রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুরের হাট ঘুরে তিন মণ ওজনের একটি গরুর দাম করছিলেন মালিবাগের আনিসুর রহমান। বিক্রেতা দাম হাঁকিয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার। তবে তিনি ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত বলেছেন। ব্যাপারী কবির মিয়া শেষ দাম ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বলে দিয়েছেন।

একই ধরনের আরও চারটি গরু এই দামে বিক্রি করেছেন তিনি। বাকি থাকা দুটি এর নিচে বিক্রি করতে পারবেন না বলে জানান তিনি। ক্রেতা-বিক্রেতার দামাদামির এ দৃশ্যই ছিল গতকাল বুধবার রাজধানীর সব হাটজুড়ে।

পশুর হাটে ছোট ও মাঝারি গরুর বিক্রি বেশি হচ্ছে। হাটে ছোট দুই মণ ওজনের গরু ৬০-৭০ হাজার, তিন মণ ওজনের ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ-ছয় মণ ওজনের গরু ১ লাখ ৪০ থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ছাগল পাওয়া যাচ্ছে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে গত রোববার ১৬টি গরু নিয়ে উত্তর শাহজাহানপুর পশুর হাটে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। সমকালকে তিনি জানান, তিস্তার চর এলাকায় নিজ খামারের ১০টি আর বাকি ছয়টি গরু কিনে এনেছেন। এর মধ্যে ১২টি গরু বিক্রি করেছেন। ছোট আড়াই মণ ওজনের গরু বিক্রি করেছেন ৭০ হাজার আর পাঁচ মণ ওজনের গরু বিক্রি করেছেন ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা করে। 

এই হাটে ফরিদপুর থেকে ৪০টি ছাগল এনেছেন রশিদ মিয়া। ৮ থেকে ১০ কেজি ওজনের ছাগলের দাম চাচ্ছেন ২০ হাজার টাকা। তবে ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি করবেন। বড় ২৫-৩০ কেজি ওজনের ছাগলের দাম হাঁকিয়েছেন ৪০ হাজার টাকা। ৩০ হাজার টাকা হলে বিক্রি করবেন। 
এই হাটের ইজারাদার আনিসুর রহমান টিপু সমকালকে বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত থেকেই হাট জমে উঠেছে। ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের গরু এক থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। হাটে ছাগলও এসেছে পর্যাপ্ত।’

গাবতলীর পশুর হাটে এবারও এসেছে মরুর উট। ভারতের রাজস্থান থেকে আনা বিশালদেহী পুরুষ উটটি হাটজুড়ে কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ সেলফি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন, আবার কেউ কেউ ইউটিউব কনটেন্ট বানাতেও ব্যস্ত। বিক্রেতা ১০ ফুটের বেশি উচ্চতা ও ২৮ মণ ওজনের উটটির দাম হাঁকাচ্ছেন ৩০ লাখ টাকা।

উটের দেখভালে থাকা মকবুল ইসলাম জানান, দু’দিন আগে ২৮ লাখ চেয়েছিলাম। এখন শুনছি, সারা শহরে একটা উটই আছে। তাই ৩০ লাখ বলছি।
গাবতলী হাটে দেখা যায়, সারি সারি গরু-ছাগল সাজিয়ে রেখেছেন বিক্রেতারা। গতকাল দুপুরের পর থেকেই এই হাটে ক্রেতার উপস্থিতি বাড়ে। 

পশুর হাটে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

গতকাল দুপুরে রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুর মৈত্রী সংঘ ক্লাবসংলগ্ন কোরবানির পশুর হাট পরিদর্শনে আসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো.

জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)।

তিনি বলেন, অসুস্থ পশু যেন হাটে ঢুকতে না পারে, সে জন্য চেকআপের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ অসুস্থ বা আহত হলে যেন চিকিৎসা নিতে পারে, সে জন্য মেডিকেল টিম রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে এবারের কোরবানির ঈদের হাট ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক প্রস্তুতি অত্যন্ত ভালো। 

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা চাচ্ছি গরুর এমন একটা স্বাভাবিক দাম থাকুক, যেখানে কৃষক বা খামারি লাভবান হয় এবং ক্রেতাও লাভবান হয়। যাতে উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষিত হয় এবং কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গর ক রব ন র হ ট কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না

অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।

এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।

ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।

এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।

তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।

দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।

আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।

কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।

এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।

আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।

মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।

‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ