে নির্দেশ দেয়। কাজ শেষ না করে গত বছরের মার্চ মাসে লাপাত্তা হন ঠিকাদার। ভবনগুলোর কাজ শেষ করার জন্য এলজিইডি থেকে বারবার ঠিকাদারকে তাগাদা দেওয়া হলেও সাড়া দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। তিনটি হাটে গড়ে ৩৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
গত শনি ও রোববার হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি হাটে প্রায় ৭০ শতাংশ জায়গাজুড়ে নির্মাণাধীন ভবনে আরসিসি পিলার দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও একতলায় ছাদ এবং দ্বিতীয় তলায় পিলার আছে। রডগুলোতে মরিচা ধরেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাউকে প্রকল্প সাইটে পাওয়া যায়নি।
রায়কালী হাটের চাল ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, শুরু থেকে ঠিক মতো কাজ করেননি ঠিকাদার। একদিন কাজ করলে এক মাস বন্ধ ছিল কাজ। জায়গার অভাবে অনেকে হাটের বাইরে বটতলাতে দোকান বসাচ্ছেন। আগের চেয়ে হাটে লোকজনের সমাগম কম। বেচাকেনাও কমে গেছে। নিয়মিত লোকসান গুনতে হচ্ছে।
লালাগড় হাটের মুদি দোকানি আহসান হাবিব বলেন, হাটে দোকান বসাতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বৃষ্টি হলেই দোকানদাররা দৌড়াদৌড়ি করে। রোদে গা পুড়ে যায়। জায়গা নেই তো কী হয়েছে, ইজারাদার ঠিকই খাজনা আদায় করছেন। মার্কেট নির্মাণকাজ বন্ধ থাকলেও দেখার যেন কেউ নেই।
রায়কালী হাটের ইজারাদার রাশেদুজ্জামান জানান, হাটের বেশির ভাগ জায়গায় ভবন নির্মাণের কাজ কচ্ছপগতিতে চলেছে। এখন সম্পূর্ণ বন্ধ আছে। বর্ষা মৌসুমে কাদাপানিতে একাকার হয়ে কেনাকাটা করতে হবে জনসাধারণকে।
হারুঞ্জা হাটের ইজারাদার বজলুর রহমান বলেন, এমনিতেই হাটের জায়গা নেই। কয়েক বছর ধরে ধীরগতিতে চলছে নতুন ভবনের কাজ। এতে ক্রেতা-বিক্রেতারা ভোগান্তির মুখে পড়েছেন। খাজনা আদায়ে গেলে ব্যবসায়ীদের গালি শুনতে হচ্ছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মণ্ডল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলমের ভাষ্য, দফায় দফায় নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে মূলত কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পের তাঁর অনেক লোকসান হয়েছে। এলজিইডি যে কোনো সিদ্ধান্তে তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ আলম জানান, বারবার নোটিশ দেওয়া সত্ত্বেও কাজের অগ্রগতি নেই। ঠিকাদারের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল তা বাতিল করা হয়েছে। এখন আবার টেন্ডার করে নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আওতায় প্রকল্পের কাজ শেষ করার সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র ক জ ভবন ন র ম ণ ব যবস য় ন ভবন
এছাড়াও পড়ুন:
আমানত রক্ষা করা ইসলামের সামাজিকতার সৌন্দর্য
আধুনিক বিশ্বে ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামের একটি মৌলিক মূল্যবোধ—‘আমানত’—চিন্তা ও চর্চা থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।
অথচ আমানত শুধু একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক ধারণা নয়, বরং এটি একটি বিস্তৃত আত্মিক ও নৈতিক দায়িত্ব, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের ওপর অর্পণ করেছেন।
পবিত্র কোরআনে এই আমানতের গুরুত্ব অত্যন্ত জোরালোভাবে বর্ণিত হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল; কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয়ই সে ছিল অত্যন্ত জুলুমকারী ও মূর্খ।’ (সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২)
এই আয়াতে আমানতের মর্যাদা ও এর ওজনের গভীরতা প্রকাশ পায়। আল্লাহর এই দায়িত্ব মানুষের ওপর অর্পিত হওয়া তার বিশেষত্বের প্রমাণ, তবে এটি একই সঙ্গে তার জন্য একটি বড় পরীক্ষা।
নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল। কিন্তু মানুষ তা বহন করল।সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২আমানতের ব্যাপকতা‘আমানত’ শব্দটির অর্থ শুধু আর্থিক বা সামাজিক বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ব্যাপক ধারণা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমানতের মধ্যে রয়েছে:
ব্যক্তিগত আচরণে সততা: কথায়, কাজে ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সত্যবাদিতা।
সামাজিক দায়িত্ব: পরিবার, সমাজ ও সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন।
পরিবেশের প্রতি যত্ন: আল্লাহর সৃষ্টির খিলাফা হিসেবে প্রকৃতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা।
আধ্যাত্মিক আনুগত্য: আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ ও তাঁর আদেশ পালন।
আমানত একটি ইবাদতের অংশ, যা শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতের জবাবদিহির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।
আরও পড়ুনইসলামে আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব২২ জুলাই ২০২২নবী–যুগে আমানতের উদাহরণইসলামের প্রাথমিক যুগে নবীজি (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদিনার সমাজ আমানতের একটি জীবন্ত উদাহরণ। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
এই সম্পর্ক শুধু সম্পদের বণ্টন নয়, বরং পারস্পরিক দায়িত্ব ও বিশ্বাসের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমনকি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর আনসারি ভাই সা’দ ইবনে রাবী (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক এবং এমনকি তাঁর স্ত্রীদের একজনকে তালাক দিয়ে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ত্যাগ ও বিশ্বাস আমানতের প্রকৃত চিত্র। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৭৮০)
মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে মদিনার সমাজে একতা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, যা আজও মুসলিম সমাজের জন্য একটি আদর্শ।
আধুনিক সমাজে আমানতের অবক্ষয়দুর্ভাগ্যবশত, আজকের সমাজে আমানতের চর্চা দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, গোষ্ঠীবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মসজিদগুলোতে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিভেদ, পারিবারিক স্বার্থপরতা এবং একে অপরের প্রতি সন্দেহ সমাজের ঐক্যকে ভঙ্গ করছে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও প্রায়ই দেখা যায়, অসৎ আচরণ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসের অপব্যবহার।
এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও ‘নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা’ একটি নতুন সামাজিক আদর্শ হয়ে উঠেছে। মানুষ অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটি শুধু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ: আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই পৃথিবীর খলিফা বানিয়েছেন, যার মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বও অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু আজকের উন্নয়নের নামে বনভূমি ধ্বংস, নদী ও বাতাসের দূষণ এবং প্রাণপ্রবাহের ক্ষতি আমানতের এই দিকটিকে উপেক্ষা করছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীতে পুনরায় বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)
প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো এটিকে সংরক্ষণ করা, অপচয় রোধ করা এবং সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখা।
আরও পড়ুনপ্রলোভনের এই যুগে নিজেকে রক্ষার উপায়০২ আগস্ট ২০২৫আমানতের নষ্টের ভবিষ্যদ্বাণীনবীজি (সা.) আমানতের অবক্ষয় সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন: ‘মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৫)
এই হাদিসটি একটি গভীর সতর্কবাণী। এটি ইঙ্গিত করে যে একটি সময় আসবে যখন বিশ্বস্ততা এতটাই বিরল হয়ে পড়বে যে একজন আমানতদার ব্যক্তিকে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করা হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী আধুনিক সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে স্বার্থপরতা ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬আমানতের পুনর্জাগরণের উপায়আমানতের মূল্যবোধকে পুনরায় জীবন্ত করতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:
সত্যবাদিতা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা: কথা ও কাজে সততা বজায় রাখা এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করা।
দায়িত্বশীলতা ও সততা: পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ।
ন্যায়পরায়ণ আর্থিক আচরণ: ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততা।
প্রকৃতির প্রতি যত্ন: পরিবেশ সংরক্ষণ, অপচয় রোধ ও সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা।
পারস্পরিক সহযোগিতা: সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য গড়ে তোলা।
আমানত শুধু একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি ইবাদত, যা আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্যের প্রকাশ। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। আমানতের চর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে আমরা একটি দয়ালু, ন্যায়ভিত্তিক ও ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এটি আমাদের দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করবে।
আরও পড়ুনআখিরাতে বিশ্বাস সত্কর্মের অনুপ্রেরণা০৪ মে ২০১৮