বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন বৃদ্ধা লাল বরু বিবি। ছোট ছেলে মার খোঁজ নেন না। আর বড় ছেলে ও ছেলের স্ত্রী ঘরে তালা লাগিয়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে চলে গেলে লাল বরু অসহায় হয়ে পড়েন। উঁচু ঘরে ওঠানামা করতে না পারায় নিরুপায় হয়ে মুরগির খোপে থাকেন, কখনও সেখানে ঘুমিয়েও থাকেন। ঘটনাটি পটুয়াখালীর লাউকাঠীর। এ নিয়ে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়।
গতকাল শনিবার সকাল ১০টার দিকে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বৃদ্ধা লাল বরুর অসহায়ত্বের করুণ চিত্র। তিনি শুয়ে আছেন মুরগির খোপে। আর অপেক্ষা করছেন কখন বিকেল হবে, কখন ছেলে আর তার স্ত্রী আসবেন, কখন তিনি ঘরে ঢুকবেন।
পটুয়াখালী শহরের পাশ দিয়ে বহমান লাউকাঠী নদী। এ নদীর উত্তরপ্রান্তে লাউকাঠী ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের লাউকাঠী নদীর কোলঘেঁষে লাল বরুর ছেলের ভাড়া বাসা। লাল বরুর বয়স পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই। বছর চারেক আগে স্বামী চাঁন মিয়া খান মারা যান। এরপর অসহায় হয়ে পড়েন লাল বরু। সন্তানদের কাঁধে ভর করে চলতে হয় তাঁর। বয়সের ভারে অচলপ্রায় তিনি। বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর আয়-রোজগারও। এ কারণে এই বয়সেও ভিক্ষা করতে হয় তাঁর। তা না হলে পারিবারিক তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। মেয়ে শাহানুর বেগম মারা গেছেন। দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে মো.
লাল বরু বলেন, ‘হাইট্টা চইল্যা আইয়্যা খোপের মধ্যে কাইতাইয়্যা-চিতাইয়্যা থাহি। মা’য় যখন কামাই করে আনতে পারেন তখন ভালো। হেরপর মায় খোপের মধ্যে বইয়্যা থাহে। হায়, দুঃখের হাজারি নাই, কারডে কমু দুঃখের কথা। দুইডা পোলা আছে, মাইয়্যাও আছিল একটা, তা আল্লাহ তা আলায় লইয়্যা গ্যাছে’।
লাল বরু খোপে থাকেন কেন জানতে চাইলে তার ছেলে মো. গোলাম মোস্তফা খান বলেন, ‘আমার মা খোপে থাকবে ক্যান? কষ্ট আমি করবো, আমার মা কষ্ট করবে কেন? মার যা যা লাগে তা সম্পূর্ণ আমি দেই। মাকে কখনও খোপে রাখি না। শুক্রবার কখনও যে মা’য় খোপে এসে ঢুকেছে তা আমি দেখিনি। মাকে খাওয়াবো নাতো কাকে খাওয়াবো? আম খাইতে চাইছে মা’য়, সঙ্গে সঙ্গে ৬ কেজি আম পাঠিয়ে দিছি’।
ছেলের বউ মোসা. রিনা বেগম বলেন, ‘আমাগো পেটে ক্ষুধা, তাই ভোরের সূর্য ওঠার আগেই ঘর খেইক্যা বাইর হইয়্যা কামে যাই আর আই বিকেলে। ঘর উঁচু হওয়ায় শাশুড়ি আম্মা একা ওঠানামা করতে পারেন না। তাই সে ওই খোপের মধ্যে বইয়্যা থাহেন। আমি আইলে পরে তখন ঘরে ঢুহেন। শুক্রবার আইয়্যা ওই খোপের মধ্যে বসা দেইয়্যা কিছু লোকজন মনে করছে আমরা তাকে খোপের মধ্যে রাহি’।
বড় ছেলের ঘরের নাতি শিপন খান বলেন, ‘আমার দাদিকে কেউ খোপের মধ্যে রাহে না। থাকে ঘরের মধ্যেই। কিন্তু বাইরে থেইক্যা ঘুইরা আইয়্যা ওই খোপের মধ্যে বইস্যা থাকে। আবার কখনও ঘুমাইয়্যাও থাকে। মা’য় কাজকর্ম সাইর্যা বিকেলে আইলে পরে দাদি ঘরে ওঠে। এরপর মা রান্নাবান্না করে, তারপর আমরা খাওয়া-দাওয়া করি’।
প্রতিবেশী নাসিমা বেগম বলেন, ‘বয়স্ক মানুষ- তাঁর তো ভুল-ত্রুটি থাকবেই। খোপে থাকে কিনা তা আমরা জানি না। তবে, তাঁর (লাল বরু) সঙ্গে তাঁর ছেলে ও ছেলে বউ ভালো আচরণ করেন না। সব সময় তাঁর সঙ্গে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেই থাকেন।
এ ব্যাপারে লাউকাঠী ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইলিয়াস বাচ্চু বলেন, ‘শুক্রবার রাতে খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওই বাড়িতে আমি ছুটে যাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে খবরটি প্রকাশ হয়েছে তা সঠিক নয়। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বাড়িতে কেউ থাকেন না। ঘরটি উঁচু হওয়ায় বৃদ্ধা লাল বরু একা ওঠানামা করতে পারেন না। তাই দিনের বেলা সে বাইরে খোপের মধ্যে কিছুটা সময় শুয়ে-বসে কাটান এবং বিকেলের দিকে ছেলে বউ চলে আসলে পরে সে (লাল বরু) ঘরে ওঠেন। এই হচ্ছে মূল ঘটনা। তারপরও এভাবে না করার জন্যও বৃদ্ধার ছেলে ও ছেলের স্ত্রীকে বলা হয়েছে। পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে কিছু আর্থিক সহায়তা করি’।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ বন স গ র ম ল ল বর
এছাড়াও পড়ুন:
এক দিনের ঘোরাঘুরিতে কাপ্তাই
ভ্যাপসা গরম। কখনও আচমকা বৃষ্টি। হুট করেই বয়ে যায় দমকা হাওয়া। কখনও আবার লাল টকটকে লিচু ঝুলে থাকা গাছের ছায়ায় জিরানো। দিগন্ত বিস্তৃত নীলাভ জল, পৌরাণিক কাহিনিসমৃদ্ধ নদীর ধার, সারি সারি পাম গাছের ফাঁক গলে হেঁটে যাওয়া, সড়কপথের কলিজা কাঁপানো বাঁক– এসব মিলিয়ে স্বল্প সময়ে ঘুরে আসার মতো এক স্থান প্রকৃতিকন্যা কাপ্তাই।
তারিখটা ছিল ৩০ এপ্রিল। পরপর তিন দিন ছুটি। ছুটি মানে ভ্রমণে বের হওয়ার জন্য মন থাকে পাগলপারা। রাত ১১টায় বাস। দে-ছুট ভ্রমণসংঘের সঙ্গী সবাই বাস কাউন্টারে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১০টা ছুঁইছুঁই করলেও আমার তখনও যাওয়া হয়নি। পরদিন ১ মে শ্রমিক দিবসে অনুষ্ঠান ছিল। পরে নানা ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে শেষ মুহূর্তে জনপথ মোড়ে পৌঁছাই। প্রচণ্ড জ্যামের কারণে বাস একটু দেরিতে ছাড়ল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সিটে বসলাম বেশ আয়েশ করে। ভোরে পৌঁছাই কাপ্তাই। বন্ধু রতনের কল্যাণে সরকারি এক বিশ্রামাগারে আগেভাগে রুম ঠিক করা ছিল। রুমে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গেলাম আসাম বস্তির দিকে। যেতে যেতে বাঙাল হালিয়া পাহাড়ি বাজারে ব্রেক। কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই লেকের মাছ আর ফলের পসরা মেলে রেখেছেন পাহাড়িরা। টক-মিষ্টি লিচুর স্বাদ নিই। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি হাটবাজারের ভিন্নমাত্রার বৈশিষ্ট্য থাকে, যা ভ্রমণপিপাসুকে বেশ আকৃষ্ট করে। তরতাজা মাছ কেনার ইচ্ছা দমিয়ে ছুটলাম মূল গন্তব্যে। পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলা সড়ক। উঁচু-নিচু, ঢালু। এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে কাপ্তাই লেকের নীলাভ জলরাশি। বয়ে চলা পানির বুকে ছোট্ট করে মাথা জাগিয়ে রাখা মাটি। সেই মাটি ভেদ করে শিরদাঁড়া উঁচু করে রয়েছে বৃক্ষরাজি। চমৎকার সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। এমন নৈসর্গিক পরিবেশে মুগ্ধ নয়নে যেতে যেতে হঠাৎ লাল টসটসে লিচু বাগান দেখে চোখ আটকায়। গাড়ি থামিয়ে চলল ফটোশুট। কোথাও কোথাও পথের ধারে কৃত্রিম ও প্রকৃতির সম্মিলনে পর্যটকদের জন্য সাজগোজ করে রাখা হয়েছে নানা স্থাপনা। কোথাওবা সড়কের পাশে কংক্রিটের বেঞ্চ। তবে কাঠ-বাঁশের হলে প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে যেত বেশ। ব্রিজ পর্যন্ত যেতে আরও কয়েকবার থেমেছি। পথের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমাদের থামতে বাধ্য করেছে। জুমের কলা, পেঁপে, আনারসের ছিল সেই স্বাদ। যেতে যেতে কাঙ্ক্ষিত ব্রিজ। সত্যিই অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা সর্পিল আসাম বস্তি ব্রিজ। মাথার ওপরে নীল আসমান। ডানে-বামে কাপ্তাই লেকের টলটলে পানি। সামনে তাকালে এঁকেবেঁকে যাওয়া ব্রিজটি চলে গেছে বহুদূর। তপ্ত রোদেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমুগ্ধ নয়নে ব্রিজের রেলিং ধরে তাকিয়ে থাকা যাবে লেকের জলে। ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এটি একটি কৃত্রিম হ্রদ। বর্তমানে এই হ্রদ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। অথচ এর পেছনের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ। বাঁধটি নির্মাণের সময় রাঙামাটি জেলার প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি পানিতে ডুবে সৃষ্টি হয় হ্রদ। বাদ যায়নি রাঙামাটির রাজবাড়িটিও। এক রাতের মধ্যে বহু বসতবাড়ি পানির তোড়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সব সুন্দরের পেছনের ইতিহাস হয়তো অনেকটা এ রকমই হয়ে থাকে। বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদ দেশের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট হ্রদ। এর গভীরতা ১০০ ফুট থেকে কোথাও কোথাও প্রায় ১৭৫ ফুট পর্যন্ত। সবুজের সঙ্গে মিতালি করা কাপ্তাই লেকের আয়তন ৪ হাজার ২৯৪ বর্গমাইল। এই লেকের মাছ বেশ সুস্বাদু। রাঙামাটির স্থানীয় বাসিন্দাসহ ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের রসনা মেটানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হয়ে থাকে এ মাছ। বিশেষ করে, রুই ও চাপিলা মাছের জুড়ি মেলা ভার।
বেশ মজা করে দুপুরের খাবার সারলাম এক রেস্তোরাঁয়। এরপর নামমাত্র বিশ্রাম নিয়ে ছুটলাম শীলছড়ির পথে। কাপ্তাই বাজার থেকে সড়কের রোমাঞ্চকর বাঁকগুলো পেরিয়ে ২৫ মিনিটে হাজির হলাম কর্ণফুলী নদীর তীরে লুসাই পাহাড়ের সন্নিকটে, শীলছড়ি ৩৫ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের মূল ফটকে। এক বন্ধু সেখানকার কর্মকর্তা। সে এসে অভ্যর্থনা জানায়। এতে যারপরনাই আন্দোলিত হই। গেস্টরুমে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ক্যাম্পাসের সোনালি অতীতের স্মৃতিচারণ চলে। এরই মধ্যে মৌসুমি নানা ফল আর শরবতের গ্লাস দিয়ে ডাইনিং সয়লাব। এত কিছু খেতে গেলে সুন্দর বিকেলটাই হারিয়ে যাবে। সেই ভয়ে সেলিমকে তাড়া দিতে আমাদের নিয়ে গেল কর্ণফুলীর কূলে। জায়গাটা এত বেশি নয়নাভিরাম ও পরিচ্ছন্ন, প্রথম দেখাতে মনে হবে না যে এটি আমাদের দেশ। সারি সারি পাম গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দৃষ্টিসীমায় মাথা উঁচু করা লুসাই পাহাড়। সবুজের গালিচা দিয়ে মোড়ানো। সেই পাহাড়ে বসবাস করে নানা আদিবাসী গোষ্ঠী। পাহাড়ি নদীর বয়ে চলা পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ঝিরঝির বাতাসের দোল, জুম ঘরের আদলে তৈরি ছাউনিতে বসে চায়ের আড্ডা– সব মিলিয়ে সুন্দর একটি বিকেলের সাক্ষী হলাম। সময়ের পরিক্রমায় লাল টকটকে সূর্যটা লুসাইর বুকে থাকা গহিন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আমরাও ওই দিনের স্মরণীয় ভ্রমণের ইতি টেনে বিশ্রামাগারে ফিরি। চাইলে কেউ এক দিন ঘোরাঘুরি করে রাতের বাসে ঢাকায় ফিরতে পারেন। ঈদের ছুটিতেও কাপ্তাইয়ে হতে পারে দু-এক দিনের একটি ভ্রমণ।
আমরা পরদিন সকালে গিয়েছিলাম কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। পরিচিত একজনের মাধ্যমে প্রবেশের অনুমতি মেলে। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। হাঁটতে হাঁটতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে এসে হাজির। পাশাপাশি দুটো ভবন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৫৪ সাল। এর পুরোনা ভবনে আশির দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির শুটিং হয়েছিল। ভ্রমণ বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষা লাভেরও একটি বড় মাধ্যম। পুরো পৃথিবীই একটি আদর্শ বই, যা ভ্রমণের দ্বারা পাঠ করা সম্ভব। v