ওরস্যালাইন ব্যবহারে কমছে শিশু মৃত্যুর হার
Published: 15th, January 2025 GMT
দেশে বছরে ৮ লাখ দোকানির মাধ্যমে দেড়শো কোটি ওরস্যালাইন প্যাকেট বাজারজাত করছে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি)। গতকাল এসএমসির প্রধান কার্যালয়ে ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের লক্ষ্যে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তসলিম উদ্দিন খান। ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি সপ্তাহব্যাপী এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাহী বলেন, এই মুহূর্তে আমরা অনেকগুলো পণ্য বাজারজাত করছি। তবে যদি জানতে চাওয়া হয় আমাদের সব থেকে ইউনিক প্রোডাক্ট বা নাম্বার ওয়ান প্রোডাক্ট কোনটি তাহলে বলব আমাদের বাজারজাতকৃত খাবার স্যালাইন, ওরস্যালাইন এন। ডায়রিয়া এবং পানিশূন্যতা মোকাবিলায় আমরা প্রতিবছর প্রায় দেড়শো কোটি স্যালাইন বাজারজাত করি। আমাদের ওরস্যালাইন ব্যবহার করে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি, যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সকল অংশীজনের নিরলস প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে এখন পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। দেশের আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির প্রায় অর্ধেক ব্যবহারকারী এসএমসি ব্র্যান্ডের গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে এসএমসি মা, শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্যে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া এই মুহূর্তে সব মিলিয়ে আমাদের কোম্পানিটিতে ৪ হাজার ৫০০ কর্মী কাজ করছে।
স্বাস্থ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি এসএমসি বিভিন্ন ধরনের জনস্বাস্থ্য পণ্য বাজারজাত করছে। এগুলোর মধ্যে ওরাল স্যালাইন, শিশু পুষ্টি পাউডার, ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক, কৃমিনাশক ট্যাবলেট, স্যানিটারি ন্যাপকিন, বেবি ডায়াপার, ফর্টিফাইড বিস্কুট অন্যতম।
এসএমসি ও এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ওয়ালিউল ইসলাম বলেন, এসএমসির সাফল্যের মূলে রয়েছে সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীদের নিরলস প্রচেষ্টা, কৌশলগত পরিকল্পনা, এবং সরকার ও উন্নয়ন অংশীজনদের সহযোগিতা। এসএমসি তার সাফল্যকে পাথেয় করে আগামী বছরগুলোতেও কর্মসূচি সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের নারী, শিশু এবং পরিবারের জীবনমান উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এদেশের মানুষের কল্যাণে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবিচলভাবে এসএমসি কাজ করে যাবে সকল অংশীজনের সহযোগিতা ও ভালোবাসা নিয়ে। অনুষ্ঠান শেষে ‘পঞ্চাশের উচ্ছ্বাসে, একসাথে আগামীতে’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এসএমসির ৫০ বছর পূর্তির লোগো উন্মোচন করা হয়।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
জন্মনিরোধে তরুণদের সচেতনতা জরুরি
নিরাপদ যৌনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রচলিত কুসংস্কার থেকে বের হয়ে তরুণদের সঙ্গে এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। যাতে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। নানা ধরনের যৌনবাহিত রোগ থেকে রক্ষা, অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ রোধ ও মাতৃমৃত্যু কমাতে জন্মনিরোধক সামগ্রীর ব্যবহার সহজলভ্য করতে হবে। ‘বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস’ ২৬ সেপ্টেম্বর। এ উপলক্ষে গতকাল বুধবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা।
‘বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস: প্রজননস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও তরুণদের ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আয়োজন করে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (এসএমসি)। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী হিসেবে ছিল প্রথম আলো।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রামের (সিসিএসডিপি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম অনেক দূর এগোলেও তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো জন্মনিরোধক–সম্পর্কিত সঠিক তথ্য ও পরামর্শ থেকে বঞ্চিত। ফলে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ বাড়ছে, যা মাতৃস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।’
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, এই প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয় জরুরি। প্রথমত, তরুণদের কাছে পৌঁছাতে হলে ডিজিটাল মাধ্যম ও মোবাইল অ্যাপসকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, হেল্পলাইন, অনলাইন কনটেন্ট তরুণদের জন্য সহজবোধ্য করে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও সামাজিক বাধা কাটিয়ে উঠতে হবে। ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে স্থানীয় ধর্মীয় নেতা, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সেবাগ্রহীতা পরিবারগুলোকে সচেতনতার কাজে যুক্ত করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী মহিউল ইসলাম বলেন, ‘অ্যাকসেস টু কন্ট্রাসেপশন (গর্ভনিরোধ পদ্ধতিতে প্রবেশগম্যতা) কিন্তু হিউম্যান রাইটস, আমাদের অধিকার এটা।
এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা আমাদের কারও নেই।’
কন্ট্রাসেপশনের ফলে ইতিমধ্যে পৃথিবীতে বহু জীবন বেঁচে গেছে উল্লেখ করে কাজী মহিউল ইসলাম বলেন, ‘জীবন বাঁচানোর যে সাফল্য, এটা আমাদের এটা প্রমোট করতে হবে। একইভাবে তরুণদের সঙ্গে আমাদের খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, জন্মনিরোধক ব্যবহার না করলে বিপদটা কোথায়, এসটিআই (যৌনবাহিত সংক্রমণ) ও এসটিডির (যৌনবাহিত রোগ) ভয়াবহতাটা কী। তা না হলে কিন্তু তারা এগুলো এত সিরিয়াসলি নেবে না।’
সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পরিবার পরিকল্পনাসামগ্রীর নামকে একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখার পরামর্শ দেন কাজী মহিউল ইসলাম।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, তরুণদের মধ্যে কনডম ব্যবহারে অনীহা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। কনডম শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণই নয়; বরং যৌনবাহিত সংক্রমণ, যেমন গনোরিয়া, ক্ল্যামাইডিয়া, সিফিলিস ও এইচআইভি থেকে রক্ষা করে।
কিন্তু সচেতনতার ঘাটতি, সামাজিক সংকোচ এবং অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের পণ্যের কারণে তরুণেরা কনডম ব্যবহারে তরুণেরা আগ্রহী হচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
নিজের চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে করে মো. সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অনেক তরুণ জানেই না কনডম সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে বা নিম্নমানের কনডম ব্যবহারে কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এতে শুধু সংক্রমণ নয়, ত্বকে অ্যালার্জি বা কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিসের মতো জটিলতাও হতে পারে।’
জনসংখ্যা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. উবায়দুর রব পরিবার পরিকল্পনা বিদ্যমান কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর ওপর গুরুত্ব দেন।
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, তরুণদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষায় জন্মনিরোধক ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। বাল্যবিবাহ ও অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের ঝুঁকি কমাতে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। সঠিক পরামর্শ ও সহজলভ্য কন্ট্রাসেপশন শুধু অনিরাপদ গর্ভপাত কমায় না; বরং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুও হ্রাস করে।
যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধেও কনডমের ব্যবহার কার্যকর ভূমিকা রাখে উল্লেখ করে ফারহানা দেওয়ান বলেন, তরুণ দম্পতিদের নিয়মিত কাউন্সেলিং, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা এবং গণমাধ্যমে প্রচারণা তাঁদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে। নিরাপদ মাতৃত্ব, সুস্থ পরিবার ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জন্মনিরোধক ব্যবহারের প্রসার এখন সময়ের দাবি।
জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের পলিসিতে অবিবাহিত তরুণদের জন্মনিরোধক সামগ্রী দেওয়া যায় না। এ জায়গায় নীতিগত পরিবর্তন আনা যায় কি না, সেটা ভাবতে হবে। তরুণদের মধ্যে তরুণদের ভাষায় সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি জন্মনিরোধক সামগ্রী তাদের জন্য সহজলভ্য করতে হবে।’
উন্নয়ন সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রম কমে যাওয়ায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জানিয়ে এসএমসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তছলিম উদ্দিন খান বলেন, পরিকল্পনা কার্যক্রম অব্যাহত থাকা খুবই জরুরি ছিল। কীভাবে শুরু করা যায়, সেটা নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করতে পারে।
এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েফ উদ্দিন নাসির বলেন, ‘নানা আইনি ফাকফোঁকর দিয়ে নকল ও মানহীন কনডম বাজারে ঢুকছে। আমরা আশা করব, সরকার এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এমএমসি প্রতিটি পণ্যের মান নিশ্চিত করে সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছে।’
গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।