আমার শিক্ষক, শিক্ষাগুরু ও পথপ্রদর্শক অধ্যাপক আনিসুর রহমান ৫ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭২ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র তখন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য প্রফেসর আনিসুর রহমান তাঁর কমিশনের কর্মপরিধি কিছুটা কমিয়ে আমাদের ‘মাইক্রো-ইকোনমিকস’ কোর্সটি পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন (যদিও ’৭১ সালে আমার এমএ পাস করার কথা, কিন্তু ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণে আমরা প্রায় দেড় বছর সেশন-বিলম্বের শিকার হয়েছিলাম)। ওটা ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সর্বসেরা অর্জন। সেশন-বিলম্ব না হলে আমি আমার শিক্ষাজীবনের সেরা শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুর রহমানের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতাম। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আগে তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থিত কায়েদ-ই-আযম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সেই ১৯৭২ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অধ্যাপক আনিসুর রহমান ছিলেন আমার ‘ফিলসফার-গাইড’ ও সার্বক্ষণিক শিক্ষাগুরু। সারাজীবন আমি তাঁকেই অনুসরণ করার সর্বাত্মক প্রয়াস অক্ষুণ্ন রেখেছিলাম। প্রফেসর আনিসুর রহমান আদতে একজন ‘অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি-দার্শনিক’, যাঁর তুল্য বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। বক্ষ্যমাণ কলামে আমি আনিসুর রহমানের দর্শনকেই ফোকাস করতে চাই।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান কখনোই ‘দরিদ্র’, ‘দারিদ্র্য নিরসন’ কথা দুটো ব্যবহার করতেন না। সমাজের প্রান্তিক অবস্থানের জনগণকে তিনি সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী নামে (ডিজঅ্যাডভান্টেজড পিপল) আখ্যায়িত করতেন। কারণ, তাঁর দার্শনিক অবস্থান ছিল– একটি দেশে বিদ্যমান ‘সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির সিস্টেম’ সর্বক্ষণ দারিদ্র্য সৃষ্টি এবং পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। এই ‘সিস্টেম’ পরিবর্তন করাকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে মোকাবিলা না করলে শুধু ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ কিংবা ‘মাইক্রো-ক্রেডিট’ দিয়ে কখনোই টেকসইভাবে দারিদ্র্য মোকাবিলা করা যাবে না। ২০০৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Poverty, Overcoming Poverty and Self-Realization’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি এর বিস্তারিত তুলে ধরেন। মানুষকে মাইক্রো-ক্রেডিট কিংবা এনজিও ঋণ-সহায়তার ‘টার্গেট’ হিসেবে বিবেচনা করে দারিদ্র্য নিরসন করতে চাইলে সেটা মনুষ্যত্বকে অপমান করার শামিল হবে। আনিসুর রহমান মনে করতেন, বিশ্বব্যাংক অনুসৃত মাথাপিছু জিডিপির মাধ্যমে কিংবা দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাপক দিয়ে দারিদ্র্য পরিমাপ করার মানে, মানুষকে গরু-ছাগলের পর্যায়ে নামিয়ে আনা। তিনি ‘দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর অনুপাত’কে বলতেন ‘লাইভস্টক কনসেপ্ট অব পভার্টি’। এ ধরনের কনসেপ্ট যে বাংলাদেশের জনগণকে অভূতপূর্ব নিষ্ঠুরতার সঙ্গে লুণ্ঠনের ব্যাপারটি শাসক মহল কর্তৃক লুকিয়ে ফেলার জন্য অপব্যবহার করা হয়েছে, পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের পর সে ব্যাপারটি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্টভাবে উদ্ঘাটিত হয়ে চলেছে। গত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয়ভাবে বাড়ছে মর্মে ‘ডেটা ডক্টরিং’-এর মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচার্ড (ভুয়া) পরিসংখ্যান প্রতিবছর সৃষ্টি করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছেন। প্রফেসর আনিসুর রহমানের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে আমার রচিত ও ২০০৯ সালে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ (রিইব) কর্তৃক প্রকাশিত ‘দ্য পভার্টি ডিসকোর্স অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থের মূল বক্তব্য এ দৃষ্টিভঙ্গিকেই ধারণ করে রয়েছে।
প্রফেসর অমর্ত্য সেন এবং ড.
অধ্যাপক আনিসুর রহমান তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর কয়েক বছর নিজেকে অনেকখানি গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭২-৭৩ পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সবচেয়ে প্রগতিশীল সদস্য হিসেবে সবার চেয়ে বেশি সমীহ আদায় করেছিলেন তিনি। ষাটের দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী তাত্ত্বিক হিসেবেও ছাত্রছাত্রী ও ওয়াকিবহাল মহলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের ‘টু ইকোনমি থিসিস’-এর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন যখন ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ও প্রবাসী সরকার গঠন বিষয়ে আলোচনা চালিয়েছিলেন তখন আনিসুর রহমান এবং রেহমান সোবহান ছিলেন তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা ও সহ-আলোচক। ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা কমিশন বাংলাদেশের যে ‘ভূমি সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন’ করেছিল, ওই প্রস্তাবের রচয়িতা ছিলেন আনিসুর রহমান।
যখন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর কাছে বিবেচনার জন্য ওই প্রস্তাবমালা পেশ করেছিলেন তখন শেখ মনি ও তোফায়েল আহমেদের মতো পুঁজিবাদ-ভক্তদের সমালোচনার কারণে ওই প্রস্তাবগুলো গ্রহণযোগ্য মনে করেননি বঙ্গবন্ধু। ১৯৯৩ সালে আনিস স্যার আমাকে ওই প্রস্তাবগুলোর সাইক্লোস্টাইল কপিটি দিয়ে ভূমি সংস্কার বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একটি দুর্ঘটনার কারণে আমি বিষয়টি যথেষ্ট গভীরভাবে গবেষণা করতে পারিনি, কিন্তু আমার প্রবন্ধে প্রস্তাবগুলো হুবহু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমরা একটি অর্থবহ ভূমি সংস্কার আইন যে এখনও পাস করতে পারলাম না, সে ব্যর্থতার কাহিনি এখানেই পাওয়া যাবে। আমি প্রফেসর আনিসুর রহমানের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত
অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সত্য মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার করবেন না, মেসেজটা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন: সিইসি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, 'আমাদের একটা অভ্যাস হয়ে গেছে একটা নেতিবাচক সংবাদ দেখলেই যাচাই-বাছাই না করে শেয়ার করে দেওয়া হয়। অত্যন্ত ভিত্তিহীন সংবাদও আমরা শেয়ার করে দেই।'
সিইসি বলেন, 'দয়া করে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে শেয়ার করবেন না। এই মেসেজটা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিন। তথ্যটা যেন আগে যাচাই করে তারপরে শেয়ার করেন।'
আজ সোমবার রাজধানীর ভাটারায় আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নে (এজিবি) এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন সিইসি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ভুয়া সংবাদের প্রচার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপপ্রয়োগ রোধে করণীয় সম্পর্কে তিনি এসব কথা বলেন।
থানা আনসার কোম্পানি/প্লাটুন সদস্যদের আনসার মৌলিক প্রশিক্ষণের (৪র্থ ধাপ) সমাপনী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিইসি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো সংবাদ দেখা মাত্রই নাগরিকদের যাচাইবাছাই করতে আহ্বান জানান সিইসি। নিশ্চিত হওয়ার আগে শেয়ার না করতে বলেন তিনি।
জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে আনসার ভিডিপির ভূমিকাকে মূল শক্তি বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি বলেন, 'এনারাই অধিক সংখ্যায় নিয়োজিত থাকেন। এবং আমাদের হিসেব করতে গেলে প্রথম এদেরকেই হিসেব করতে হয় যে, কতজন আনসার ভিডিপি সদস্য আমরা মোতায়েন করতে পারব। মূল কাজটা আঞ্জাম (সম্পাদন) দিতে হয় কিন্তু আনসার এবং ভিডিপির সদস্যদের।'
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ। নির্বাচনকালীন জনগণের নিরাপত্তা, ভোট কেন্দ্রের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণে আনসার বাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি। নির্বাচনে দেশজুড়ে প্রায় ৬ লাখ আনসার ও ভিডিপি সদস্য দায়িত্বপালন করবেন বলেন মহাপরিচালক।
অনুষ্ঠানে মহড়ায় ঢাকা মহানগর আনসারের চারটি জোনের অধীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৩২০ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্য অংশ নেন। আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদস্যরা টহল, দায়িত্ব বণ্টন ও জরুরি প্রতিক্রিয়া অনুশীলনে অংশ নেন।
মহড়ায় ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জামাদি নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া, ভোটারদের শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ভোট প্রদানে সহায়তা, জাল ভোট প্রতিরোধ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা এবং সেনা, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে দ্রুত সমন্বয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন জোনের অধিনায়ক এবং প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।