মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্তে মৃত্যুর দায় কার?
Published: 22nd, July 2025 GMT
নির্বাক সময়ের এক বেদনাময় প্রশ্ন এখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে—এই শিশুদের মৃত্যুর দায় কার? উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আকাশে-বাতাসে পোড়া শরীরের গন্ধ, ভবনের ভিতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রক্তাক্ত বইখাতা আর পোড়া ইউনিফর্ম—সব মিলিয়ে যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রান্তর। কিন্তু এটি কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, ছিল একটি স্বপ্নময় শিক্ষাঙ্গন, যেখানে কিশোর-কিশোরীরা নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বুক বেঁধেছিল। সেই স্বপ্ন হারিয়ে গেল এক ভয়াবহ অন্ধকারে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলো স্কুলের ভবনের ছাদে। বিস্ফোরণে আগুন ধরে গেল, পুড়ে গেল ক্লাসরুম, পুড়ে গেল শরীর, হৃদয়, ভবিষ্যৎ। আগুনের লেলিহান শিখা পুড়িয়ে দিল নিষ্পাপ প্রাণ, যারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি, তাদের স্বপ্নের স্কুলই একদিন মৃত্যু ফাঁদে রূপ নেবে।
ফেসবুক লাইভে পৃথিবীর মানুষ দেখেছে, পোড়া শরীর নিয়ে ছোট ছোট শিশুদের হাঁটতে দেখা যাচ্ছে, কারও শরীরে কাপড় নেই; পুড়ে গেছে, শরীর পুড়ে কারও রক্ত ঝরছে। এক ভাই তার ছোট বোনের জীবন সংশয় নিয়ে কাঁদছে। কেউ দৌড়ে হাসপাতাল খুঁজছে। আতঙ্কে ছুটছেন অভিভাবকরা, প্রাণপ্রিয় সন্তানকে খুঁজছেন তারা; ধসে পড়ছে আস্থার শেষ প্রহরগুলো।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক—এ দুর্ঘটনার দায় কার? কে এই মৃত্যুর দায় নেবে? শিশুদের তো যুদ্ধ করার কথা নয়। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল না, ছিল খাতা-কলম। তারা রাজনীতি করছিল না, করছিল পড়ালেখা। তারা কোনো সংঘর্ষে ছিল না, ছিল স্বপ্নে। সেই স্বপ্ন কী কারণে এভাবে আগুনে পুড়ে গেল?
বলা হচ্ছে, এটি ‘দুর্ঘটনা’। কিন্তু এটি কি শুধুই দুর্ঘটনা? বারবার প্রশিক্ষণ বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে গাফিলতি, অবহেলা বা অদূরদর্শিতা কি নেই? এর আগেও প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে। তখনও প্রশ্ন উঠেছে। উত্তর মেলেনি। এমন একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা না ঘটলে আমরা জানতাম না এই বিমানগুলো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। আর কেনই-বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এমন প্রশিক্ষণ? এ প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে।
এমন একটি ঘটনার পর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা ৬ দফা দাবি তুলেছে—নিহতদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ, আহতদের তালিকা, শিক্ষক অপমানের নিঃশর্ত ক্ষমা, ক্ষতিপূরণ, ঝুঁকিপূর্ণ প্লেন বাতিল, প্রশিক্ষণ সংস্কার। এই দাবিগুলো কি অযৌক্তিক? একটিও কি মিথ্যা? বরং এই দাবি তো রাষ্ট্রের দায় মনে করিয়ে দেওয়া। তাদের এ কথাও মনে করিয়ে দিতে হবে, যে রাষ্ট্র শিশুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তার সব অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ। সেই অবহেলা, সেই দায়হীনতা, সেই অব্যবস্থাপনা—যা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে পচনের চিহ্ন নির্দেশ করছে। তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে, শিশুদের হত্যাকারী হলো সেই ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটি, যা প্রতিবারই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার ফাঁকফোকর তৈরি করে। তাদের হত্যাকারী হলো সেই নির্লিপ্ত রাষ্ট্রযন্ত্র ,যারা বারবার প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েও চুপ থেকেছে।
তাই বলতেই হয়—এই মৃত্যু যেন নিছক সংখ্যা না হয়। যেন এই রক্ত মিশে যায় ভবিষ্যতের দায়বদ্ধতায়। যেন শিশুদের রক্ত দিয়ে এক নিরাপদ ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি লেখা হয়। না হলে এই প্রশ্ন আমাদের তাড়া করবেই—এই শিশুদের মৃত্যুর দায় কার?
গতকাল ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকায় মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাস সংলগ্ন একটি ভবনের ছাদে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই মডেলের প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। বিমানটি উড্ডয়নের অল্প সময়ের মধ্যেই দুর্ঘটনায় পড়ে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ ভিডিওতে দেখা যায়, বিমানটি ভবনের ছাদে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি বড় বিস্ফোরণ ঘটে এবং ধোঁয়ার কালো কুণ্ডলী আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৯ জনই শিশু শিক্ষার্থী, একজন শিক্ষক ও একজন বিমান পাইলট। ২০ জনের মরদেহ শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, কিন্তু অনেকের মরদেহ পুড়ে যাওয়ায় শনাক্তকরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন, যাদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক এবং তাঁরা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহত ও নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের পরিবার-পরিজনদের মধ্যে গভীর শোক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে, অনেকেই এখনও অনেক শিক্ষার্থীর খোঁজ পাচ্ছেন না।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বিধ্বস্ত বিমানটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর রুটিন প্রশিক্ষণ মিশনের অংশ ছিল। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে জনমনে প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে বিমানটি এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিধ্বস্ত হলো, কেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না এবং পূর্বেই সতর্কতা কেন গ্রহণ করা হয়নি?
ঘটনার পরদিন সকাল থেকেই মাইলস্টোন কলেজের সামনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয় ‘আমরা এখানে পড়তে এসেছিলাম, মরতে নয়’। তারা ছয় দফা দাবি পেশ করে, যার মধ্যে রয়েছে নিহত ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ, শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য ক্ষমা চাওয়া, ক্ষতিপূরণ প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ বিমান বাতিল এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে অবিলম্বে সংস্কারের দাবি।
শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে, শিক্ষানীতিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
মাইলস্টোন কলেজ দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে জানাজার মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘আমার ভাই মরল কেন? প্রশাসন জবাব দে’ স্লোগান দিয়েছে। এই করুণ আহ্বান নিয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সচিবালয়ের প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। তাদের প্রধান দাবি ছিল শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিবের পদত্যাগ, কারণ তারা প্রশাসনের উদাসীনতা ও নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য দায়ী বলে অভিযোগ করেন।
বিক্ষোভ দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে এবং পার্কিংয়ে রাখা সরকারি গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে বিক্ষোভকারীদের বের করে দেয়। এরপর সচিবালয়ের বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়।
শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনার ঘটনায় বহু মানুষ হতাহতের পর এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত বিলম্বে জানানোর কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগের দাবিতে সারা দেশেই বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে অপসারণ করা হয়। এ থেকে বোঝা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনরোষ ঠেকাতে এবং ঘটনার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারছেন। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু তারপরও সামাজিক মাধ্যমে তীব্র জনরোষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন বলেছে, ‘এটি অবহেলাজনিত গণহত্যা। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’। বিশিষ্টজনরা দাবি তুলেছেন, যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘প্রশিক্ষণ বিমান যেন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় না আসে, এমন নির্দেশনা ছিল কি? থাকলে কেন তা মানা হয়নি?’
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এই মৃত্যু কেবল দুর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? প্রতিদিন রাজধানীতে নানা দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক ও বেসামরিক ব্যবস্থার মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টানা জরুরি। সামরিক প্রশিক্ষণ যেন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ঝুঁকি সৃষ্টি না করে—এমন পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি রোধ কঠিন হবে।
এমন দুর্ঘটনা শুধু একটি মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি নয়, এটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতার ওপর বড় প্রশ্ন তোলে। নিহত শিক্ষার্থীদের কান্না, আহতদের যন্ত্রণা এবং তাদের পরিবার-পরিজনের আতঙ্ক এখন গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জনগণ জানতে চায়, এই অগণন প্রাণহানির দায় কে নেবে? কার কী জবাব?
আজ আমাদের সামনে একটি কঠিন বাস্তবতা—শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের কি যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে কি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ হবে? না কি আমরা শুধু শোক ও প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ থাকব?
মাইলস্টোন দুর্ঘটনা যেন একটি করুণ স্মারক, যা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের সামরিক ও বেসামরিক জীবনের মধ্যে সুস্পষ্ট ও কার্যকর ব্যবধান তৈরি করা জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর। দেশবাসী আশা করছে, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মৃত্যুর অন্ধকার কাটিয়ে, নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হবে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ও আশা। নইলে এই ক্ষোভ ও বেদনা ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়ঙ্কর সংকেত হয়ে থাকবে।
এখন সময় দায়িত্বশীলতার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার, এবং একটি নিরাপদ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার। না হলে, মাইলস্টোনের হারানো প্রাণগুলোর জন্য আমাদের সকলের কাছেই একদিন জবাবদিহি থাকবে।
লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক কলাম লেখক
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প র ণ এল ক য় দ র ঘটন র ন দ র ঘটন দ র ঘটন য় ম ইলস ট ন ব ধ বস ত উপদ ষ ট ঘটন র প ব যবস থ র জন য ব ম নট গ রহণ ভবন র ন একট
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’