গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে। তবে অভ্যুত্থানের সাত মাস পরও সমাজে এখনও দুর্ভাগ্যবশত, কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা আসেনি। রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে অনেক অস্বস্তি ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মূলত রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই উদ্বেগ, অস্বস্তি ও সমন্বয়ের অভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষাকে ক্রমশ পিছিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।
এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে একটি ঘোষণাপত্র দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, তাকে সরকার, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এক রকমের দূরত্ব ও বোঝাপড়ার অভাব বলা যায়। এটিকে অন্তর্বর্তী সরকার ও সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছাত্রদের এক ধরনের চাপ প্রয়োগের চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যাকরণ অনুযায়ী, এ ধরনের ঘোষণাপত্র সাধারণত অভ্যুত্থানের আগে কিংবা আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু অভ্যুত্থানের ছয় মাস পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ঘোষণাটি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, সাধারণত এ ধরনের উদ্যোগ অভ্যুত্থানের শরিকদের সমঝোতার ভিত্তি ও নীতিতে তৈরি হয়। কিন্তু এখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও শরিকদের যথেষ্ট বোঝাপড়া ও যোগাযোগ ছিল না। এখন তো জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তৈরি করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নামে একটি ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ফলে ওই ঘোষণাপত্রের প্রাসঙ্গিকতা ফিকে হয়ে গেছে, বললে ভুল হয় না।
সম্মুখ যোদ্ধা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্রিয় রাজনৈতিক দলের সংগঠনগুলোর মধ্যে আন্দোলনকালে শক্ত ঐক্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষার্থীদের এক রকমের দূরত্ব। এর সঙ্গে সংস্কারের সময়সীমা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের তারিখ আর চলমান সংস্কারে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে ইত্যাদি যুক্ত। সংস্কারের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসা। সংবাদমাধ্যমে আমরা জেনেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।
দেশ পরিচালনার জন্য দরকার রাজনৈতিক দল। আর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি তুলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি; তা কায়েমের মূল চালকও আসতে হবে রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এ গুণগত পরিবর্তন আনতে আগ্রহী বলে মনে হয় না। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ যোদ্ধাদের কাছে এ বিষয়ে আস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং বিদ্যমান রাজনৈতিক পাটাতনে নতুন আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারে এমন রাজনৈতিক শক্তির শূন্যতা রয়েছে। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য একটি রাজনৈতিক শক্তির বিকাশের সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
ছাত্রদের সঙ্গে সমাজের একটি যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের শক্তি ও সংযোগের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠেছে। এখানে পরিষ্কারভাবে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা রয়েছে। কিন্তু জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো একটি রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার জন্য যে প্রস্তুতি, প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক দক্ষতা দরকার, সেটি কিন্তু ছাত্র সংগঠন বা সম্ভাব্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে অনুপস্থিত। সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগের জায়গাটা এখনও স্পষ্ট বা শক্তিশালী নয়। ফলে পুরোনো রাজনৈতিক দলকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে এনসিপিকে শুধু ছাত্রশক্তির ওপর ভর করলে চলবে না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জায়গাটা পরিষ্কার করতে না পারলে তারা খুব বেশি দূর যেতে পারবে, বলা যায় না ।
পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানে শুধু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন বোঝায় না। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে যে শাসন কাঠামো চলে এসেছে, তার সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান-দল-গোষ্ঠীর স্বার্থের আন্তঃসম্পর্ক বোঝানো হয়। এই সম্পর্ক বদলানো খুব সহজ নয়। পুরোনো কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং স্বার্থের জায়গাগুলো সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে এক প্রকার লিখিত-অলিখিত যোগাযোগ রয়েছে। সেই যোগাযোগ ভেঙে দিয়ে নতুন বন্দোবস্তের দিকে যাওয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ।
ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যদি ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া ও যোগাযোগ করে; তাদের সঙ্গে একটি সংযোগ তৈরি করে, তাহলে দূরত্ব কমতে পারে। দ্বিতীয়ত, পুরোনো সম্পর্ক এতই শক্তিশালী যে তারা নতুন সম্ভাব্য রাজনৈতিক শক্তিকে বিনষ্ট করতে সব ধরনের চেষ্টা চালাতে পারে। ছাত্রশক্তির মূল ভরসা হতে পারে তাদের নিষ্ঠা, ত্যাগ ও ভবিষ্যৎমুখী স্বপ্ন। তারা যদি এই তিনটি বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষ ও নাগরিকদের কাছে পৌঁছাতে পারে তাহলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খানিকটা সহজ হবে। তবে এটা অল্প সময়ে হয়ে যাবে, এমন ভাবনা কোনোভাবেই ঠিক নয়।
গণতান্ত্রিক চর্চার স্বার্থে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে সংস্কার আনা জরুরি। এ পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পারলে দলগুলোর মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরিষ্কারভাবে এখনও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব রয়েছে। এখনও প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রায় সব সিদ্ধান্ত দেশের বাইরে থেকে আসে। এই প্রবণতা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের জন্য ইতিবাচক নয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে, দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠা করা। জামায়াতও যদি মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট না করে এবং এ ব্যাপারে ক্ষমা চেয়ে পরবর্তী বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নেওয়ার প্রবণতা না দেখায়, তাহলে তাদের রাজনীতিও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। শুধু এসব কথা এ দুটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এমন নয়। সব দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা দরকার এবং তা প্রকাশ্য হওয়া জরুরি। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রত্যেককে নতুন করে জনসংযোগ ও জনসংগঠনগুলো গড়ে তোলার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।
ড.
kazi.maruf@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র জন ত ক শ র স গঠন র জন য ধরন র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
স্বপ্নে হলো দেখা
কারও স্বপ্নে আপনি প্রবেশ করেছেন বা অন্য কেউ আপনার স্বপ্নে এসেছেন, তাও তখন, যখন আপনি স্বপ্নে নিজের ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছেন– এমনটা কি কখনও ভেবেছেন? বিজ্ঞানীদের দাবি– একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এমনটিই করেছেন তারা, যেখানে দু’জন মানুষের মধ্যে স্বপ্নের ভেতরে যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। এমনটি সত্যি হয়ে থাকলে এটিই হবে প্রথমবারের মতো ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার সময় একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ– যা এখনও বিজ্ঞানের কাছে এক রহস্য।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক নিউরোটেক কোম্পানি রেমস্পেস, যারা মূলত লুসিড ড্রিমিং (স্বপ্নের মধ্যে সচেতন থাকা) ও ঘুমের বিকাশ নিয়ে কাজ করে। তারা জানিয়েছে, ইতোমধ্যে দু’বার দু’জন ব্যক্তিকে লুসিড ড্রিমে প্রবেশ করিয়ে একটি সাধারণ বার্তা আদান-প্রদান করাতে পেরেছে।
কল্পকাহিনির মতো এক স্বপ্নপরীক্ষা
রেমস্পেসের গবেষকরা দাবি করেন, তারা এমন এক প্রযুক্তি তৈরি করেছেন; যার মাধ্যমে দু’জন ব্যক্তি লুসিড ড্রিম অবস্থায় একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। স্বপ্ন এখনও মানবতার জন্য এক বিশাল রহস্য। ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন উজ্জ্বল ভাবনা, দৃশ্য, অনুভূতি ও কল্পনা গঠিত হয়। আমরা প্রায় সবাই স্বপ্ন দেখি, যদিও ঘুম ভাঙার পর তা মনে থাকে না। বিজ্ঞানীরা বলেন, স্বপ্নের মাধ্যমে মস্তিষ্ক আমাদের অনুভূতি ও চিন্তা প্রক্রিয়া করে, স্মৃতি দর্শন করে এবং বাস্তব জীবনে এর প্রস্তুতি নেয়।
স্বপ্নের মাধ্যমে যোগাযোগ
রেমস্পেসের দাবি, গত ২৪ সেপ্টেম্বর, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা নিজ নিজ বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন, তখন রেমস্পেসের তৈরি বিশেষ যন্ত্র ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে দূর থেকে তাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গ, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা, হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস রেকর্ড করে। যখন তাদের সার্ভার শনাক্ত করে যে, একজন অংশগ্রহণকারী লুসিড ড্রিমে প্রবেশ করেছে, তখন তারা একটি র্যানডম শব্দ তৈরি করে সেটি কানে দেওয়া ইয়ারবাডের মাধ্যমে তাকে শুনিয়ে দেয়। কোম্পানি শব্দটি প্রকাশ করেনি– এটি শুধু ওই ব্যক্তি জানতেন এবং স্বপ্নে পুনরায় উচ্চারণ করেন বলে দাবি করা হয়েছে। এরপর সেই প্রতিক্রিয়া সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়। আট মিনিট পরে, দ্বিতীয় অংশগ্রহণকারী লুসিড ড্রিমে প্রবেশ করলে, সার্ভার থেকে তাঁকে সেই রেকর্ডকৃত বার্তা পাঠানো হয়, যা তিনি ঘুম থেকে উঠে বলেন এভাবেই স্বপ্নে প্রথমবারের মতো একটি ‘যোগাযোগ’ সম্পন্ন হয়। রেমস্পেস জানায়, ‘আমরা একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক অর্জন করেছি, এতে লুসিড ড্রিমের মাধ্যমে মানবযোগাযোগ ও সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।’
লুসিড ড্রিম কী?
লুসিড ড্রিম তখন হয়, যখন কোনো ব্যক্তি স্বপ্ন দেখার সময় সচেতন থাকেন যে, তিনি স্বপ্ন দেখছেন। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক জানায়, এটি সাধারণত ঘুমের ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট’ ধাপে ঘটে, যেখানে সবচেয়ে প্রাণবন্ত স্বপ্ন দেখা যায়। এ অবস্থায় মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো স্বপ্নে কাজ করতে পারেন, পরিকল্পিতভাবে কিছু করতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, ‘যে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো– যে তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তা কতটা নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ, এই গবেষণা অন্য কেউ অন্য কোনো জায়গায় করলে একই ফল দেবে কিনা। ঘুমের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টা নিশ্চিত হতে আরও গবেষণার দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মোটা দাগে ঘুমের দুইটা ভাগ আছে– এক. ননরেম ঘুম, যখন আমাদের চোখের মণি নড়ে না; দুই. রেম ঘুম, এ পর্বে আমাদের চোখের মণি নড়াচড়া করে। এ সময়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নও দুই রকমের। লুসিড ড্রিম; যে স্বপ্নগুলো একদম বাস্তবের মতো জলজ্যান্ত। এমন এক স্বপ্ন যা দেখার পর ঘুম থেকে উঠে মনে হবে আসলেই এমনটি ঘটেছে, এটি বাস্তব। আরেকটি স্বপ্ন হলো নন লুসিড ড্রিম। এ স্বপ্নগুলো অবাস্তব। ঘুম ভাঙার পর বেশির ভাগ সময়েই আমরা স্বপ্নের কথা মনে করতে পারি না। লুসিড ড্রিমের ক্ষেত্রে আমরা তা মনে রাখতে পারি।’
প্রথম পরীক্ষার সাফল্যের পর, রেমস্পেসের সিইও মাইকেল রাদুগা (৪০) দাবি করেন, গত ৮ অক্টোবর আরও দু’জনের সঙ্গে একই ধরনের যোগাযোগ সম্ভব হয়। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আগে স্বপ্নে যোগাযোগ ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, আগামী দিনে এটা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে যে, আমাদের জীবনে এটি ছাড়া কল্পনাই করা যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আরইএম ঘুম এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়, লুসিড ড্রিম আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পর বড় শিল্প হতে যাচ্ছে।’
যদিও রেমস্পেস এখনও জানায়নি তাদের প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে, তবে তারা সম্প্রতি ফেসবুকে জানিয়েছে, ‘লুসিড ড্রিমে যোগাযোগ’ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রস্তুত হয়েছে এবং তা একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে পর্যালোচনার জন্য জমা দেওয়া হয়েছে– প্রকাশ হতে সময় লাগবে দুই থেকে ছয় মাস। তবে এখনও এই প্রযুক্তির কোনো বাহ্যিক বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা হয়নি এবং অন্য কেউ এ পরীক্ষা পুনরাবৃত্তি করতে পারেননি।
রাদুগা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনকে বলেছেন, তাঁর প্রত্যাশা– এ ধরনের প্রযুক্তি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মোবাইল ফোনের মতো সাধারণ হয়ে যাবে। ‘মানুষ নিজেদের জীবন এসব ছাড়া কল্পনা করতে পারবে না, কারণ এটি তাদের জীবনকে আরও উজ্জ্বল, আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলবে। এটি মানুষের জীবনমান এমনভাবে বাড়িয়ে দেবে যে, তারা এটি ছাড়া নিজেদের কল্পনাই করতে পারবে না। আমাদের শুধু এগুলো উন্নত করতে হবে– এটি শুধু সময়ের ব্যাপার।’
২০০৭ সালে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় রেমস্পেস এবং ছয় মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়, এখন লুসিড ড্রিমিংয়ে অভিজ্ঞ বা আগ্রহী নতুন অংশগ্রহণকারীদের খুঁজছে।
স্বপ্ন-যোগাযোগের ভবিষ্যৎ
ঘুমের মধ্যে মানুষের যোগাযোগ একসময়ে নিছক কল্পবিজ্ঞান মনে হতো। এখন বিজ্ঞান এটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কল্পনা করুন– হাতের ফোনে মেসেজ না পাঠিয়ে, সরাসরি কারও স্বপ্নে ঢুকে তাঁর সঙ্গে ঘুমের মধ্যে সময় কাটানো, কথা বলা যাচ্ছে।
এই ভাবনা যেন স্বপ্নের মতো। ইতোমধ্যে কিছু কোম্পানি মানুষের চেতনা একটি বিকল্প পরিবেশে স্থানান্তরের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। একবার তা সফল হলে, সম্ভাবনার কোনো শেষ থাকবে না– মানবসভ্যতার বিবর্তন নতুন ধাপে প্রবেশ করবে।
লুসিড ড্রিমের মাধ্যমে নানারকম প্রয়োগ সম্ভব– শরীরগত সমস্যা সমাধান থেকে শুরু করে দক্ষতা অর্জন পর্যন্ত। আগের এক গবেষণায় রেমস্পেস দেখিয়েছে, মুখের পেশিতে সূক্ষ্ম সাড়া থেকে স্বপ্নে উচ্চারিত শব্দ শনাক্ত করা সম্ভব। এখান থেকেই ‘রেমিও’ নামে এক স্বপ্ন-ভাষার জন্ম, যা সেন্সরের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়।
লুসিড ড্রিমে যে র্যানডম শব্দ শোনানো হয় অংশগ্রহণকারীদের, সেখানে ‘রেমিও’ স্বপ্ন-ভাষা ব্যবহার করা হয়। রেমস্পেস জানায়, এই সাফল্য এসেছে পাঁচ বছরের গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের পর। গবেষকরা প্রথম পরীক্ষার পর থেকে প্রতিটি পর্যায়ে প্রযুক্তি আরও উন্নত করেছেন। এবার তাদের লক্ষ্য আরও বড়– লুসিড ড্রিমে রিয়েল-টাইম যোগাযোগ। যদিও এটি অনেক জটিল, গবেষকদের আশা, আগামী কয়েক মাসেই তারা সফল হবেন।
শেষ কথা
যেখানে স্বপ্নে যোগাযোগ এতদিন ছিল সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বা উপন্যাসের বিষয়; এই পরীক্ষা সেটিকে বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। যদি অন্যান্য বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠান একে যাচাই করে, তবে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ধরনই বদলে দিতে পারে– যেখানে ঘুমের মাঝেও আমরা অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারব। এখনই অতি উত্তেজিত না হয়ে সতর্ক আশাবাদী হওয়াই ভালো– প্রযুক্তিটির সাফল্য এখনও গবেষণাগারে পর্যালোচনার অপেক্ষায়; তাতেও একে পুরোপুরি বাস্তব করতে দশককাল লেগে যেতে পারে। v