দীপাবলি: অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর উৎসব
Published: 20th, October 2025 GMT
আশ্বিনে রামচন্দ্রের শারদোৎসবে অকালবোধনের পর অবশেষে লঙ্কায় গিয়ে রাবণ–বধ সম্পন্ন হয়েছিল বিজয়া দশমীতে। লঙ্কায় রাবণ–বধ ও যুদ্ধজয়ের পর সীতাকে উদ্ধার করে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরেছিলেন।
১৪ বছর বনবাসের পর সীতাকে সঙ্গে নিয়ে রাম ও লক্ষ্মণ যখন অযোধ্যায় ফেরেন, প্রজারা তাঁদের এমন রাজকীয় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বিজয়ার পরবর্তী কার্তিক মাসের অমাবস্যার দিনে ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে দীপাবলি উৎসব পালন করেন।
এ যেন এক পুনর্মিলনের উৎসব। আজও বাঙালি ছাড়া অন্যান্য ভাষার সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও এই দীপাবলি উৎসব নিষ্ঠার সঙ্গে উদ্যাপন করে থাকেন।
সাধারণত ‘দীপ’ শব্দের অর্থ আলো এবং ‘বলি’ মানে সারি বা শ্রেণি। অর্থাৎ আলোর মালা বা আলোর সারি বোঝানো হয় দীপাবলিকে।হিন্দিবলয়ে এই উৎসবের নাম ‘দিওয়ালি’। দিওয়ালিতে সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা হয়ে থাকে। সংস্কৃত শব্দ ‘দীপাবলি’ থেকেই ‘দিওয়ালি’ শব্দটির আবির্ভাব। সাধারণত ‘দীপ’ শব্দের অর্থ আলো এবং ‘বলি’ মানে সারি বা শ্রেণি। অর্থাৎ আলোর মালা বা আলোর সারি বোঝানো হয় দীপাবলিকে।
এই প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গানের পঙ্ক্তি স্মরণ করা যেতে পারে—‘যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো—/ জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে’। কিংবা ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,/ জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে।’
আরও পড়ুনদুর্গাপূজা: বাঙালি সমাজের এক মহামিলনোৎসব২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫আধুনিককালে মানবজীবনের নিত্যকার অবসাদ বিষাদ আঁধার ঘুচিয়ে জ্ঞানের আলো জ্বালানোর আহ্বান তিনি এই দীপালিকায় করে গেছেন। সনাতন ধর্মের প্রাজ্ঞজনেরা বিশ্বাস করেন, এই আলোর উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষ জ্ঞানের আলোর পথ খোঁজে।
একসময় অখণ্ড ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় পাঁচ দিন ধরে দিওয়ালি উৎসব পালিত হতো।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে জানা যায়, আশ্বিন মাসের নরক চতুর্দশীর দিন ভগবান বিষ্ণু প্রবল পরাক্রমশালী নরাসুরকে বধ করেছিলেন। তাঁর বধের মধ্য দিয়েই বসুন্ধরার সৃষ্টি। তাই এই বসুন্ধরার জন্মের তিথি উপলক্ষে গৃহস্থরা নিজ নিজ ঘরদোর সব পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে রাখে। সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বালন করে নতুনের আহ্বান জানানো হয়।
দিওয়ালি বা দীপাবলি উৎসবে আরেকটি বিষয় সনাতনীদের মধ্যে লক্ষ করা যায়, সেটির নাম ধনতেরাস। ধনত্রয়োদশী তিথি থেকে ধনতেরাস শব্দের উৎপত্তি। নতুন জামাকাপড় কেনা, গৃহস্থ পরিবারের প্রয়োজনীয় বাসনপত্র ও আসবাব কেনা এবং সম্পদ হিসেবে সোনা–রুপাও ক্রয় করে গৃহস্থ পরিবারগুলো।
একসময় অখণ্ড ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় পাঁচ দিন ধরে দিওয়ালি উৎসব পালিত হতো।সারা উত্তর ও মধ্য ভারতজুড়ে যখন দিওয়ালি উৎসব পালিত হয়, বাঙালি সনাতন ধর্মাবম্বলীরা আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে কালীপূজা উদ্যাপন করেন। কালীপূজা মূলত অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত করে শুভ শক্তির সাধনা। শুধু আলো জ্বালিয়েই উৎসবের উদ্যাপন শেষ হয় না। আকাশে-বাতাসে আতশবাজি পোড়ানোর ধুমও দেখা যায়। অশুভ শক্তি বিতাড়নের এটাও এক প্রাচীন আচার।
আলো ও বাজির এই উৎসব মূলত আনন্দের উৎসব। জ্যোতির্বিদেরা মনে করেন, কার্তিক মাসের অমাবস্যা বছরের সবচেয়ে তমসাঘন রাত। আকাশে হিমের পরশ পড়তে থাকে। এই ঘন আঁধার রাতেই নাকি ভূতপ্রেতরা নৃত্য করতে বেরিয়ে পড়ে। এমন দুই প্রেত, ডাকিনী ও যোগিনীকে দেখা যায় কালী মায়ের মূর্তির পাশে।
পৌরাণিক মতে, এরা খুবই ভয়ংকর। তাই অশুভ শক্তি হিসেবে তারাও পূজিত হয় কালীমূর্তির সঙ্গে। ‘স্কন্দপুরাণ’ মতে দেখা যায়, দেবী চণ্ডী রক্তবীজ নিধন করার সূত্রে কালীমূর্তি ধারণ করেছিলেন। রক্তবীজের প্রতিটি রক্তফোঁটা থেকে অসুরের জন্ম হয়েছিল। শেষে চণ্ডী ভয়ংকরী হয়ে উঠে কালীমূর্তি ধারণ করে সমস্ত রক্ত পান করলে দানবকুলকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়।
আরও পড়ুনরাখিবন্ধন: ভেদাভেদ ভুলে মানবতার উৎসব০৯ আগস্ট ২০২৫বঙ্গদেশে কার্তিক মাসের এই কালীপূজা ‘দীপান্বিতা কালীপূজা’ নামে খ্যাত। এই ভূমিতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই শাক্ত সাধনার প্রচলন ছিল। কালীর অপর নাম শ্যামা। শ্যামা নামেও তিনি এই তিথিতে পূজিত হন। মহাদেবের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে হাতে খড়্গ ও কাটা মুণ্ডু নিয়ে কালীর বা শ্যামার ভয়াল সুন্দর রূপ তন্ত্রসাধনার একটি অলৌকিক ভাবনা।
‘স্কন্দপুরাণ’ ছাড়াও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনিতে দেখা যায় শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই অসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন আদ্যাশক্তির কোষ থেকে উদ্ভূত দেবী কালী। কোষ থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে তাঁর আরেক পরিচয় ‘দেবী কৌশিকী’।
এই রূপ ধারণের পর দেবীর গায়ের রং কালো হয়ে উঠলে তাঁকে কালী নামে চিহ্নিত করা হয়। দানবকুলকে নিঃশেষ করতে গিয়ে তাঁর ভয়াল রূপ প্রকাশ পায়। গলায় নরমুণ্ডের মালা, চার হাতে এক এক করে খড়্গ, কাটা নরমুণ্ড এবং বরাভয় ও আশীর্বাদের মুদ্রা লক্ষ করা যায়।
বঙ্গদেশে কার্তিক মাসের এই কালীপূজা ‘দীপান্বিতা কালীপূজা’ নামে খ্যাত। এই ভূমিতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই শাক্ত সাধনার প্রচলন ছিল। কালীর অপর নাম শ্যামা।কালীর অনেক রূপের কথা পুরাণে আছে। বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরে তিনি করুণাময়ী, ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী নামে পূজিত হয়ে থাকেন। ইতিহাস বলে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মাধ্যমেই বাংলায় কালীপূজার প্রচলন শুরু হয়। সাধারণত গৃহস্থ বাড়িতে ব্রাহ্মণ্যমতে কালীপূজা সম্পন্ন হলেও বহু মন্দির এবং শ্মশানে তান্ত্রিক মতে তিনি পূজিত হন। কালীপূজায় অতি অবশ্যই রক্তজবা ফুল লাগে। এই ফুল না হলে পূজা সম্পূর্ণ হয় না।
কালীপূজার একটি বিশিষ্ট দিক বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক সৌভ্রাতৃত্বের উদাহরণস্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বাংলার পল্লিসমাজে শ্যামাসংগীতের স্থান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রামপ্রসাদ সেন থেকে কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, কাজী নজরুল ইসলাম অনেকেই বিভিন্ন সময়ে শ্যামাসংগীত রচনা করে বাংলার পল্লিসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
এ ছাড়া রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কালীভক্তির কথা আজ বিশ্বের দরবারে নন্দিত হয়ে থাকে। তাঁর প্রিয়তম শিষ্য বিবেকানন্দের স্থাপিত রামকৃষ্ণ মিশনের বিশ্বব্যাপী জনসেবার কথাও আজ আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুনকালীপূজায় কেন জবা ফুল লাগে৩১ অক্টোবর ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ব ল ও আল উৎসব প ল র উৎসব দ প বল
এছাড়াও পড়ুন:
দিনভর আনন্দ উৎসবে ‘সোনার মানুষ’ হওয়ার প্রত্যয়
জেরিন, নিশাত ও নুসরাত তিনজনই ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির পড়াশোনার চাপে ফলাফলের পর তিন বান্ধবীর আর দেখা হয়নি। আজ বুধবার কৃতী শিক্ষার্থী উৎসবে দেখা হওয়ায় তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন।
নিশাত তাসনিম বলেন, ‘পড়াশোনার চাপে অনেক দিন বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হয়নি। আজ দেখা হয়ে খুব ভালো লেগেছে। শুধু আড্ডা নয়, সবার ভর্তি প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।’
আজ ময়মনসিংহে ‘প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি–প্রথম আলো জিপিএ–৫ কৃতী শিক্ষার্থী উৎসব ২০২৫’–এ যোগ দিয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন কৃতী শিক্ষার্থী নিশাত তাসনিম। ময়মনসিংহ নগরের টাউন হলের তারেক স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত উৎসবে নিবন্ধন করেন প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী। উৎসবে সহযোগিতা করে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা।
‘স্বপ্ন থেকে সাফল্যের পথে, একসাথে’ প্রতিপাদ্যে সারা দেশে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পাওয়া কৃতী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এবারই প্রথম এই উৎসবের আয়োজন করেছে প্রথম আলো। চট্টগ্রাম, রংপুর, ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীর পর আজ ময়মনসিংহে হলো ষষ্ঠ এ আয়োজন। অন্য বিভাগগুলোয়ও এমন আয়োজন হবে। উৎসবের পৃষ্ঠপোষক প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।
সকাল থেকেই কৃতী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে টাউন হল মাঠ। নির্ধারিত বুথ থেকে ক্রেস্ট, স্ন্যাকস ও ডিজিটাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। জীবনের লক্ষ্য লেখার বোর্ডে অনেকে লিখছিলেন নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এসব লেখায় মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বৃত্তি নিয়ে বিদেশ গমন কিংবা ভালো মানুষ হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তাঁরা।
অনুষ্ঠানে কৃতী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেন অতিথিরা। বুধবার ময়মনসিংহ টাউন হল মিলনায়তনে