সংস্কার কিংবা স্রেফ ‘ব্যালট পেপার হওয়ার’ স্বপ্ন
Published: 4th, April 2025 GMT
‘হেলিকপ্টার’ শিরোনামে কবীর সুমনের একটা গান আছে; হেলিকপ্টারে চড়ে নেতার জনগণের কাছে যাওয়ার গল্প। বিদ্রূপাত্মক ভাষা ও গায়কিতে এই যাত্রার যাবতীয় জোগাড়যন্ত্রের বর্ণনায় গানটি হয়ে ওঠে রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটা অসাধারণ স্যাটায়ার। সাম্প্রতিক সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে গানটির শেষ অংশটা আমার খুব মনে পড়ে।
শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার আনন্দ–উচ্ছ্বাস এখনো শেষ হয়নি নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রতিটি দিন যায় আর কমে আসে আনন্দ–উচ্ছ্বাসের তীব্রতা। মাথাচাড়া দেয় আমাদের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্বগুলো; মাঝেমধ্যে দেখা দেয় সংঘাতের আলামত। দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক চর্চার বহু দূরে থেকে একটা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীন বসবাস করে আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি কীভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলো কমিয়ে, নিদেনপক্ষে মেনে নিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করা যায়। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্ন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব তো বটেই, সংঘাতের ঝুঁকি নিয়ে হাজির হয়েছে।
দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তথ্য আমার কাছে নেই, কিন্তু শিক্ষিত শহুরে জনগোষ্ঠীর কাছে ‘সংস্কার’ শব্দটি অতি আলোচিত। বেশ কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার মতো সংস্কারও একটা রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। আমার ঠিক আগের কলামটিতেই লিখেছিলাম, যেকোনো বিষয়কেই যেকোনো রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করতে পারে এবং এটা কোনো নেতিবাচক বিষয় নয়; বরং সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হওয়া আমাদের ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য দুর্দান্ত বিষয় হবে।
সংস্কার নিয়ে বিতর্কের মূল নিহিত রয়েছে শেখ হাসিনার পতন ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে দ্বিমতের মধ্যে। রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের একটা বড় অংশ মনে করে, শুধু শেখ হাসিনার পতন ঘটানোই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য এবং এরপর একটা নির্বাচনী ব্যবস্থায় ফিরে গিয়ে ধীরে ধীরে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠব। আরেকটি অংশ মনে করে, শুধু শেখ হাসিনার পতন নয়, ফ্যাসিবাদের পুনরাগমন ঠেকানোর জন্য জরুরি সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কার করাও ছিল এই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের রাজনৈতিক রীতি অনুযায়ী উভয় পক্ষই তাদের এই দাবিগুলো চাপিয়ে দিতে চায় ‘জনগণ চায়’ বলে।
এখন পর্যন্ত রাজনীতির মাঠের গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর সব কটিই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করছে। সংস্কার নিয়ে বিতর্ক মূলত শুরু হয়েছে এর পরিমাণ এবং কার্যকর করার সময় নিয়ে। ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচন এবং এরপর নির্বাচিত সরকারের অধীন আরও কিছু সংস্কার করার কথা বলছে বিএনপি। তারা মনে করে, বড় সংস্কার করার ম্যান্ডেট জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারেরই থাকে। ওদিকে অনেক সংস্কার এবং সেটা আগামী নির্বাচনের আগেই হতে হবে—এমন একটা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে এনসিপি। শুধু তা–ই নয়, একটা নতুন সংবিধান রচনার জন্য ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের আদলে একই সঙ্গে যেন গণপরিষদ ও সংসদ নির্বাচন হয়, সেটাও তাদের দাবি। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে এনসিপির দাবির প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন দেখা গেছে। নির্বাচনের আগেই সংস্কার চাওয়ার প্রধান যুক্তি হচ্ছে বিএনপি যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে তারা প্রত্যাশিত সংস্কারগুলো করবে না। কেউ কেউ স্মরণ করাচ্ছেন এরশাদ পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিজ্ঞতাকে।
সংস্কার কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ দিয়েছে, সেগুলোকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের কিছু সংস্কার (সংবিধান সংস্কার কমিশনের পুরোটাই) করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তাই সেটা এই সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অনেকগুলো সংস্কার আছে, যেগুলো আইন, বিধিবিধান সংশোধন এবং প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। সেগুলো এই সরকার অনায়াসেই করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার যে শেষ পর্যন্ত কার্যকর থাকে না, তার প্রমাণ হলো এক-এগারোর সময় জারি হওয়া অধ্যাদেশগুলোর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ (এর মধ্যে অনেকগুলোয় আবার সংশোধনীসহ) আইনে পরিণত করেছিল পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ। বোধ করি, এই অভিজ্ঞতার স্মরণেই সংস্কার প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা বরাবরই বলেছেন, প্রধান প্রধান অংশীজনের মতৈক্য ছাড়া কোনো সংস্কার তিনি করবেন না।
আমাদের অনেকেই ইদানীং মনে করেন, শুধু একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। তাই আগামী নির্বাচনের আগেই সংবিধান, আইন—সবকিছুর সংস্কার করে গণতন্ত্র রক্ষার একটা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করে আমাদের নির্বাচনে যেতে হবে। এই যে গণতন্ত্রের জন্মভূমি ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে উগ্র ডানপন্থী ও ফ্যাসিস্ট দল বা ব্যক্তি ক্ষমতায় যাচ্ছে অথবা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে কিংবা ২০০৬ সালের পর থেকে পৃথিবীতে কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা আজ পর্যন্ত প্রতিবছর কমেছে, সেটা কি তাহলে তাদের সংবিধান ও আইনে সমস্যা ছিল বলে? সেসব দেশে তো তাহলে সংবিধান ও আইন সংস্কার নিয়ে ক্রমাগত আলাপ হওয়ার কথা; করছে কী তারা? নাকি আলাপ চলছে রাজনৈতিকভাবে সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেটা নিয়ে? একটু খোঁজ নিলেই উত্তর পেয়ে যাবেন যে কেউ।
সংস্কার নিয়ে বিদ্যমান সংঘাতময় অবস্থায় একটা সমাধান হতে পারে এমন—যাঁরা মনে করছেন গণ-অভ্যুত্থানে জনগণ নেমে এসেছিল শেখ হাসিনার পতন ও ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসা ঠেকানোর লক্ষ্যে সংস্কার করার জন্য, তারা সংস্কারকেই নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান বিষয় করে তুলুক। কোন কোন সংস্কার হলে জনগণের কোন কোন উপকার হবে, সেটা জনগণের সামনে নিয়ে যাক তারা। কারা, কোনো সংস্কার না করে কীভাবে জনগণের ক্ষতি করছে, তাদেরও রাজনীতির মাঠে আক্রমণ করুক। এভাবে তাঁরা যদি ম্যান্ডেট পেয়ে সরকার গঠন করেন, তাহলে তাঁরা তাঁদের কাম্য সংস্কার করে ফেলতে পারবেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, জনগণ যেহেতু সংস্কার চায়, তাই নির্বাচনে তাঁদের জিতে যাওয়ার কথা। আর যদি সেটা না–ও পারেন, ক্ষমতায় যদি কম সংস্কার করতে চাওয়া বিএনপি যায়, তারা বিরোধী দলে থেকে ক্রমাগত সংস্কার নিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে যাবে। জনগণের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ চাহিদা তৈরি করা গেলে বিএনপিকেই অনেক সংস্কার মেনে নিতে হবে, যেগুলো তারা শুরুতে মানতে চায়নি। আর যদি বিএনপি সেটা না মানে, পরবর্তী নির্বাচনে তাদের পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এভাবেই কাজ করে।
কেউ কেউ বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এসে যদি আবার শেখ হাসিনার মতো নির্বাচনী কারসাজির মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়, সেই লক্ষ্যে সব কটি বিষয়ে সংস্কার করা জরুরি। একটা সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় সে সঠিকভাবে নির্বাচন করবে না, তাহলে কোনো আইন বা সংবিধান সেটা ঠেকাতে পারে না। এর উদাহরণ পৃথিবীর নানা স্থানে, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশেই আছে।
কবীর সুমনের ‘হেলিকপ্টার’ গানটির শেষ অংশটা এ রকম, ‘ভোট দিয়েছি, ভোট দিয়েছিস, ভোট দিয়েছ, ভোট দিয়েছেন, ভোট.
আগেই যেমনটা বলেছিলাম, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় পোক্ত ভালো সংবিধান-আইন, গণতান্ত্রিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান থাকার পরও গণতন্ত্রের পশ্চাৎ–যাত্রা চলছে এবং এই যাত্রার গতি অনেক ক্ষেত্রে বাড়ছেও। সেসব দেশের মানুষদের সামনে আবারও গণতন্ত্রকে রক্ষা করার লড়াই এসে হাজির হয়েছে। অর্থাৎ এই লড়াই চিরন্তন। আপাতত রাজনৈতিক দলগুলো যত বেশি সংস্কারে একমত হয়ে তা কার্যকর করবে, সেটা ভালো। কিন্তু কোনো দলই কিংবা নাগরিকেরা যেন এই আত্মতুষ্টিতে না ভোগেন যে একবার চমৎকারভাবে সবকিছু সংবিধান ও আইনে লিখে ফেললে নিশ্ছিদ্র, নির্ভেজাল, ঝুঁকিহীন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমরা পেয়ে যাব।
জাহেদ উর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ খ হ স ন র পতন ন ত র ক ব যবস থ গণত ন ত র ক গণতন ত র র স স ক র কর জনগণ র ক ক র যকর ক ষমত য র কর র র জন য র র জন আম দ র র স মন ও আইন ব এনপ র একট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়
নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই কিছু পরিচিত দৃশ্য আবার চোখে পড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ অবস্থানকে একমাত্র ন্যায়সংগত দাবি হিসেবে তুলে ধরা, ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থতা এবং একে অপরের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা। রাজনৈতিক অচলাবস্থা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধুই অচলাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এটি বরং রাজনৈতিক চিন্তার দেউলিয়াত্বের প্রকাশ এবং রাজনীতি জনগণের চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার একটি সংকেত। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি প্রশ্ন, যা আমরা এখনো করিনি: রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ আসলে কী?
২.
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের জাতীয়তাবাদের অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে—কখনো ‘বাংলাদেশি’ বনাম ‘বাঙালি’, কখনো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বনাম ‘ইসলামপন্থা’ পরিচয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই শব্দগুলো বাস্তবে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে; একদিকে জাতিসত্তার বৈচিত্র্যকে একরৈখিক করে তুলেছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘু এবং নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।
এই জাতিগত ও আদর্শগত পরিচয়ের সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও। রাজনৈতিক দলগুলো জনসেবার বাহন না হয়ে পরিণত হয়েছে আত্মরক্ষামূলক ক্ষমতার বাহনে। পুরোনো দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, গরিবের পক্ষে কথা বলার দাবি করা বিভিন্ন বামপন্থী দল, এমনকি নাগরিকদের সক্রিয়তা নিয়ে কথা বলা নতুন দল এনসিপিও একই ছকে চলছে; প্রকাশ্যে জনগণের নামে বৈধতা চাওয়া আর ভেতরে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে দল চালানো।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল আনুগত্যের বিনিময়ে সুযোগের এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। দলগুলো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে, পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ করে এবং অনুগত একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখে। স্থানীয় সরকার, যেখানে গণতন্ত্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকার কথা, তা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্রের স্বল্প ইতিহাস বলে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা প্রায়ই জনগণের পক্ষে কথা বলা প্রতিনিধি নন, বরং তারা মধ্যস্থতাকারী মাত্র। এই ব্যবস্থায় নেতৃত্ব নয়, আনুগত্যই পুরস্কৃত হয়।
৩.
প্রায় সব রাজনৈতিক দলই অভ্যন্তরীণ দলীয় কার্যক্রমের দিক থেকে গণতান্ত্রিক নয়। নেতৃত্ব প্রায়ই বংশগত বা দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়াভাবে ধরে রাখা হয়। দলের মধ্যে ভিন্নমত দিলে শাস্তি হয়। কর্মীরা মিছিল-মিটিং বা গ্রেপ্তারে সামনে থাকলেও, নীতিনির্ধারণে তাঁদের কোনো অংশ থাকে না। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের এই অভাব বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। দলগুলো এখন প্রায় শূন্য খোলসে পরিণত হয়েছে।
সংসদেও এর প্রতিফলন স্পষ্ট। অনেক সংসদ সদস্যই তাঁদের নির্বাচিত এলাকার বাসিন্দা নন। তাঁরা সেসব এলাকায় বড় হননি, সেখানকার মানুষের সঙ্গে বসবাসও করেন না—সম্পর্ক থাকে কেবল প্রতীকী; বরং প্রাক্তন মন্ত্রী, নেতা কিংবা দলের উচ্চপদস্থ সদস্যদের সন্তান-স্বজনদেরই একপ্রকার উত্তরাধিকারসূত্রে সেখানে পাঠানো হয়। স্থানীয় নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রায়ই একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। রাজনীতির প্রতিটি স্তরে—থানা ইউনিট থেকে জাতীয় মনোনয়ন পর্যন্ত—ক্ষমতার প্রবেশাধিকার নির্ধারিত হয় বংশানুক্রম, আনুগত্য এবং আঞ্চলিকতার এক অঘোষিত নিয়মে; যেখানে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা একটি নির্দিষ্ট পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্পত্তির মতো গণ্য হয়।
নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয়বহুল এবং মনোনয়ন একটি লেনদেনভিত্তিক প্রক্রিয়া—সম্পদ, সম্পর্ক এবং আনুগত্যই এখানে মুখ্য। নির্বাচন মানে পোস্টার, মাইকিং আর আগেভাগে অর্থ ব্যয় করে মিছিল-মিটিংয়ের মৌসুম। সাধারণ নাগরিকের জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব—যতক্ষণ না তিনি একই স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও সুবিধাবাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করেন। এমনকি যাঁরা সাম্প্রতিক সময়ে বিপ্লবী ভাষায় কথা বলছিলেন, তাঁরাও দ্রুত এই একই ছকে ঢুকে পড়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলো যখন তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন অন্যরা সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসে। সুশীল সমাজ নিজেদের গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষক মনে করতে শুরু করে। আমলারা ও বিচারপতিরা নিজেদের সাংবিধানিক সীমার বাইরে গিয়ে হস্তক্ষেপ করেন। সেনাবাহিনী নিজেদের একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু এটি গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক বিকৃতি ও শাসনক্ষমতার দায়িত্বহীন পুনর্দখল।
৪.
এমন পরিস্থিতিতে মানুষের প্রকৃত চাহিদাগুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়। ত্রাণ বিতরণ হয় দলের পতাকা লাগিয়ে, ছবি তোলা হয় এবং বিনিময়ে ভোট চাওয়া হয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ভোটার, যাঁদের বেশির ভাগই গ্রামীণ ও দরিদ্র, তাঁদের দয়া নয়, অধিকার প্রয়োজন। তাঁরা একটি বৈষম্যমূলক ও বিকৃত ব্যবস্থার শিকার—যেখানে সুবিধা, সম্পদ ও সুযোগ বণ্টিত হয় ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছেমতো। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই এমন কোনো কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলে না, যা এই বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কারণ, এমন সংস্কার বাস্তবায়ন করলে যে ব্যবস্থা থেকে তাঁরা লাভবান হচ্ছেন, সেটাই বদলে দিতে হবে।
কেউ ভূমি সংস্কার, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কিংবা পুলিশের নিয়োগপদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে চায় না। যেখানে সংস্কার থেমে যায়, সেখানে ক্ষমতা শুরু হয়। কাঠামোগত সংস্কার কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা কৌশল নয়। স্পষ্ট করে বললে, এ ধরনের পরিবর্তন নির্বাচনের আগে সমীচীন নয় আর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এর বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। এমন সংস্কার সফল হতে হলে একটি এমন সরকার প্রয়োজন, যারা সংবিধানকে শুধু ভাষণে নয়, বরং বাজেট, প্রাতিষ্ঠানিক নকশা এবং নীতিনির্ধারণে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।
বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত আদর্শগত মতপার্থক্য নয়—এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই। অতীতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত প্রভাবশালীদের রক্ষা করতে এবং ভিন্নমত দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি নাগরিক সমাজের আন্দোলনগুলোকেও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বা অভিজাত গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। জনতার আন্দোলন প্রচার পায়; কিন্তু পরে তা দমন করা হয় অথবা নিস্তেজ হয়ে যায়। এনজিওগুলোর গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে আশার কথা শোনা যায়, কিন্তু সেখান থেকে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলায় না।
৫.
এ রকম প্রেক্ষাপটে অনেকেই শুদু সংবিধানকেই দোষারোপ করছে, যেন এর দায় শুধু কাগজের শব্দগুলোর, যারা বছরের পর বছর সংবিধান উপেক্ষা করেছে, তাদের নয়। বাংলাদেশের সংবিধান ছিল একটি প্রতিশ্রুতি—কেবল সার্বভৌমত্বের নয়, বরং ন্যায়বিচারের। এই সংবিধান রাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সমতা, বৈষম্যহীনতা, মর্যাদা, ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের। এটি এমন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতিসত্তার ছবি এঁকেছিল, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, বরং প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মর্যাদা স্বীকৃত।
সংবিধানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরিণতি বাস্তব এবং গভীর। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, পুলিশি নির্যাতন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি—এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো একটি কাঠামোগত চিত্রের অংশ, যা বারবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এই চক্রে কোনো একক দল বা সরকার সম্পূর্ণভাবে দায়ী নয়। ঠিক এই কারণেই প্রয়োজন একটি সামগ্রিক জবাবদিহি, কেবল একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি।
যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি না থাকে, আর যদি নির্বাচন কেবল ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তবে এটি শুধু শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়—এটি একটি প্রজন্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ১৯৯১ সালের পর যারা বড় হয়েছে, তাদেরকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা পেয়েছে ক্ষমতাবানদের মধ্যে বোঝাপড়া, যেখানে জনতার কণ্ঠ নেই; বিপ্লবের বুলি আছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন নেই।
এর ফলে আবারও সেই প্রশ্ন ফিরে আসে—রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ আসলে কী? তারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? তাদের কাজ কি শাসন, দখল নাকি জনগণের সেবা? যদি রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সেবা না করে, তাহলে সেটা করবে কে?
ড. সিনথিয়া ফরিদ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, শিক্ষক ও গবেষক