মিরপুরের উইকেট: আসলেই কি কালো মাটির দোষ
Published: 20th, October 2025 GMT
জন্মদাগ কখনো মুছে ফেলা যায় না। মুছে ফেলতে পারেন, যদি জন্মদাগ থাকা অঙ্গটাই ফেলে দেন। সেটা কি কেউ ফেলে?
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম তার ‘জন্মদাগ’ নিয়েই ভুগছে। সেই দাগ কালো মাটির উইকেট। তবে কালো মাটির বলেই যে এই উইকেট নিয়ে এত নেতিবাচক আলোচনা, বিষয়টি তা নয়। সমস্যা অন্য জায়গায়। এককথায় বললে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই এক অপ্রিয় বাস্তবতা সেটি। সেদিকে তাকানোর আগে চলুন একটু ঘুরে আসা যাক শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জন্মলগ্ন থেকে।
ক্রিকেট এল মিরপুরেফুটবলের সঙ্গে অনেক লড়াই-বিবাদের পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ মিরপুর স্টেডিয়ামকে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ দেয়। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে এ মাঠে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়েছে। তার আগে প্রায় দেড় বছর ধরে চলেছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
এক সকালে গিয়ে দেখা গেল, মাঠের একেবারে মাঝখানে বিশাল আয়তাকার গর্ত। চারদিকে বাউন্ডারি ওয়ালের মতো ইটের গাঁথুনি আউটফিল্ড থেকে জায়গাটাকে আলাদা করেছে। পরে সেই ‘বাউন্ডারি ওয়াল’ চলে গেছে মাটির নিচে। মাঝ মাঠে দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল পার্থের তৎকালীন ওয়াকা গ্রাউন্ডের কিউরেটর রিচার্ড উইন্টারের। মিরপুর স্টেডিয়ামের উইকেটের পরামর্শক হিসেবে আনা হয়েছিল তাঁকে।
ওয়াকা বানাতেই কালো মাটির উইকেটমাঝমাঠের চতুষ্কোণ গর্তটি দেখিয়ে উইন্টার বলেছিলেন, ওয়াকার মতো উইকেট হবে এখানে। ওয়াকার উইকেট গতিময়, বাউন্সি। বানানো হয়েছিল কালো মাটি দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটর উইন্টারকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) দেশীয় যেসব মাটির নমুনা দেখাল, সেখান থেকে তিনি বেছে নিলেন সাভার অঞ্চলের কালো মাটিটা।
কালো মাটিতে ক্লে বেশি, যা উইকেটকে করে শক্ত। উইন্টার স্বপ্ন দেখালেন—মিরপুরের উইকেটে ওয়াকার মতো বলে গতি উঠবে শাঁই শাঁই, বাউন্স উঠবে দুমদাম। বল যেহেতু উঠবে, ব্যাটসম্যানরাও চাইলে বড় রানের ইনিংস খেলতে পারবেন। উইন্টারের নির্দেশনায় উইকেটের নিচে মাটি-ইট-পাথর–বালুর একটার পর একটা পরত সাজানো হলো অনেকটা ওয়াকার মতো করেই।
স্বপ্ন হলো মিথ্যাস্বপ্নের সেই আয়তাকার জায়গাটিই আজ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। আজ তো নয়, আসলে শুরু থেকে। মিরপুরের উইকেটে যে কখনো বড় রান হয়নি, তা নয়। শুধু ওয়ানডেতেই ১৫ বার তিন শতাধিক রান দেখেছে এ মাঠ। সর্বোচ্চ ২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের ৩৭০। পরের বছর এশিয়া কাপে পাকিস্তানের ৩২৯ রান তাড়া করে জিতেছে ভারত, যেটি এ মাঠে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে ওয়ানডে জেতার রেকর্ড। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে টেস্টের এক ইনিংসে এ মাঠেই ৭৩০ রান করেছে শ্রীলঙ্কা, সেটিও ৬ উইকেট হারিয়ে।
তবে মিরপুরে তিন সংস্করণের ক্রিকেটেই ব্যাটিং–ব্যর্থতা আর স্পিন–সহায়তার এমন এমন নজির আছে যে বড় রানের ম্যাচগুলো মানুষ মনে রেখেছে কমই। বল ওঠে না, স্পিনাররা বাড়তি সুবিধা পায়, ব্যাটসম্যানদের রান করা দুরূহ—এসবই এখানে বেশি দেখা গেছে। দায়টা আসে ঘুরেফিরে সেই কালো মাটি আর কিউরেটরদের ওপর।
আসলেই কি কালো মাটির দোষসেটি যে নয়, তার প্রমাণ তো ওই বড় রানের ম্যাচগুলোই। তাহলে দোষটা কার? এখানেই আসে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অপ্রিয় বাস্তবতার প্রসঙ্গ। কিউরেটর উইকেট বানান, উইকেটের পরিচর্যা করেন ঠিক আছে; কিন্তু তাঁকে যদি অন্যের ইচ্ছায় ম্যাচ জেতানোর রেসিপিতে তা করতে হয়, দায়টা শুধু কিউরেটরের কেন হবে?
জাতীয় দলের কোচরা ম্যাচের পর ম্যাচ চেয়েছেন মিরপুরে স্পিন ট্র্যাক হোক, অনেক সময় ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রভাবশালী ক্লাবের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়েও কিউরেটরদের উইকেটের ধরনে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। হয়তো ঘাস গজিয়ে উইকেটটাকে একভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে, ম্যাচের আগের দিন নির্দেশনা এসেছে ঘাস ছেঁটে ফেলার। মিরপুরের উইকেটকে ওয়াকা বানানোর যে স্বপ্ন, এভাবেই দিনে দিনে তা মার খেয়ে গেছে। এই উইকেট কখনোই পারেনি নির্দিষ্ট একটি চরিত্র ধরে রাখতে।
তার ওপর আছে অতিরিক্ত খেলার চাপ। ঘরোয়া, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মিলিয়ে বছরে গড়ে প্রায় ১৫০ দিনের মতোই খেলা থাকে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে, যেটির দ্বিতীয় উদাহরণ দুনিয়ায় আর নেই।
কখনোই কি বদলাবে না মিরপুরের উইকেটওয়াকা না হোক, অন্তত ব্যাটসম্যানদের বিভীষিকা হিসেবে মিরপুরের উইকেটের যে দুর্নাম, সেটি ঘোচানো সম্ভব। বিসিবির হেড অব টার্ফ ম্যানেজমেন্ট ও অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটর টনি হেমিংয়ের ভাবনাটা অবশ্য একটু অভিনব। সেটি অনেকটা জন্মদাগ থাকা অঙ্গ ফেলে দেয়ার মতোই ব্যাপার। হেমিং নাকি অস্ট্রেলিয়া থেকে মাটি এনে নতুন করে উইকেট বানাতে চান। কিন্তু ম্যাচ না কমালে অস্ট্রেলিয়ান মাটিরও তা সহ্য হবে কি না, কে জানে!
তার চেয়ে বিসিবি চাইলে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে পথ খুঁজতে পারে। প্রথমত, খেলার পরিমাণ কমিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে উইকেটকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে প্রাধান্য দিয়ে এ মাঠে কমিয়ে দিতে হবে ঘরোয়া ও অন্যান্য ম্যাচ।
উইকেটে গজাতে দিতে হবে ঘাস এবং ঘাসের মাপটা কিউরেটরের স্কেলের মাপেই হতে হবে; কারও বিশেষ অনুরোধে নয়। উইকেটে ওয়াটারিং আর রোলিং ঠিকঠাকভাবে হলে কালো মাটি কোনো সমস্যা নয়।
মিরপুরের উইকেট যেহেতু আগেও এভাবেই রানপ্রসবা হয়েছে, আবার আশা করতে দোষ কী!
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উইন ট র উইক ট র বড় র ন
এছাড়াও পড়ুন:
সকালেই পড়ুন আলোচিত ৫ খবর
ছবি: তারেক রহমানের ফেসবুক থেকে নেওয়া