ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছিল দেশের ক্ষমতার পালাবদলসহ বড় ধরনের আমূল পরিবর্তনের প্রত্যাশায়। যেখানে মৌলিক সংস্কার এবং নির্বাচন দুটো বিষয়ই ছিল। সবাই সারাক্ষণ অভ্যুত্থানের সাফল্যের পেছনে ছাত্র-জনতার কথা বললেও উপেক্ষিত থাকছে জনসাধারণ। সাধারণ মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ, যাঁরা ভোটের মাধ্যমে নিজেদের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। দেশের বিপুল এই জনগোষ্ঠীর মতকে বিবেচনায় না নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণবিষয়ক এক আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এমন মন্তব্য করেছেন। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) অষ্টম বার্ষিক সম্মেলনের ওই প্যানেল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এখনই নির্বাচন চায়, সংস্কার চায় না। অথচ গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো সংস্কার এবং নির্বাচন উভয়ই হতে হবে। কাজেই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে রাখার ধারার অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে।

সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, প্রধান দুই দলই এককভাবে শক্তিশালী নেতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। প্রধান দলগুলোর অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার মূল উৎস খুঁজতে গেলে দেখবেন, প্রত্যেকেরই ছিল শক্তিশালী পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব। পরিবারতান্ত্রিক নেতারা তাঁদের ক্ষমতার চর্চার বিষয়ে শক্তিশালী ছিলেন। এবং তাঁরা তাঁদের দলের অগণতান্ত্রিক চর্চায় অবদান রেখেছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই দলগুলোর অগণতান্ত্রিক চর্চার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। দলগুলোর নেতারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা করেছেন। প্রধান দলগুলোকে কীভাবে গণতান্ত্রিক করা যাবে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।

রেহমান সোবহান বলেন, দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা আর সহিংসতা এখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে পারে।

ছাত্রদের প্রতি ইঙ্গিত করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘আপনারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন। আপনারাই প্রথমবারের মতো তৃতীয় কোনো দল গঠন করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। এখন আপনাদের দল গণতান্ত্রিক হয় কি না, সেটা দেখতে হবে। যখন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধান দলগুলোকে তাদের আসনগুলোতে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন, তখনই আপনারা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবেন।’

সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, রাজনীতি এখন টাকার ক্ষমতার কাছে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। ফলে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর মাঝে বিভাজনরেখার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। অনেক বছর ধরেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ আর আদর্শিক নেই। আর্থিক সুবিধা পেতে হলে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াটা সবচেয়ে সহজ পথ। এই সমস্যা শুধু জাতীয় সংসদের প্রধান পদে নয়। এটা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। সবারই ব্যবসায়িক স্বার্থ ছিল। আওয়ামী লীগ এখন মাঠে নেই। কিন্তু তাদের সেই শূন্যতা পূরণ হয়ে গেছে।

দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা আর সহিংসতা এখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে হবে।অধ্যাপক রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি

‘গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নির্মাণ: জনগণকে চালকের আসনে রাখা’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মির্জা এম হাসান।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের পর আলোচনার সূত্রপাত করতে গিয়ে অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, ‘আমরা সারাক্ষণই এখন বলছি ছাত্র-জনতা। কিন্তু তার বাইরে আরেকটা ক্যাটাগরি (শ্রেণি) রয়েছে। সেটা হলো জনসাধারণ। ছাত্ররা কী, তা আমরা বুঝি। আর জনতা বলতে রাজপথের রাজনীতিতে যারা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে জনসাধারণ। তারা সাইলেন্ট মেজরিটি। তারা অপেক্ষায় থাকে সেই নির্বাচনের দিনটার জন্য। গোপন ব্যালটের মারফতে তারা তাদের মতের প্রতিফলন ঘটাবে।’

জুলাই-আগস্টের পর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে রওনক জাহান বলেন, ‘এখন সবাই কথা বলতে পারছে। ভয়ের সংস্কৃতি নেই। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে সবাই কথা বলছে, কেউ শুনছে না। কোনটা সত্যি আসলে? এত রকম ন্যারেটিভ বের হয়ে যাচ্ছে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে আমরা চাচ্ছি যে সবারই স্বাধীনতা থাকুক এবং ভয়ের সংস্কৃতি না থাকুক। কিন্তু আমি শুনেছি যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্যাগিং আর এই সেই নানা কারণে লোকজন আসলে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে না। তাহলে আমরা সত্য কীভাবে প্রতিষ্ঠা করব। নানা কারণে নানা জিনিস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা আমাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’

জুলাই অভ্যুত্থানকে অনেকেই বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।
এটা যদি বিপ্লব হতো, তাহলে সংস্কার কমিশনের কোনো প্রয়োজন হতো না
অধ্যাপক আলী রীয়াজ, প্রধান, সংবিধান সংস্কার কমিশন।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা এলিট রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন চাই। সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিষয়ে যে সমালোচনা এসেছে, তার জবাবে বলতে চাই যে বিদ্যমান এলিট রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বদলে নতুন একটি উদার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে এবং আমরা সেটাই করার চেষ্টা করছি। এর চেয়ে ভালো কী হতে পারত? হয়তো পারত। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিবেচনায় রেখে আমরা মনে করেছি এর চেয়ে ভালো কোনো সমাধান হতে পারে না।’

আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানকে অনেকেই বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। আমি তা মনে করি না। এটা যদি বিপ্লব হতো, তাহলে এসব সংস্কার কমিশনের কোনো প্রয়োজন হতো না। কাজেই আমরা পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অধীনেই আছি। এ জন্যই বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে হবে। আলোচনা তাঁদের সঙ্গেও চালাতে হবে, যাঁরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন অর্থাৎ ছাত্ররা, যাঁরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন।’

আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার করতে হলে মৌলিক অধিকার কীভাবে যুগোপযোগী করা যায়, সেটা ভেবে দেখতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণের বিষয়ে, বিচার পাওয়ার বিষয়ে আমরা কতটা সোচ্চার হতে পেরেছি। যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে কতটা সোচ্চার হতে পারছি। এ মুহূর্তেও আমরা দেখছি যে এই ইস্যুতে এক হওয়া যাচ্ছে না। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পরও আমরা দেখছি যে এটা অস্বীকার করার নানা চেষ্টা হচ্ছে। এখানে জনগণের কণ্ঠ কতটা উচ্চকিত হবে, সেটা একটা পরীক্ষা আমাদের জন্য।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের সাড়ে ছয় মাস পর আমাদের সবার কি খোলামনে কথা বলার পরিবেশ আছে? নেই। ছাত্র-জনতার কথা বলছি। অনেক আলোচনা, এত গণতন্ত্রের কথা, সুদিনের কথা, কিছু একটা করলেই সমাধান আসবে। এসবের সঙ্গে কি আমরা জনসাধারণকে যুক্ত করছি?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক আসিফ এম শাহান আলোচনায় অংশ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অতীতের সরকারব্যবস্থায় মানুষের কথা শোনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা শুধু নির্বাচনে আটকে নেই। কেবল ক্ষমতার পালাবদলের জন্য এ অভ্যুত্থান হয়নি।

বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবির বিষয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমরাও নির্বাচন চাই, তবে তারা সংস্কার চায় না। জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নামে আছে স্থানীয় প্রশাসনব্যবস্থা। এর বদল করতে হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব ছ ত র জনত হ ন বল ন ব যবস থ ক ষমত র দলগ ল র আম দ র মত র প সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ