চিহ্নিত দুর্নীতিবাজের সঙ্গে আপনার আচরণ কেমন?
Published: 25th, February 2025 GMT
আমার জন্ম ১৯৬৯ সালে। বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে হাতে হাত ধরে বড় হয়েছি। আমাদের শৈশব-কৈশোরে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে আড়ালে-আবডালে ধিক্কার দিতে শুনেছি। তাদেরকে, এমনকি তাদের পরিবারকে পর্যন্ত সামাজিকভাবে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিতে শুনেছি। সমাজে ধারণা ছিল, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের সন্তানেরাও সামাজিকতার যোগ্য নয়।’ দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিশলে নিজেরও দুর্নীতির প্রতি আগ্রহ বাড়তে পারে।
তখন অফিস-আদালতে দুর্নীতিগ্রস্তদের খারাপ মানুষ হিসেবে দেখা হতো। রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও সমাজের প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফোরামে সাহসী মানুষ প্রকাশ্যে কথা বলতেন। এর ফলে তাদের বিভিন্ন ধরনের নিগ্রহের শিকার হতে হতো। মোদ্দাকথা, সেই সময়ে দেশে আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ ছিল। তাতে এক দল চিন্তাশীল মানুষ নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা সমাজে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছেন দুইভাবে– নিজে দুর্নীতিমুক্ত থেকেছেন; অন্যদেরও দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে জানিয়েছেন।
১৯৮২ সালে আমরা কৈশোরের মধ্যগগনে। মাসুদ রানা পড়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হচ্ছি; খেলাঘরসহ বিভিন্ন শিশু সংগঠনে যুক্ত হয়ে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখছি; পাড়ার লাইব্রেরি কিংবা উপজেলার পাবলিক লাইব্রেরিতে আড্ডায় একত্রিত হচ্ছি। এমনকি বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন ও কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ছি। সেই সময়ে আমাদের শৈশব-কৈশোরের চিন্তাভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক চিন্তার একজন ব্যক্তি ‘দেশ পরিচালনার দায়িত্ব’ জোর করে নিয়ে নিলেন; নাম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি ক্ষমতা পেয়েই প্রথম কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের চলমান সমাজ ব্যবস্থায় কয়েকটি বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসেন।
আমরা লক্ষ্য করতে থাকি, এরশাদ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে মানুষের মধ্যে সুপ্ত থাকা ষড়রিপুকে জাগিয়ে তোলার ‘গোপন মিশন’ নিয়ে নেমে পড়লেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুর্নীতিবাজ নেতারা দ্রুতই সেই গোপন মিশনে নাম লিখিয়েছিলেন। মিশনের সাফল্য বাড়াতে এরশাদ ‘সুশীল বুদ্ধিজীবী’ সম্প্রদায়কেও সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার অংশকেও নিষ্ক্রিয় করার পদক্ষেপ নেন। কিন্তু মাত্র এক দশক আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীন হওয়া রুমি-বদীদের বাংলাদেশের গ্রামীণ যাত্রাপালা থেকে তখনও ‘বিবেক’ হারিয়ে যায়নি। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় এক ঐতিহাসিক ঐক্যবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এরশাদের বিদায় ঘটে। বাংলাদেশ প্রবেশ করে নতুন সম্ভাবনার প্রান্তরে।
সময়টা ১৯৯১। ওই বছর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবেশ করি। আমরা ততদিনে কৈশোর পেরিয়ে দেশের ‘তরুণ ভোটার’। সরকারে আমরা। বিরোধী দলেও আমরা। চোখে আমাদের বিপুল-বিশাল স্বপ্ন। কিন্তু ভোটের ফলাফলের দিনেই বুঝে গেলাম– ‘এরশাদের গোপন মিশন’ সফল হয়েছে।
১৯৯০ সালে এরশাদকে সবাই মিলে হটালেও এরশাদের ‘পুঁতে দেওয়া দুর্নীতির বৃক্ষ’ মানুষের মন ও মগজ ‘খেয়ে ফেলেছে’। রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদকে হটানো এবং দেশকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে নয়, একতাবদ্ধ হয়েছিল ‘ক্ষমতার লাঠি’ নিজেদের হাতে নেওয়ার জন্য। বয়সীরা তখনও নষ্ট না হলেও আমাদের বাপ-চাচারা ততদিনে ভেতরে ভেতরে পচে গিয়েছিল। এর দুর্গন্ধ পরবর্তী এক দশকে দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের প্রজন্মও পরবর্তী সময়ে শৈশব-কৈশোরের শিক্ষাকে ‘ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে’ দ্বিধা করেনি। ফলে ২০০৭ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের আর্থিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ধরা পড়া বড় বড় দুর্নীতিবাজের মধ্যে আমাদের বয়সীরাও ছিল। সেই সময়ের পত্রপত্রিকায় তাদের কারও কারও পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। কারওটা হয়নি। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আগের সব দুর্নীতিবাজ সমাজে প্রবল প্রতাপ নিয়ে ফিরে এলো। সমাজের মানুষও তাদের বরণ করে নিল। এখানেই প্রশ্ন– চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপনার আচরণ কেমন?
আমার পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা হলো, গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত দেশজুড়ে মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে দুর্নীতির প্রতি ঘৃণা থেকে নয়; দুর্নীতিতে যুক্ত না হতে পারার আক্ষেপ থেকে। আমরা আসলে নিজে দুর্নীতির সুযোগ খুঁজি। এ কারণেই গত ৫৩ বছরে দুর্নীতির বিস্তার না কমে বেড়েছে এবং আর্থিক দুর্নীতি ছাড়াও এখন আমরা চিন্তাচেতনায় দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। দুর্নীতি করার কৌশল হিসেবে দেশে ‘মুখোশ পরা’ মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।
যে কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম– দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে না পারলেও পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ঘৃণা করা, ফিসফিস করে হলেও দুর্নীতিবাজ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বলা এবং সামাজিকভাবে বয়কট করা; সেই জায়গাটা নিশ্চিহ্ন ও নির্মূল হয়ে গেছে। ভালোর ওপরে খারাপের বিজয় ঘটেছে। সমাজ কাঠামোর মধ্যেই দুর্নীতির শিকড়ের বিস্তার ঘটেছে।
এখন মানুষের মন ও মননে দুর্নীতি একটি শব্দ মাত্র। অনেকের কাছেই এটা আরাধ্য, কিন্তু অধরা। গ্রামাঞ্চলে কাঠ-চাল দিয়ে ঘর বানাতে পেরেক ব্যবহার করে। বড় পেরেককে বলে গজাল। এরশাদ মানুষের মগজে দুর্নীতির যে পেরেক ঢুকিয়েছেন, শেখ হাসিনা সেটাকে ‘গজাল’ করেছেন। দেশকে সত্যিকারের দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে ওই গজালগুলো বের করে ফেলতে হবে। সেখানে উপযুক্ত মলম লাগাতে হবে।
দুর্নীতি রোধ ও নিরাময়ে আমরা কতটা এগোলাম, সেটা দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপনার আচরণ দেখে নিজেও বুঝতে পারবেন। আপনি কি তাদের দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন? সালাম দিচ্ছেন? প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তাদের প্রশংসা করছেন? অবৈধ সম্পদ অর্জনকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন? অনুষ্ঠানে অতিথি করছেন? এই ছোট ছোট বিষয় দিয়েই বুঝতে পারি, দুর্নীতিবাজদের প্রতি আমাদের মনোভাব কেমন; আমরা আসলে কী চাই। দুর্নীতিবাজদের ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে বয়কট করা ছাড়া দেশ দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আচরণ পরিবর্তনেই দুর্নীতি সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে।
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক;
প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সবুজ এলাকায় পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার কম হয়
উন্মুক্ত স্থান সবুজ থাকার সঙ্গে পুলিশি সহিংসতার সম্পর্ক আছে। সবুজ পরিসর বেশি এমন এলাকায় পুলিশ প্রাণঘাতী গুলি কম চালায়। সবুজ ভূমির সঙ্গে পুলিশের আচরণের এই সম্পর্ক একটি গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্লেমসন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক ও গবেষক। গবেষণার ফলাফল নিয়ে একটি প্রবন্ধ ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড বিহেভিয়ার’ নামের সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে। ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, নিরাপদ পাড়াপড়শি ও এলাকা নিরাপদ হওয়ার পেছনে ভূপ্রকৃতির মান ও পরিমাণের সম্পর্ক আছে।
গবেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রের ৩ হাজার ১০০ কাউন্টির (যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিম্ন প্রশাসনিক অঞ্চল) সবুজ পরিসর ও পুলিশের প্রাণঘাতী গুলির ঘটনার পাঁচ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। সময় ছিল ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল। কাউন্টির মধ্যে মেট্রোপলিটন এলাকার ৮০৫টি কাউন্টিও ছিল।
গবেষণায় সামাজিক একটি পরিপ্রেক্ষিত যুক্ত করার জন্য গবেষকেরা সামাজিক বঞ্চনার কিছু সূচক ব্যবহার করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, শিক্ষার স্তর, শুধু বাবা অথবা মা থাকা পরিবার, ভাড়া বাস, ঘন বসতি, গাড়িবিহীন পরিবার, চাকরিতে থাকা ৬৫ বছরের কম বয়সীদের হার। গবেষকেরা দাবি করেছেন, কঠোর নিয়মকানুন মেনে গবেষণাটি করা হয়েছে।
গবেষকদের মধ্যে একজনের সংশয় ছিল যে সবুজের সঙ্গে প্রাণঘাতী গুলি বেশি ব্যবহারের সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নেতিবাচক সম্পর্কই পাওয়া যায়। অর্থাৎ সবুজ যেখানে বেশি, গুলির ব্যবহার সেখানে কম।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মেট্রোপলিটন এলাকার যেসব কাউন্টিতে সবুজ বেশি, সেখানে প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার ১৫ শতাংশ কম। আর পুরো যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কাউন্টিতে সবুজ বেশি, সেখানে প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার ৯ শতাংশ কম। আবার সবুজের পাশাপাশি বঞ্চনা বেশি এমন এলাকাগুলোতে পুলিশের গুলির ঘটনা কম। সামাজিক বঞ্চনার নানা স্তরেই এটা দেখা গেছে।
সবুজের সঙ্গে পুলিশি সহিংসতার সম্পর্ক কী
গবেষকেরা বলছেন, সবুজ এলাকা যত বেশি, পুলিশি সহিংসতা তত কম হওয়ার সম্ভাব্য চারটি কারণ থাকতে পারে: ক. কোনো এলাকা সবুজ থাকার অর্থ এলাকাটিতে আশপাশের মানুষের আনাগোনা বেশি; খ. কোনো এলাকা সবুজ থাকার অর্থ এলাকাটির নিয়মিত যত্ন নেওয়া হয়, দেখভাল করা হয়; গ. সবুজ এলাকায় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে; ঘ. সবুজ পরিবেশে অপরাধ কম হয়।
গবেষণা প্রবন্ধে আগের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সবুজ পরিসর মানসিক চাপ থেকে দ্রুত সামলে উঠতে সহায়তা করে। সবুজের কারণে অপরাধ ও সহিংসতা কম হয়।
গবেষকেরা বলছেন, সবুজ এলাকায় পুলিশ কর্মকর্তারা কম মানসিক চাপে থাকেন, তাঁরা দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব দেখাতে চান। তাঁরা সহিংস আচরণ থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে সবুজের ভেতরে বেশি সময় কাটানোর কারণে এলাকাবাসীর মধ্যে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়, এলাকায় একধরনের অনানুষ্ঠানিক নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং ঝগড়া-দ্বন্দ্ব অহিংস পন্থায় মিটমাট হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গবেষকেরা এ-ও বলছেন, বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আরও গবেষণা হওয়া দরকার। কারণ, অনেক সবুজ এলাকায় দুষ্কৃতকারীদের দল বা গ্যাং সক্রিয় থাকে, সবুজ ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিছু মানুষ লুকিয়ে অবৈধ কাজ করে। এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেওয়ার জন্য সবুজের সঙ্গে সহিংসতার সম্পর্ক নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।