ইস্তাম্বুলে রাশিয়া–ইউক্রেনের আলোচনায় প্রতিনিধি তালিকায় নাম নেই পুতিনের
Published: 15th, May 2025 GMT
তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য ক্রেমলিন প্রতিনিধিদের যেই তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম নেই। যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে আজ বৃহস্পতিবার রাশিয়া–ইউক্রেনের এ আলোচনা হওয়ার কথা।
আলোচনায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উপস্থিতি চেয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিয়েভের ভাষ্য, বৈঠকে পুতিন উপস্থিত না থাকার অর্থ এটাই যে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
এর আগে জেলেনস্কি বলেছিলেন, তিনি ইস্তাম্বুলে আলোচনায় অংশ নিতে রাজি আছেন। তবে পুতিনকেও তাতে অংশ নিতে হবে। তিনি পুতিনের সঙ্গে সামনাসামনি আলোচনায় বসবেন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পর পুতিন ও জেলেনস্কি সামনাসামনি হননি। পরবর্তীতে দুই দেশ যুদ্ধে জড়ায়। যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে ২০২২ সালের মার্চে ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেন একদফা আলোচনায় বসেছিল।
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় আজ দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে জেলেনস্কির বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।
আরও পড়ুনবৈঠকে পুতিনকে চান জেলেনস্কি, কী বলছে রাশিয়া১৩ মে ২০২৫তবে বিশ্ববাসীর নজর রয়েছে ইস্তাম্বুলের দিকে। অনেকেই পুতিন ও জেলেনস্কির সম্ভাব্য সামনাসামনি বৈঠকের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু ক্রেমলিনের প্রকাশিত প্রতিনিধিদের তালিকায় পুতিনের নাম নেই।
এক বিবৃতিতে ক্রেমলিন জানিয়েছে, ইস্তাম্বুলে বৃহস্পতিবারের আলোচনায় রাশিয়ার নেতৃত্ব দেবেন প্রেসিডেন্ট পুতিনের সহযোগী ভ্লাদিমির মেদিনস্কি।
আরও পড়ুনতুরস্কে পুতিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে রাজি জেলেনস্কি ১২ মে ২০২৫এর আগে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন পুতিন নিজেই। সোমবার থেকে ৩০ দিনের শর্তহীন যুদ্ধবিরতি শুরুর যে প্রস্তাব কিয়েভ ও তার পশ্চিমা মিত্ররা দিয়েছিল, তার পাল্টা হিসেবে ওই প্রস্তাব দেন তিনি। তবে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি মস্কো।
এদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনতে বড় ভূমিকা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের। তাই ইস্তাম্বুলে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অংশ নিতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।
আরও পড়ুনআলোচনার জন্য পুতিনের সঙ্গে জেলেনস্কির বসা উচিত: ট্রাম্প১১ মে ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানে হামলা যেভাবে যুদ্ধের নৈতিক যুক্তি পাল্টে দিল
গত ১৩ জুন ভোররাতে ইসরায়েল ইরানের ওপর আসন্ন হামলার আশঙ্কায় আক্রমণ চালায়। বিস্ফোরণের শব্দে ইরানের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে ওঠে। লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল ইরানের ফর্দো ও নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি, গবেষণাগার এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের বাসভবন। অভিযান শেষে দেখা যায় ইসরায়েল ৯৭৪ ইরানিকে হত্যা করেছে। ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে প্রাণ হারান ২৮ জন।
ইসরায়েল তাদের এ হামলাকে আগাম ‘আত্মরক্ষা’ বলে বর্ণনা করেছে। তাদের দাবি, একটি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে ইরান মাত্র কয়েক সপ্তাহ দূরে ছিল। কিন্তু ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদন—কোথাও এমন প্রমাণ মেলেনি। এ হামলা এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন ইরানি কূটনীতিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষদের সঙ্গে সম্ভাব্য একটি নতুন পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল।
সামরিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণের বাইরে এখানে একটি গুরুতর নৈতিক প্রশ্ন আছে। একটি রাষ্ট্র বর্তমানে যেটা করেনি; কিন্তু ভবিষ্যতে করার আশঙ্কা আছে, এমন যুক্তির ভিত্তিতে এত বড় ধ্বংসাত্মক হামলা চালানো নৈতিকতার বিচারে কি ন্যায্য? বাকি পৃথিবীর জন্য এ ঘটনা কোন নজির স্থাপন করল?কিন্তু সামরিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণের বাইরে এখানে একটি গুরুতর নৈতিক প্রশ্ন আছে। একটি রাষ্ট্র বর্তমানে যেটা করেনি; কিন্তু ভবিষ্যতে করার আশঙ্কা আছে, এমন যুক্তির ভিত্তিতে এত বড় ধ্বংসাত্মক হামলা চালানো নৈতিকতার বিচারে কি ন্যায্য? বাকি পৃথিবীর জন্য এ ঘটনা কোন নজির স্থাপন করল?
নৈতিকতাবিদ ও আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা ‘প্রি-এম্পটিভ’ যুদ্ধ ও ‘প্রিভেন্টিভ’ যুদ্ধের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজনরেখা টেনেছেন। প্রি-এম্পটিভ যুদ্ধ হয় আসন্ন হুমকির প্রতিক্রিয়ায়। অপর দিকে প্রিভেন্টিভ বা প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ চালানো হয় ভবিষ্যতের কোনো সম্ভাব্য হুমকির আশঙ্কা থেকে।
শুধু প্রথম ধরনের যুদ্ধটিই নৈতিকতার বিচারে গ্রহণযোগ্য। তথাকথিত ক্যারোলাইন সূত্রে দেখা যায়, প্রি-এম্পটিভ হামলা তখনই ন্যায্য হতে পারে, যদি হুমকিটি হয় ‘তাৎক্ষণিক, চরম এবং এমন অবস্থায় যে বিকল্প কোনো উপায় নেই’। কিন্তু ইসরায়েলের ইরান আক্রমণ এসব পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। ইরান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করছিল না। কূটনৈতিক পথও পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল না। এ হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের যে ঝুঁকি ছিল (তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়া), তা সামরিক প্রয়োজনীয়তার সীমা বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে।
আইন নৈতিক বিধিনিষেধের প্রতিফলন করে। জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো ৫১ অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদটিতে কোথাও সশস্ত্র আক্রমণ হলে, তারপর আত্মরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল যে ‘পূর্বসতর্কতামূলক আত্মরক্ষা’র কথা বলেছে, সেটি একটি বিতর্কিত আইনি প্রথার ওপর দাঁড়িয়ে তারা বলছে। এটি কোনো স্বীকৃত চুক্তিভিত্তিক আইন নয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলের হামলাকে ‘একটি নগ্ন আগ্রাসন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই আইন লঙ্ঘনের ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনব্যবস্থার ভিতকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে। একটি রাষ্ট্র বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রি-এম্পশন বা আগাম হামলার যুক্তি দাঁড় করাতে পারে, তাহলে অন্যরাও তা করবে। যেমন চীন তাইওয়ানের কাছে টহলদারি দেখে আক্রমণ করতে পারে কিংবা পাকিস্তান ভারতের কথিত সামরিক তৎপরতাকে কেন্দ্র করে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। এটি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করবে।
ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বনকারীরা যুক্তি দিতে পারেন, অস্তিত্বের হুমকি থাকলে তখন চরম পদক্ষেপ গ্রহণ করা ন্যায্য। ইরানের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন এবং নিয়মিতভাবে হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিলেন।
এখানে যে ঐতিহাসিক ক্ষত আছে, সেটা বাস্তব। কিন্তু দার্শনিকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে বক্তব্য তা যতই বিদ্বেষপূর্ণ হোক না কেন, সেটা কাজের সমান নয়। উসকানিমূলক বক্তব্য আর সশস্ত্র হামলার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। যদি শুধু কথাটাই যুদ্ধ শুরুর ন্যায্যতা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে যেকোনো দেশই অপছন্দের বক্তৃতাকে অজুহাত বানিয়ে আগাম হামলা চালাতে শুরু করতে পারে। ফলে বিশ্ব ‘আদিম রাষ্ট্রের’ দশায় ঢুকে যেতে পারে, যেখানে প্রতিটি উত্তেজনাকর মুহূর্ত যুদ্ধ শুরুর অজুহাত হয়ে দাঁড়াবে।
ড্রোন নজরদারি আর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাগুলো যখন প্রতিদিনের ভূরাজনীতিতে ঢুকে পড়ে, তখন যুদ্ধ হয়ে ওঠে স্বাভাবিক বিষয়। আর শান্তি হয়ে যায় ব্যতিক্রমী ঘটনা।
● হোসেইন দাব্বাঘ নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি লন্ডন–এর দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
আল–জাজিরা ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত