পররাষ্ট্রনীতিতে জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে যে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ
Published: 29th, May 2025 GMT
সময় তার নায়কদের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। আর সময়ের সাহসী সন্তানেরা ওই ক্ষেত্রকে নিজেদের করে নেন। আমাদের ইতিহাসের এমন এক চরিত্র জিয়াউর রহমান। সামরিক ও রাজনৈতিক—উভয় ক্ষেত্রেই তাঁকে মনে রাখতে হবে আমাদের।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আজ ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। আমাদের রাজনীতিতে তিনি এক শক্তিশালী চরিত্র। গভীরভাবে তিনি প্রাসঙ্গিক। তিনি এমন একসময় ক্ষমতায় এসেছিলেন, যখন বাকশালের একদলীয় শাসনে দেশ ক্ষতবিক্ষত। একমুখী পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ সীমিত।
বর্তমান সরকারও এক রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংগ্রামের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। যেমন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের জন্য করিডর ও বন্দর পরিচালনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে দেশের রাজনীতি এখন বেশ উত্তপ্ত। উত্তাপ এতটা ছড়িয়েছিল যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের কথা পর্যন্ত ছড়িয়েছিল। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনী নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। অপর দিকে সরকার এ দুটি বিষয়ে অগ্রসর হতে চায় রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রক্রিয়ায় যুক্ত না করেই।
করিডর প্রদান ও বন্দরে বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অংশ। বর্তমান সরকারের জন্য এই দুটি বিষয় খুবই স্পর্শকাতর। সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, পররাষ্ট্রনীতির কঠিন ও জটিল বিষয়গুলো তারা সামাল দিতে পারছে না। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অরাজনৈতিক সরকারকে খুবই কৌশলী হতে হবে। অন্যথায় সমূহ বিপদের সম্মুখীন হতে পারে দেশ। অভ্যন্তরীণ বিষয় ছাড়াও পড়তে পারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপের মুখে। এই সরকার জিয়াউর রহমানের বাকশাল–পরবর্তী সময়ে সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনানীতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে পরারাষ্ট্রনীতিতে সরকার জিয়াউর রহমানের কৌশল অবলম্বন করতে পারে।
জিয়াউর রহমান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করেন। স্বাধীনতা–উত্তরকালে ১৯৭৫–এর ৭ নভেম্বরের পর আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ওই সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করলে উল্লেখ পাওয়া যায় কিছু সাধারণ বিষয়ের।
জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় ছিল জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা। সব ধরনের উপনিবেশবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করা। জাতিসংঘ ও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ঘোষণার প্রতি অবিচল থাকা।
জিয়াউর রহমান শুরুতেই একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে উদ্যোগ নেন। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এর আগে ভারতের নীতিই অনুসরণ করত বাংলাদেশ।
অনেকে সমালোচনা করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির সম্প্রসারণ বলেই উল্লেখ করতেন। কারণ, ভারতের মতোই বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দিকে ঝুঁকেছিল। স্বভাবতই ভারত পরবর্তী সময় বাংলাদেশের স্বাধীন বৈদেশিক নীতির অবস্থানকে মেনে নিতে চায়নি। ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান ভারত সফরে গেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি প্রশ্নের মুখে পড়েন, কেন বাংলাদেশ ভারতকে বাদ দিয়ে অন্য দেশ থেকে বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করছে। জিয়া ভারত থেকে ফিরে আসার এক মাস পরেই ঢাকায় ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতির একটি প্রদর্শনী হয়।
ভারতের সঙ্গে চুক্তি ছাড়াও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করে বাংলাদেশ। ১৯৭৮ সালে আরাকান থেকে সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের মুখে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। ওই সময় মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা হয়। ১৯৭৯ সালে সীমানা নির্ধারণের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।জিয়ার সময় বাংলাদেশ ভারতের প্রভাব থেকে বের হতে চেয়েছিল। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের বিপরীতে শক্তির ভারসাম্য আনতে উদ্যোগী হয় বাংলাদেশ। ফারাক্কার পানি প্রত্যাহার, সীমান্তে হত্যা—এসব বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সমাধান সম্ভব ছিল না বিধায় বাংলাদেশ অন্যান্য দেশকে সঙ্গে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করে। এ জন্য সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভারতের এক তরফা সিদ্ধান্তের বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ভূমিকা পালন করে এই অঞ্চলের রাজনীতিতে ভারসাম্য আনাই ছিল সার্ক গঠনের মূল উদ্দেশ্য।
অপর দিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো উত্থাপন করে সমাধানের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গঙ্গা নদী থেকে ভারতের একচেটিয়াভাবে পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। এতে করে ভারত কিছুটা চাপের মুখে পড়ে যায়। ১৯৭৭ সালে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গা পানিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য গঙ্গার পানির ৮০ শতাংশ সরবরাহের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
এর আগে ১৯৭৫ সালের জুনে ফারাক্কা বাঁধ ভারত পরীক্ষামূলক চালু করার কথা বলে একচেটিয়াভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে তিন বিঘা করিডর হস্তান্তরের রূপরেখা তৈরি করা হয়। আলোচনা ও যৌথ জরিপের মাধ্যমে তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত ঐকমত্যে উপনীত হয়। আন্তর্জাতিক দর–কষাকষিতে ‘ফ্রি রাইড’ বলে একটি ধারণা আছে। ফ্রি রাইড হচ্ছে, আলোচনার টেবিলে প্রতিপক্ষকে বিনা শর্তে মাঠ ছেড়ে দেওয়া। ওই সময় বাংলাদেশ কখনোই ভারতকে ফ্রি রাইড দেয়নি। অথচ ১৯৭৫ সালে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই ফারাক্কা চালুর অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশ ভারতকে ফ্রি রাইড দিয়েছিল। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ওই সময় বাংলাদেশ অনেক কৌশলী ছিল।
ভারতের সঙ্গে চুক্তি ছাড়াও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করে বাংলাদেশ। ১৯৭৮ সালে আরাকান থেকে সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের মুখে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। ওই সময় মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা হয়। ১৯৭৯ সালে সীমানা নির্ধারণের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এ সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদে নির্বাচিত হয়। ১৯৭৭ সালে জোট নিরপেক্ষ ব্যুরোর সদস্য, ১৯৭৯ সালে জেরুজালেম কমিটি ও ১৯৮১ সালে ইসলামিক শীর্ষ কমিটির সদস্যপদে নির্বাচিত হয়। ওই সময় কমপক্ষে ২০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ।
ক্রমান্বয়ে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নতুন নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্গঠনের জন্য সহায়তা আসতে থাকে। ১৯৮১ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার জন্য জিয়াউর রহমান একটি একক কমিশনের সদস্য হিসেব কাজ শুরু করেন। তিনি উভয় দেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু আলোচনাকে আরও এগিয়ে নেওয়ার আগেই তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। এর পাশাপাশি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করে। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমান চীন সফর করেন। ওই সফরে চীনের সঙ্গে সামরিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় ১৯৮০ সাল পর্যন্ত চীন থেকে বাংলাদেশ আট কোটি ডলার ঋণসহায়তা লাভ করে। চীন সামরিক সরঞ্জামাদি প্রেরণ করে। সামরিক সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
ওই সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির তিনটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সংহত করা। সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য চীনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। এটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির দ্বিতীয় কৌশল ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ন্যাটো বা ওয়ারশ জোটের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সম্পন্ন করে। জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা হয়। এই কারণে বাংলাদেশকে কোনো পক্ষের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
সব দেশের সঙ্গেই ভারসাম্যমূলক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ফলে বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তা ও বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়তে থাকে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্যে বিদেশি শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছিল। বিশাল এই শ্রমবাজার ধরার জন্য বাংলাদেশ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি জিয়াউর রহমান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গঙ্গার পানিচুক্তি ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে সমর্থ হন। এখানে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়েছিল। এই দুটি বিষয় দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সফলতা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের নিজস্ব ভাবমূর্তি গড়ে তোলার পাশাপাশি বড় শক্তি ভারত ও সমশক্তির মিয়ানমারকে বাংলাদেশের শর্ত মানতে বাধ্য করা।
মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন ত ত ক র জন ত র জন ত ক র সদস য র জন য আম দ র সময় ব ই সময় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ও জামায়াতের কাছে কেন আরপিওর ২১ ধারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল
নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে গত ছয় দিনে দল দুটির পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন আরপিওর ২১ ধারার সংশোধনীর পরিবর্তন। জামায়াত মনে করে, সরকার বিএনপির চাপে নতি স্বীকার করে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত খসড়া সংশোধনী বাতিল করেছে। আর বিএনপি মনে করে, জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ায় ২১ ধারার পরিবর্তন করে; যা গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়। আরপিওর ২১ ধারা সংশোধনীর ওই পরিবর্তন বহাল থাকলে কোনো দল জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে বাধ্য ছিল। ৩০ অক্টোবর সেটি আবার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাতে জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে জামায়াত বেশ ক্ষুব্ধ হয়।
যদিও সরকারের দিক থেকে এই নতুন সিদ্ধান্তের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সরকার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটি শুধু বিএনপির দাবির কারণে নয়, ছোট বিভিন্ন দলেরও দাবি ছিল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চিত করেছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই। আমরা সরকারের কথায় বিশ্বাস করি। সুতরাং এখন থেকে আমাদের সব কার্যক্রম নির্বাচনকেন্দ্রিক। এখন সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কীভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, সেটি তাদের বিষয়। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে যতটুকু সহযোগিতা দেওয়া দরকার, সেটা বিএনপি করবে।’
বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে...একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপিএ দিকে আজ সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা হবে। তবে অন্য দিন রাতে সভা হলেও আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় সভা বসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আজকের সভায় আলোচ্যসূচিতে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার বিষয় থাকবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে।
হঠাৎ কেন সামনে এল আরপিওর সংশোধনী
আরপিওর ২১ ধারার সংশোধন বিএনপি ও জামায়াতের কাছে হঠাৎ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়। এর পরেই সরকার আরপিওর ২১ ধারার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সিদ্ধান্তে বিএনপি উপকৃত হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিএনপি। অন্য দিকে এতে লাভবান হয় জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে ‘ভরসা’ হিসেবে দেখেন।
...যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছে না। সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নায়েবে আমির, জামায়াতএখন জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হলে ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে খুব আগ্রহী হবে না। এর কারণ দুটি। প্রথমত, বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে ভোটে জেতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীকে সরাতে বিএনপির নেতৃত্ব কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে প্রশ্নও আছে।
এ ছাড়া এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যে আটটি দল আছে, তারা আরপিওর ওই ধারা পরিবর্তনের পক্ষে। অর্থাৎ দলগুলো জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে—এর পক্ষে। এর জন্য দলগুলো যৌথ কর্মসূচিও করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াত যে নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করতে চাইছে, সে দলগুলো পরস্পর আস্থাশীল। তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ বা ‘রিকশা’ প্রতীক কোনো বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই ওই প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে কাজ করবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা নেই। অন্যদিকে বিএনপির জোটের ক্ষেত্রে ভাবনা হচ্ছে, ধানের শীর্ষ প্রতীক না দিলে ভোটের আগেই আসন হারানোর আশঙ্কা থাকবে।
গতকাল সকালে এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, একটি দলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে সরকার আরপিওর সর্বশেষ সংশোধনী বাতিল করেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাতিল করা হলে সেটি ন্যক্কারজনক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে।
আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়।ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের পর থেকেই উত্তাপ
২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে—সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন না করলে আপনা–আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হবে। এ ছাড়া গণভোট কবে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন নাকি তার আগে—সেটা ঠিক করবে সরকার।
চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহবিএনপি প্রথমত ক্ষুব্ধ হয় বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে ভিন্নমত বাদ দেওয়ায়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন, ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া, সেটা না হলে আপনা-আপনি সংবিধানে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে দলটির আপত্তি আছে। দলটি গণভোট আগে নয়, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে চায়। জামায়াতের অবস্থান এর পুরো বিপরীত।
এসব নিয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করে দল দুটির রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।
গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশে একটা অ্যানার্কিক সিচুয়েশন, একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে।’
জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।এর আগের দিন শনিবার বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে যতটা বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেটা আপনারা করেছেন।’
পাল্টা বক্তব্য এসেছে জামায়াতের দিক থেকেও। দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বিএনপি ভেতরে-ভেতরে আবার ফ্যাসিস্ট হওয়ার একটা খায়েশ আছে মনে হচ্ছে। যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছেন না।’
অবশ্য সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি যতই উসকানি দিক, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায় না। মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূর করে স্পষ্ট করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। সুতরাং আসুন আমরা সব ভুলে আলোচনায় বসি।’
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটা চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।