১৪ বছর আগের কথা। বিরল ও দুর্লভ পাখির প্রজনন প্রতিবেশ নিয়ে গবেষণার কাজে পঞ্চগড় এসেছি। বোদা, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গাঙটিটি, হলুদ লতিকা হট্টিটিসহ বেশ কিছু প্রজাতির পাখি দেখলাম। সবশেষে ভারত সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়ার কাজীপাড়া এসে ওদের সঙ্গে যোগ হলো অতি বিরল শেখ ফরিদ বা কালো তিতির। কিন্তু এসব পাখির মা ক্ষণে ক্ষণেই খুঁজছিলাম চড়ুই আকারের অতি বিরল আরেকটি পাখিকে। তেঁতুলিয়া শহরের রাস্তার পাশে এই পাখিকে ২০১০ সালে বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী প্রয়াত মুনির আহমেদ খান ও তাঁর স্ত্রী পক্ষী আলোকচিত্রী তানিয়া খান দেখেছিলেন। এর পর থেকেই পাখিটিকে দেখার ইচ্ছা। কিন্তু মাত্র এক বছর পর জায়গামতো বারবার গিয়েও পাখিটির দেখা পেলাম না।
এরপর ২০১৭ সাল পর্যন্ত আরও তিনবার তেঁতুলিয়া গেলাম। কিন্তু ফলাফল একই। অবশ্য ২০২০ সালে একজন আলোকচিত্রী রাজশাহীর পদ্মার চরে পাখিটির দেখা পান। এরপর ২০২৩ সালে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বেড়ামন গাঁও চরে বার কয়েক দেখা গেল। অনেকেই ছবি তুললেন। খবর পেয়ে ১১ নভেম্বর পাখিটির সন্ধানে পাখিপ্রেমী আমরা ১১ জন শীত শীত ভোরে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। মাওয়ার পুরোনো ফেরিঘাটে নেমে জাকির মাঝির ইঞ্জিন নৌকায় চরের দিকে রওনা হলাম। পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে আমাদের নৌকা যাওয়ার সময় সেতুর সঙ্গে একটা ফটোসেশন হয়ে গেল।
ঠিক ৫০ মিনিট প্রমত্ত পদ্মার বুকে চলার পর নৌকা চরে ভিড়ল। চরের মাটিতে পা রাখতেই স্ত্রী পাখিটির দেখা পেয়ে গেলাম। যে পাখিকে দীর্ঘ সাত বছর ধরে খুঁজছি, আজ তাকে অতি সহজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। স্ত্রী পাখিটির প্রথম ছবি তোলার ১১ মিনিট পর পুরুষটির দেখা পেলাম। কিন্তু ওর একটি ভালো ছবি তোলার জন্য প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো। পরে পাখিটিকে শেরপুরেও দেখা গেল।
এতক্ষণ বিরল যে পাখিটির গল্প বললাম, সেটি এ দেশের আবাসিক পাখি বালুচাটা বা ধুলচাটা। ইংরেজি নাম অ্যাশি-ক্রাউন্ড স্প্যারো-লার্ক বা ফিঞ্চ-লার্ক। অ্যালাইডিডি গোত্রের এই ভরত পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Eremopterix grisea। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে।
বালুচাটা চড়ুই আকারের কীটপতঙ্গভুক পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ১২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ১৪ থেকে ২০ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষের চেহারায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পেছনটা ধূসর-বাদামি। চোখ বরাবর চওড়া কালো পট্টি। পিঠ বালু-বাদামি। ডানার পালক কালচে ছোপছাপে ভরা। গাল থেকে কান-ঢাকনি ও বুকের দুই পাশ ময়লা সাদা। গলার অর্ধেকটায় কালো রঙের ফিতে। বুক-পেট ও দেহের নিচ চকলেট কালো। অন্যদিকে স্ত্রী একবারেই সাদামাটা। পিঠ ও দেহতলের ওপরে কিছু সূক্ষ্ম লম্বালম্বি দাগসহ দেহ পুরোপুরি বালু-বাদামি। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে চঞ্চু খাটো ও ত্রিকোণাকার, রং হালকা, শিং-ধূসর। চোখ লালচে/হলদে-বাদামি। পা, পায়ের পাতা ও নখ মেটে-বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে অনেকটা মায়ের মতো।
এ পর্যন্ত এদেরকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং ও শেরপুরের চরাঞ্চলে দেখা গেছে। খোলামেলা শুষ্ক পাথুরে এলাকা, কণ্টকময় ঝোপঝাড় ও ঘাসে ঢাকা পরিত্যক্ত খেত, বালুময় নদীতট বা শুকনা জোয়ার–ভাটার কাদাচরে এরা বিচরণ করে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে বালুমাটিতে ঘোরাঘুরি বা ধূলিস্নান করতে দেখা যায়। তবে শীতে বড় দলে থাকতে পারে। মাটিতে হেঁটে হেঁটে শুকনা ধূলিময় ভূমি ঠুকরে বিভিন্ন ধরনের বিচি, শক্ত খোলসযুক্ত পোকামাকড়, পিঁপড়া ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ খায়। পুরুষ পাখি বৃত্তাকারে উড়ে উড়ে বাঁশির মতো ‘টুইল-ডিডল-ডিডল.
বছরের যেকোনো সময় প্রজনন করতে পারে। মাটির প্রাকৃতিক খোদলে ঘাস, পালক ও চুল বিছিয়ে বাসা বানায়। বাসার চারদিকে নুড়ি পাথর দিয়ে বেষ্টনী দেয়। অল্প দূরত্বের মধ্যে একাধিক বাসা পাওয়া যায়। ডিম পাড়ে ২ থেকে ৩টি; রং ধূসর-সাদা বা ফিকে হলুদ, তাতে থাকে বেগুনি ও বাদামি ফুটকি ও ছোপ। ডিম ফোটে ১১ থেকে ১৪ দিনে। ১০ থেকে ১২ দিনে ছানারা উড়তে শেখে। মা-বাবা মিলেমিশে ডিমে তা দেওয়া এবং ছানাদের লালন পালন করে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কুলিয়ারচরের ব্যাংকটিতে কী হয়েছিল দেখা গেল সিসিটিভি ফুটেজে
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে আইএফআইসি ব্যাংকের একটি উপশাখায় একসঙ্গে ছয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনার সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ হাতে পেয়েছে পুলিশ। আজ সোমবার সকালে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেছে তারা।
ঘটনার পর থেকে সিসিটিভি ফুটেজকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচনায় নিচ্ছে পুলিশ। গতকাল রোববার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময়ের ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেলা একটার কিছু আগে ব্যাংকে কয়েকজন গ্রাহক আসেন এবং লেনদেন শেষে চলে যান। এরপর বেশ কিছুক্ষণ ব্যাংকে আর কোনো গ্রাহক ঢোকেননি। গ্রাহকশূন্য ব্যাংকের ভেতর হঠাৎ হিসাব বিভাগের কর্মী হোসনা রহমান হেলে পড়ে যান এবং বমি করতে থাকেন। এরপর একে একে আরও পাঁচজন কর্মী হেলে পড়েন। তাঁদের মধ্যে দুজন নারী। কেউ কেউ অর্ধ-অচেতন অবস্থায় বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে শাখা ব্যবস্থাপক সৌমিক জামান খানসহ দুজন চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেননি। তাঁদেরও বমি করতে দেখা যায়।
ফুটেজে দেখা গেছে, নিরাপত্তাকর্মী কামাল হোসেন তুলনামূলকভাবে সুস্থ ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যান এবং টেলিফোন ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু সফল হননি। টেলিফোন ধরতে গিয়ে কাচ ভেঙে ফেলেন। এ অবস্থায় একজন গ্রাহক ব্যাংকে প্রবেশ করলে কামাল হোসেন তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। ওই গ্রাহক দ্রুত নিচে নেমে যান। কিছুক্ষণ পর ভবনের আরেক নিরাপত্তাকর্মী জুয়েল মিয়া এসে অন্যদের সহযোগিতায় অসুস্থ ব্যক্তিদের বাইরে বের করে আনেন।
আরও পড়ুনব্যাংকের ভেতরে পড়ে ছিলেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, করছিলেন বমি২০ ঘণ্টা আগেভৈরব-কুলিয়ারচর সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নাজমুস সাকিব ও কুলিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন আজ সকালে ফুটেজের এসব তথ্যের কথা প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। ফুটেজ পর্যালোচনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে, ঘটনাটি নাশকতা নয়। ডাকাতির ঘটনাও নয়। ব্যাংকের টাকা পয়সা এদিক-ওদিক হয়নি। ভল্ট ও ক্যাশবাক্স অক্ষত আছে।
পুলিশের সন্দেহ জেনারেটর ঘিরে। ব্যাংকের ভেতরের একটি বন্ধ ঘরে রাখা ছিল জেনারেটরটি, যদিও তা বাইরে রাখার নিয়ম। দুর্ঘটনার দিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর চার ঘণ্টা ধরে চলছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকেই বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়ে থাকতে পারে।
ওসি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। সিআইডির ক্রাইম টিম ঘটনাস্থল থেকে খাবার, পানি, চা ও বমির নমুনা সংগ্রহ করেছে। পরীক্ষার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে আসল কারণ।’
গতকাল দুপুরে ব্যাংকের কর্মীরা একে একে অচেতন হতে শুরু করেন। এ ঘটনার পর ব্যাংকের ভেতরের চিত্র