ইরানজুড়ে ব্যাপক ইসরায়েলি হামলার পর প্রতিশোধমূলক বড় হামলা চালিয়েছে ইরান। ইসরায়েলি শহরগুলোতে দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র হামলে পড়েছে। এই অবস্থায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এখন যুদ্ধ যুদ্ধ সাজ। এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সামরিক বাহিনী এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যে কোনো সময় যুদ্ধ সর্বাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কীভাবে এই ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তা নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। 

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুমকি দিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নির্মূল করতে যতদিন লাগে, ততদিন হামলা চলবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগ করতে ইরানকে হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন। ইরানে ইসরায়েলি হামলার কয়েক ঘণ্টা পর ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লেখেন, ‘ইরান যদি তার সাম্রাজ্য রক্ষা করতে চায়, অবশ্যই একটি চুক্তিতে আসতে হবে।’   

ঘটনাদৃষ্টে বলা যায়, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু ইরানের সঙ্গে একটি গেম খেলেছেন। তা হলো, একদিকে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার নামে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি চাপের মুখে ফেলবে, পাশাপাশি ইসরায়েল ব্যাপক হামলা চালিয়ে পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেবে। এই অবস্থায় চাপের মুখে ইরান সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে। 

কিন্তু এই কৌশল কাজে দেবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ, ইসরায়েলি হামলার পর ইরান ঘোষণা দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর আলোচনা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। এই পরিস্থিতিতে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রোধে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হয়েছে।
   
এখন ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসবে কিনা, কিংবা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে তেহরান পিছু হটবে কিনা– সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাছাড়া শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীদের অনেকে নিহত হওয়ায় কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা ইরানের আছে কিনা, সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোয় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে সরে যেতে পারে। 

মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো হুমকির মুখে পড়বে। ইতোমধ্যে ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কর্মীদের সরিয়ে নিয়েছে। এই অবস্থায় পক্ষ-বিপক্ষগুলোকে বিরত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সফল হবে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে চীন বা রাশিয়াও তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।   

জনস হপকিন্স স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রাক্তন ডিন ভ্যালি আর নাসর বলছেন, ‘ট্রাম্প হয়তো ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপকে দরকষাকষি হিসেবে দেখছেন। এটি একটি বড় জুয়া। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে প্যারিস থেকে মস্কো, ওয়াশিংটন থেকে বেইজিং ভূরাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টে যাবে।’  

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধের উত্তেজনা রোধ করা ট্রাম্পের জন্য চ্যালেঞ্জের হবে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ শুধু সংযমের আহ্বান জানাতে পারেন। কিন্তু ট্রাম্পই শুধু এখানে নির্ণায়ক ভূমিকায় আছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে ইরান ও ইসরায়েল উভয় পক্ষকেই চাপ প্রয়োগ করতে হবে। 

নাসর মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির এজেন্ডাকে উল্টে দিতে পারে। কারণ, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। তাছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলেও সেই সফলতা এখনও অধরা রয়ে গেছে। 

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের উত্তেজনায় ইতোমধ্যে তেলের দাম ১০ শতাংশেরও বেশি পড়ে গেছে। একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির ওপর আঘাত হানবে, যা বিশ্বকে আরেকটি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। এমনিতেই ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ অনেক দেশের বাণিজ্য প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে। 

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্নেগি এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো এবং ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ করিম সাদ্দাদপুর মনে করেন, হামাস, হিজবুল্লাহ এখন শক্তিহীন। এই অবস্থায় ইরানের একমাত্র ভরসা ছিল হুতি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রেখেছে। এখন ইরান যে পদক্ষেপই নিক না কেন, তাদের পরিণতি খারাপের দিকেই যাবে। তাছাড়া ইরানের সামরিক পরিকল্পনাবিদদের ইতোমধ্যে হত্যা করেছে ইসরায়েল। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল য ক তর ষ ট র এই অবস থ য় ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

চা বাগানের ন্যাড়া টিলায় নীল-লেজ সুইচোরাদের কোলাহল

মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার ইটা ও করিমপুর চা বাগানের মধ্যখানে লালচে রঙের ন্যাড়া টিলা। মাটি কেটে নেওয়ায় বির্পযস্ত সেই টিলার গা জুড়ে গর্ত করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে নীল-লেজ সুইচোরা পাখিরা।

নানা অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শণ করে দিনভর চলে উড়াউড়ি আর বেলা-অবেলাজুড়ে চলে নানা সুরের মনমতানো গান। গ্রীষ্মকালে এ এলাকায় বেড়াতে আসা পাখিদের মধ্যে অন্যতম এই নীল-লেজ সুইচোরা পাখি।

টিলার পাশে দাঁড়িয়ে একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালেই দেখা যায় টিলার গায়ে ছোট ছোট অসংখ্য গর্ত। গর্তগুলোর প্রতিটিই একেকটি বাসা, সুইচোরা পাখির বাসা। কোন কোন বাসায় বাচ্চা রয়েছে। আবার কোন বাসায় বসে ডিম তা দিচ্ছে স্ত্রী সুইচোরা।

বিকেলের পড়ন্ত রোদে টিলার গায়ের উঁচু গাছটির মরা ডালগুলোতে সরু, লম্বা ঠোঁট ও নীল লেজের কয়েকটি সুইচোরাকে বসে থাকতে দেখা গেল। কিছুক্ষণ পরপর তারা উড়ে গিয়ে শূন্য থেকে শৈল্পিক ভঙ্গিমায় পোকা ধরে নিয়ে আবারও গাছের ডালে গিয়ে বসছে। মা পাখিরা পোকা ধরে বাসায় নিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে।মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত প্রজননের জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত স্থানে বসবাস করে সুইচোরা পাখিরা। এরা আমাদের দেশীয় পাখি হলেও সব সময় একই অঞ্চলে বসবাস করে না এরা। তাই এদের অনেকে পরিযায়ী বলেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এরা পরিযায়ী বা আবাসিক পাখি নয়। এরা আমাদের স্থানীয় পাখি।

প্রকৃতি প্রেমি মুরাদ হোসেন বলেন, “এরা এদেশের আবাসিক ‘নীল-লেজ সুইচোরা’। ইংরেজী নাম Blue-tailed Bee-eater. Meropidae নাম এই পরিবারের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Merops Philippinus.”

স্থানীয়রা এদের ‘নীল চড়ুই’ বলে জানেন। তবে সবসময় এদের দেখা মেলে না। কেবল গ্রীষ্মকালেই কোথা থেকে যেন ঝাঁক বেঁধে চলে আসে এরা। 

করিমপুর চা বাগানের বাসিন্দা আইয়ুব আলী বলেন, “বাগানের পাশে পরিত্যাক্ত ন্যাড়া টিলার পেটে গর্ত করে গত তিনমাস ধরে পাখিগুলো বসবাস করছে। আগে ফি-বছর তারা আসলেও এখন আর আগেরমতো আসে না। মাঝে মাঝে এদের দেখা মেলে।”

ওই বাগানের বাসিন্দা দিপঙ্কর ঘোষ বলেন, “পাখি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বসবাস শুরু করে। কোন বাধা বিপত্তি এলে তারা চলে যায়। ৩/৪ বছর পর এদের দেখা মিলল। এরা এখানে নিরাপদে প্রজনন করতে পারছে। জুন মাসের শেষে তারা আবার চলে যাবে।”

শেখ কামাল ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টার গাজীপুরের পাখি বিশেষজ্ঞ আল্লামা শিবলী সাদিক বলেন, ‘‘নীল-লেজ সুইচোরা পাখিদের পরিযায়ী বা আবাসিক বলা যাবে না। এরা আমাদের দেশীয় পাখি। প্রজননের সময় তারা নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করে বলে এদের অনেকেই মনে করেন তারা পরিযায়ী বা আবাসিক। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তাদের প্রজনন সময়। এরা পাহাড়ি টিলার নরম মাটিতে গর্ত করে বসবাস করে। গর্তের মধ্যেই বাসা তৈরি করে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায়। পরে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য স্থানে চলে যায়।”

প্রাপ্তবয়স্ক এই পাখির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার, ওজন ৩৮ থেকে ৫০ গ্রাম। নীল-সবুজ পালক বিশিষ্ট পাখিটির পেছনের অংশ ও লেজ নীল। গলা খয়েরি, বুকের ওপরটা বাদামি, চোখে কাজল টানা এবং পেট আপেলের মতো সবুজ। 

চোখ লালচে বাদামি থেকে গাঢ় লাল। কোমর, লেজ ও লেজের নিচের অংশ নীল। লেজের আগায় লম্বা নীল সুই বা পালক রয়েছে। 

এদের ঠোঁট সরু, লম্বা ও কালো। নিচের দিকে খানিকটা বাঁকানো। পা ও পায়ের পাতা কালচে বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক নীললেজ সুইচোরার দেহের রং অনুজ্জ্বল ও ফ্যাকাশে। স্ত্রী ও পুরুষ একই রকম দেখতে।

এদের আয়ুষ্কাল প্রায় ছয় বছর। মার্চ থেকে জুন এদের প্রজননকাল। এসময় পাহাড়ের গায়ে বা নদী ও খালপাড়ে প্রায় দুই মিটার লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বাসা বানায় এরা। সেখানে ৫-৬টি ডিম পাড়ে, ডিমের রং সাদা। ২১-২৬ দিনে ডিম ফোটে এবং ২০-২৭ দিন পরে বাচ্চারা উড়তে শেখে।

ঢাকা/আজিজ/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ