কক্সবাজারে পাহাড়ধস: কারণ ও করণীয়
Published: 20th, October 2025 GMT
রাতভর টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের বুক থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে কাদা-পানির স্রোত। হঠাৎ গর্জে ওঠে মাটি, চোখের পলকে চাপা পড়ে ঘর ও তাজা প্রাণ। বর্ষা মৌসুমে এমন মর্মান্তিক দৃশ্য কক্সবাজারের প্রায় নিত্যঘটনা। সময়-অসময়ে প্রবল বর্ষণেই নেমে আসে পাহাড়ধসের ভয়াল দুর্যোগ।
প্রশ্ন হলো- এই বিপর্যয় কি আগেই জানা সম্ভব? কতটা বৃষ্টি হলে ধস নামে? কেন পাহাড় হারাচ্ছে ভারসাম্য? মাটির গঠন, বন উজাড়, নাকি মানুষের বসতিই এর জন্য দায়ী?
আরো পড়ুন:
বহু জাতি-সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তিমূলক বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি না: সন্তু লারমা
ছয় ঘণ্টা পর বাঘাইছড়িতে যান চলাচল স্বাভাবিক
তথ্য অনুযায়ী, শুধু কক্সবাজার শহরেই পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ। ৫০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে দেদারসে ঘর নির্মাণ চলছে এখনো। শহরের ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, লারপাড়া, কলাতলী, চন্দ্রিমা হাউজিং, সাহিত্যিকাপল্লীসহ ২০ থেকে ২৫টি পাহাড়ি এলাকায় এমন অনিরাপদ বসতি গড়ে উঠেছে।
গত এক দশকে কক্সবাজার জেলায় ২১টি পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৮ জন। এর মধ্যে ২৯ জন স্থানীয় বাসিন্দা এবং ১৯ জন আশ্রিত রোহিঙ্গা।
প্রশাসনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এর মধ্যে ১০টি পাহাড়ধস হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায়। এসব দুর্ঘটনায় অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন আহত হয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণের ফলে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মাটি মিশে পৌরসভার নালা-নর্দমা ভরাট করছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।
কেন পাহাড় ধসে পড়ে:
অবিরাম ও ভারী বৃষ্টিপাত হলে মাটির নিচের স্তর পানিতে ভিজে আঠালো হয়ে যায়, ফলে মাটি নিজের ওজন সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো.
তিনি জানান, অতিবৃষ্টি ছাড়াও মানুষের অযাচিত পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের প্রাকৃতিক ঢাল ও ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। গাছের শিকড় মাটিকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে রাখে; কিন্তু গাছ কেটে ফেললে সেই বন্ধন ভেঙে যায়। ফলে বৃষ্টির পানি সরাসরি মাটির স্তর ধুয়ে নেয়, মাটি আলগা হয়ে পড়ে। শুকনো অবস্থায় তা শক্ত মনে হলেও ভেতরে ফাঁপা থেকে যায়। একটানা বৃষ্টির সময় এই আলগা মাটির বন্ধন ভেঙে পড়েই পাহাড়ধসের সৃষ্টি হয়, এটাই প্রধান ভূতাত্ত্বিক কারণ।
মারুফ হোসেন বলেন, “কক্সবাজারের পাহাড়গুলো মূলত বালি, দোআঁশ ও সিল্টযুক্ত মাটি দিয়ে গঠিত, যা আর্দ্রতা পেলে দ্রুত ভেঙে পড়ে। এসব মাটি কাদামাটির মতো শক্ত নয়, তাই বৃষ্টিতে সহজেই ধসে যায়। পাশাপাশি পাহাড়ের ওপর ও পাদদেশে বসবাসকারী হাজারো পরিবারের ঘর এবং অপরিকল্পিত স্থাপনা মাটিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। এতে পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ঝড়-বৃষ্টির সময় প্রায়ই ধসের ঘটনা ঘটছে।”
পাহাড় ধসের আগাম বার্তা কতক্ষণ আগে জানা যায়:
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল হান্নান বলেন, “যখন টানা সাতদিন ধরে অল্প অল্প বৃষ্টি হয় বা কোনো একদিনে ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা যায়, তখন পাহাড়ের মাটি ধীরে ধীরে নরম হয়ে ধসের ঝুঁকি তৈরি হয়।”
তিনি বলেন, “আমরা টানা ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করলেই পাহাড়ধসের সম্ভাবনার বিষয়ে সতর্কবার্তা দেই। এই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হতে সাধারণত ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত অবিরাম বৃষ্টি লাগে।”
এই আবহাওয়াবিদের মতে, “এই প্রক্রিয়ায় মূলত পাহাড়ধসের পূর্বাভাস নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসন, তথ্য অফিস, সিপিপি এবং স্থানীয় এনজিওগুলোর মাধ্যমে জনগণের কাছে সতর্কতা পৌঁছে দেওয়া হয়। যাতে সময়মতো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। যদিও এবিষয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া ও সরে যাওয়ার গতি কম।”
এভাবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তথ্য আদান-প্রদান ও সমন্বিত সতর্কতা ব্যবস্থার মাধ্যমেই পাহাড়ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব বলে মনে করেন মো. আব্দুল হান্নান।
প্রতিবছর বর্ষা এলেই পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, তবু ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরানো যায় না। সারাবছর প্রশাসন নীরব থাকে, কিন্তু টানা বর্ষণ শুরু হলেই শুরু হয় তৎপরতা ও হাঁকডাক। তবুও অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান ছাড়তে রাজি হন না। এর ফলে প্রতি বছর পাহাড়ধসে ঝরে যায় মানুষের প্রাণ। এ নিয়ে বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর বহু মামলা করলেও পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন ঘটেনি।
ঘোনারপাড়ার বাসিন্দা মোসলেম উদ্দিন বলেন, “আমরা জানি, পাহাড়ে থাকা বিপদজনক। অতিবৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যান। আবার অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে ঘর ছেড়ে যেতে চান না। কারণ, তাদের থাকার আর কোনো জায়গা নেই। সরকার যদি আমাদের সমতলে বসবাসের জায়গা দেয়, তবে আমাদের আর পাহাড় থাকতে হবে না।”
পাহাড়তলী এলাকার গৃহবধূ নুরজাহান বেগম বলেন, “বৃষ্টিতে মাটি নরম হলে ভয় লাগে। গত বছর পাশের ঘর ধসে পড়েছিল। আমরা এখন পাহাড়ে থাকতে চাই না। পুনর্বাসন করলে আমরা চলে যাব।”
লারপাড়ার রিকশাচালক মোহাম্মদ হারুনর রশিদ বলেন, “প্রতিবার প্রশাসন আসে, মাইকিং করে। মাইকিং করলে পাহাড় ধসের পূর্বাভাস পাই। সরে গেলে থাকবো কোথায়? আমরা নিরাপদে থাকার জন্য জায়গা চাই, যাতে বাচ্চাদের নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।”
খাজা মঞ্জিল এলাকার বাসিন্দা আফসার উদ্দিন বলেন, “দুই যুগ ধরে আমরা পাহাড়ে বসবাস করছি। বৃষ্টি হলে সতর্ক থাকি, পাহাড় থেকে দূরে থাকি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এখন বুঝতে পারি, কী পরিমাণ বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গায়ে ফাটল ধরবে। এসব বিষয়ে আমরা সচেতন থাকার চেষ্টা করি।”
গাছ মাটিকে কীভাবে ধরে রাখে:
বন কর্মকর্তা মারুফ হোসেনের মতে, গাছের শিকড় নিচের মাটিকে জালের মতো আঁকড়ে রাখে। শিকড় যত গভীর, মাটির বন্ধন তত শক্ত। বিশেষ করে বট, বেল, আম, তেঁতুল, শিমুল, মহুয়া প্রজাতির গাছ এবং বাঁশ, বেত ও ঝাউবন পাহাড়ের মাটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধরে রাখে।
গাছ কমছে কেন:
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দিপু বলেন, “বনভূমি ধ্বংসের কারণেই পাহাড়ে আর প্রাকৃতিক শিকড়ের বাঁধন নেই।”
এই পরিবেশবিদের মতে, “পাহাড়ে গাছ কমার কারণগুলো হলো- পাহাড় কেটে ইটভাটা ও হোটেল নির্মাণ, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে বন নিধন, বস্তিবাসীদের রান্নার জন্য গাছ কাটা, কৃষি জমির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য বনভূমি দখল এবং সঠিকভাবে পুনরায় বনায়ন না হওয়া।”
গাছ বাড়াতে করণীয়:
গভীরমূল গাছের চারা রোপণ করতে হবে। পাহাড়ের ঢালে বাঁধ তৈরি ও টেরাসিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও যুব সংগঠনকে বৃক্ষরোপণ অভিযানে যুক্ত করা যেতে পারে। বনবিভাগকে পাহাড়ি গাছ কাটার মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষমতা দিতে হবে বলে মনে করেন কক্সবাজারের পরিবেশবিদ দীপক শর্মা দিপু।
মানুষ কী করতে পারে:
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “প্রতিবার পাহাড় ধসের পর আমরা দৌঁড়ঝাপ দেখি, কিন্তু আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা খুব কম। মানুষকে বুঝতে হবে, পাহাড়ে বসবাস মানে মৃত্যুর সঙ্গে সহবাস। এখনই সরকার ও নাগরিক উভয়কে দায়িত্ববান ও সচেতন হতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারী মানুষদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় পাহাড়ের ঢাল থেকে দূরে থাকা এবং পাহাড়ের গায়ে ফাটল বা দেয়াল হেলে পড়ার মতো লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। এজন্য প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় স্থানীয় সতর্কবার্তা টাওয়ার, রেইন গেজ মেশিন ও ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড বসানো গেলে সাধারণ মানুষ সময়মতো বুঝতে পারবে কখন পাহাড় ছাড়তে হবে।”
প্রশাসনের পর্যবেক্ষণ:
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম বলেন, “পুনর্বাসনের জন্য স্থায়ী জায়গা না থাকায় পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরানো কঠিন হয়। আমরা প্রতি বর্ষায় মাইকিং, আশ্রয়কেন্দ্র খোলা ও যৌথ অভিযান চালাই। এ বিষয়ে প্রশাসন সবসময় সতর্ক অবস্থানে থাকে।”
সচেতন মহল মনে করছেন, পাহাড়ধস রোধে পরিকল্পিত শহর, কঠোর আইন প্রয়োগ, বিকল্প আবাসন, ব্যাপক বৃক্ষরোপণ এবং নাগরিক সচেতনতা এখনই প্রয়োজন। এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।
একসময় সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল কক্সবাজারের পাহাড়, কিন্তু এখন তা অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। সময় থাকতেই পাহাড়কে রক্ষা করতে হবে, কারণ পাহাড় বাঁচলেই মানুষ ও প্রকৃতি বাঁচবে।
ঢাকা/মাসুদ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প হ ড় ধস ই প হ ড়ধস প হ ড়ধস র ব যবস থ র জন য পর ব শ ন র পদ এল ক য় বসব স সতর ক র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
সাইনবোর্ডে ‘কলেজ’, লেখাপড়া নেই
রাজধানীর খিলগাঁও চৌরাস্তা এলাকায় একটি বহুতল ভবনের গায়ে বড় করে লেখা ‘বাংলাদেশ কমার্স কলেজ’। কিন্তু ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, কলেজের কোনো অস্তিত্ব নেই। যে তলায় একসময় কলেজের ক্লাস চলত, সেখানে এখন চলছে অন্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। অথচ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বলছে, এ কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু পাস করেননি।
গতকাল রোববার দুপুরে ওই ভবন থেকে বের হচ্ছিলেন একজন প্রবীণ মানুষ। তিনি পাশে চায়ের দোকান করেন। তিনি বলেন, ‘বছর দুয়েক আগে ভবনটিতে কলেজের কার্যক্রম ছিল। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দেখা যেত। এখন কাউকে দেখি না।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের নথি অনুযায়ী, ২০০৫ সালে কলেজটি পাঠদানের অনুমতি পায় এবং ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে। গত বছর এই কলেজ থেকে চারজন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একজন পাস করেছিলেন। বোর্ডের এক কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, ‘এটা কেবল খোসা, ভেতরে কিছুই নেই।’
সাইনবোর্ডে থাকা মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, এটি বাংলাদেশ কমার্স কলেজের কোনো নম্বর নয়।
শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। তথ্য পেলে ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।খন্দোকার এহসানুল কবির, আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানশূন্য পাস প্রতিষ্ঠান তিন গুণের বেশি বেড়েছেঢাকা শিক্ষা বোর্ডসহ দেশের ৯টি সাধারণ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দুই শর বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেননি, যেখানে গত বছর সংখ্যাটি ছিল মাত্র ৬৫। ২০২৩ সালে ছিল ৪২টি। অর্থাৎ এক বছরে তিন গুণের বেশি বেড়েছে শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিনাজপুরে (৪৩টি), রাজশাহী (৩৫টি) ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে (৩৪টি) বেশি। বাকি সাধারণ বোর্ডগুলোতে এমন প্রতিষ্ঠান ৪ থেকে ২০টির মধ্যে। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ৩৭টি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২২টি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেননি। এক বছরের ব্যবধানে শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি শিক্ষাব্যবস্থার করুণ চিত্রই তুলে ধরেছে।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চলের এবং বেসরকারি ও নন-এমপিও (সরকার থেকে অনুদান পায় না) এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতে গোনা, ক্লাস অনিয়মিত, শিক্ষকসংকট চরম, অবকাঠামোও ভালো নয়।
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দোকার এহসানুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। তথ্য পেলে ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন২০২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাই অকৃতকার্য১৬ অক্টোবর ২০২৫যেনতেন কলেজময়মনসিংহের ত্রিশালে সিটি রয়েল কলেজ থেকে এ বছর ১৩ জন পরীক্ষা দিয়ে কেউ পাস করতে পারেননি। গতকাল বেলা ১১টার দিকে কলেজে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের ভেতরে চলছে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পাঠদান। প্রতিষ্ঠানটিতে টিনশেডের একটি স্থাপনা, দুটি আধা পাকা ভবন এবং একটি একতলাবিশিষ্ট ভবন। অধ্যক্ষের কক্ষে তালা। একটি একতলা ভবনে লেখা সিটি রয়েল কলেজ ডিজিটাল ল্যাব, সেটিও তালাবদ্ধ। পাশেই আইসিটি ল্যাবের দরজা খোলা থাকলেও কিছু টেবিলে ধুলার আস্তরণ পড়েছে। সেখানে কলেজের কোনো শিক্ষার্থীকে দেখা গেল না। বাইরের ফটকে সিটি রয়েল কলেজ লেখা থাকলেও ভেতরে কিন্ডারগার্টেনের কার্যক্রম চলতে দেখা গেল। কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষক কবির হোসাইন। তিনি আবার সিটি রয়েল কলেজের কম্পিউটার অপারেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
কলেজে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম হয় বলে জানালেন কবির হোসাইন। প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এমন অবস্থা বলেও তাঁর মত।
দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদাড় স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে চারজন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। গতকাল সকালে ওই কলেজে গিয়ে জানা যায়, ১৯৪৯ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক শাখা দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। তবে ২০১৩ সালে কলেজ শাখা চালু হয়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল কাসেম বলেন, প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখা ও শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত নন। ফলে বেতন না হওয়ায় শিক্ষকেরা কলেজে আসেন না। শিক্ষার্থীও না আসায় কলেজে পাঠদানও হয় না।
ভোলা সদর উপজেলার মেদুয়া কলেজ ও ভাষাশহীদ কলেজে এইচএসসিতে কেউ পাস করেননি। ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের শান্তিরহাট এলাকায় ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মেদুয়া কলেজ। একটি টিনশেড ভবনে চারটি কক্ষ নিয়ে কলেজটি। চলতি বছরে ৮৭ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন। ১৮ জন শিক্ষকের স্থলে ৭ জন শিক্ষককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা কামাল বলেন, তাঁরা প্রথমবার ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি করেছিলেন। যাঁদের কেউ কেউ চাকরি করেন, কেউ ছিলেন সংসারী।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ফতেপুর ময়নাল হক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেননি। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ১৮ জন শিক্ষার্থী মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশ নেন। ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
করণীয় কীঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের উচিত শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে একাডেমিক এবং প্রশাসনিক বিষয়গুলো যাচাই করা। এখানে শিক্ষকেরা একাডেমিক বিষয়গুলো দেখবেন আর শিক্ষা বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখে প্রতিবেদন দেবেন। এতে যদি দেখা যায় আঞ্চলিকতার প্রয়োজনে কোথাও কোথাও কলেজ বা সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন (যেমন চর এলাকা), তাহলে সরকারের উচিত হবে সেগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে ভালোভাবে চলতে সহায়তা করা। আর যেগুলোর আঞ্চলিকতার বিবেচনায় প্রয়োজন নেই, সেগুলো পার্শ্ববর্তী অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ, ভোলা, বিরামপুর, দিনাজপুর ও মির্জাপুর, টাঙ্গাইল]