সহস্রাধিক ব্যবসায়ীর সংগঠন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন এই ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার কথা থাকলেও নানামুখী চাপে তা হয়নি। হয়েছে সমঝোতার কমিটি।
একই কায়দায় ভোট ছাড়া নেতা নির্বাচন করা হয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনেও। গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলেমিশে সংগঠনটির নেতৃত্ব দখলে নিয়েছে। অথচ ভোট দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে মুখিয়ে ছিলেন চট্টগ্রাম কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্টদের প্রায় আড়াই হাজার সদস্য। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিনা ভোটে পদ ভাগাভাগির ঘটনা ঘটল এই অ্যাসোসিয়েশনে।

এদিকে প্রতিষ্ঠার ১৩২ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম নির্বাচন পণ্ড হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির। এখানে ছিলেন ৫ হাজার ৪০৪ ভোটার।
ব্যালট বাক্স ছিনতাই অভিযোগের কারণে ফল ঘোষণা করা যাচ্ছে না খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির নির্বাচনের। শতবর্ষী চিটাগং চেম্বারের নির্বাচন নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা। সেখানেও ভোটহীন সমঝোতার কমিটি করার দাবি তোলা হয়েছে।

চাপ, ভয় আর আতঙ্ক তৈরি করে পেশাজীবী সংগঠনের একের পর এক নির্বাচন এভাবে পণ্ড হওয়ায় ক্ষুব্ধ অনেক ভোটার। নতুন বাংলাদেশ দেখার প্রত্যাশা করা পেশাজীবী অনেকেই এখন হতাশ।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। গত ৫ আগস্টের পর আমরা সবাই নতুন বাংলাদেশ চেয়েছি। সেখানে এমন চিত্র বেমানান। চরম হতাশারও।

পদ ভাগাভাগি
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ২৯ পদের মধ্যে বিএনপি ১৩টি, আওয়ামী লীগ ১০টিসহ অন্যরা ৬টি পদ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কখনও এ সংগঠনে সমঝোতার নির্বাচন হয়নি। অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য ভোটার নাম প্রকাশ না করে বলেন, ৫০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম বিনা ভোটে পদ ভাগাভাগির ঘটনা ঘটল। অথচ আমরা ভেবেছিলাম, নতুন বাংলাদেশে এবার ভিন্ন কিছু হবে। হয়েছে ঠিক এর উল্টো। এ সংগঠনের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি। ভোটাররা অভিযোগ করেন, সেদিনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৯ প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এএসএম সাইফুল আলম সভাপতি ও  বিএনপি সমর্থক মো.

শওকত আলী সাধারণ সম্পাদক হন। তবে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নবনির্বাচিত সভাপতি এএসএম সাইফুল আলম বলেন, ‘জনমতের বাইরে গিয়ে আমরা কিছুই করিনি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলেমিশে পদ ভাগাভাগি করিনি। আগে এ সংগঠনের সব পদ দখল করেছিল আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা। এখন সব মতের সম্মিলন ঘটেছে। এটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যও হয়েছে।’

১৬ বছর ভোট নেই 
আওয়ামী লীগের শাসনামলে অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। এবারও ভোটের সব আয়োজন করে শেষ পর্যন্ত বিনা ভোটে নেতা বাছাই করা হয়। সমঝোতার মাধ্যমে ‘নেতা’ হয়েছেন ৪১ জন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পর ২০০৯ সাল থেকে এই অ্যাসোসিয়েশনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে মাহবুবুল আলম ও ছৈয়দ ছগীর আহমেদ। মাহবুবুল আলম চার দফায় চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি থাকার পরও খাতুনগঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদ ছাড়েননি। এবার ব্যতিক্রম কিছু হবে বলে ধারণা করেছিলেন ভোটাররা। কিন্তু বিধি বাম! ১২ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের কথা ছিল। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী না থাকার ছুতায় সেদিনই চূড়ান্ত নির্বাচিত তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। মীর গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ আবদুস সালাম সভাপতি ও মো. আমিনুর রহমান বিনা ভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ব্যালট বাক্স ছিনতাই
চট্টগ্রামে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ঘটনায় স্থগিত রয়েছে বাংলাদেশ খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির ভোটের ফল। করণীয় ঠিক করতে জেলা প্রশাসন, শ্রম অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থায় চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এখানে নির্বাচন হয় ৩০ নভেম্বর। খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউছুপ খান মাহাবুব এর আগে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ভোট থেকে শুরু করে গণনা পর্যন্ত সব কিছু ঠিকভাবে হয়েছে। তবে ভোট গণনার শেষ দিকে একজন সভাপতি প্রার্থী দলবল নিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালান। তাই ফল স্থগিত আছে।

হোঁচট খেল ১৩২ বছরের আইনজীবী সমিতি
‘চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ১৩২ বছরের ঐতিহ্য এবার হোঁচট খেল। প্রথমবারের মতো আমরা তা হারালাম। এটা দুঃখজনক। এর জন্য রাজনীতিবিদ আইনজীবীরাই অনেকাংশে দায়ী।’ গত ১০ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পণ্ড হওয়ার পর এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানান চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামীপন্থি আইনজীবীর মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দিলে নির্বাচনের ৬ দিন আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি একযোগে পদত্যাগ করেন ৫ নির্বাচনী কর্মকর্তা, যা এর আগে কখনোই হয়নি। পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করা হয়, উত্তেজনা বাড়তে থাকায় নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগের প্রস্তাব করে একটি আবেদন দেয়। অন্যদিকে বিএনপিপন্থি ঐক্য পরিষদ ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মনোনয়ন বাতিলের জন্য আবেদন করে। দুটি আবেদনই সমিতির গঠনতন্ত্রবহির্ভূত। চিঠিতে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ না থাকার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে তারা হেনস্তা, ভয়ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে নির্বাচন প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করতে অ্যাডভোকেট মকবুল কাদের চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি। আগামী ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে তাদের।

শতবর্ষী চট্টগ্রাম চেম্বারের নির্বাচনও হুমকির মুখে
এত বছর আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এমএ লতিফ ও সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল শতবর্ষী চট্টগ্রাম চেম্বার। সেখানে এবার পরিবর্তনের দাবি তুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে এখন প্রভাবশালী একটি অংশ চাইছে নিজেদের পছন্দের মানুষ নিয়ে কমিটি গঠন করতে। আবার ‘টাউন অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘ট্রেড গ্রুপ’; ওই দুটি শ্রেণির সদস্য বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়েছে ‘চট্টগ্রাম সচেতন ব্যবসায়ী সমাজ’ নামে আরেকটি গ্রুপ। চট্টগ্রাম সচেতন ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষে আহ্বায়ক এসএম নুরুল হক গত ২২ ডিসেম্বর চেম্বার প্রশাসকের কাছে এ চিঠি দেন। চেম্বার প্রশাসক চিঠিটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এসএম নুরুল হক বলেন, সাধারণ ও সহযোগী সদস্যরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেন। তবে ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশনে এক যুগ ধরে কারসাজির মাধ্যমে ছয়জন পরিচালক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর মাধ্যমেই একটি গোষ্ঠী দীর্ঘদিন চেম্বার দখল করে রেখেছিল। ২০১৩ সাল থেকে এ দুই শ্রেণি সদস্য থেকে পরিচালক পদের নির্বাচনে ভোট হয়নি। বিনা ভোটেই ছয়জন পরিচালক নির্বাচিত হন। ঘুরেফিরে দুই শ্রেণির গুটিকয় ব্যবসায়ীই নির্বাচিত হয়েছেন। এখনও একই প্রক্রিয়া রাখতে চাইছে একটি পক্ষ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের একাংশের হস্তক্ষেপ
এদিকে কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীর একাংশ। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের একাংশ ২৬ জানুয়ারি বিক্ষোভ করে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে। এই বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদদের রক্তের ওপর আওয়ামীপন্থি ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।’ 
এ ছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের প্রত্যাখ্যানের দাবিতে ১৫ জানুয়ারি মানববন্ধন করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আরেক অংশ। এ সময় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে ফ্যাসিবাদ ও দুর্নীতিমুক্ত করার আহ্বান জানান তারা। 

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পদ ভ গ ভ গ স গঠন র সমঝ ত র ব যবস য় আইনজ ব হয় ছ ন ল আলম সদস য আওয় ম বছর র ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।

সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’

বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’

শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ

অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।

দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’

রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’

এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’

মামলার পূর্বাপর

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।

রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।

পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে দেশ টিভির আরিফ ও নাসার নজরুলকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো
  • অপরাধ আমলে নেওয়ায় দুই বছরের সময়সীমার বিধান প্রশ্নে রুল
  • আপিল বিভাগের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করলেন নেপালের প্রধান বিচারপতি
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
  • খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন স্থগিত
  • এখন দেখছি নতুন প্রতারকের জন্ম হয়েছে: কায়সার কামাল
  • ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি ডলার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ