অর্থ ফেরত ও গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান ঢাকার
Published: 17th, April 2025 GMT
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে সাধারণ ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা। অবিভাজিত সম্পদ ফেরত দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছর পর বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়। এর পর সন্ধ্যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান।
বৈঠকে উত্থাপিত দু’দেশের অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে পাকিস্তান। আর ঢাকা জানিয়েছে, এসব বিষয় সমাধান করার এখনই উপযুক্ত সময়।
ঢাকা সফররত পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে উভয় দেশের প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এ বৈঠকে বসে। শেষ হয় দুপুর ১টার পর। এর পর বিকেলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে সাক্ষাৎ করেন আমনা বালুচ। একই দিন তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
গণহত্যার জন্য ক্ষমা
প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, বৈঠকে একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তুলেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার ফেরত চেয়েছে বাংলাদেশ, তবে এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর আটকে পড়া তিন লাখ ২৫ হাজার পাকিস্তানিকে ফেরত নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে ঢাকা।
তিনি আরও বলেন, দু’দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে একটি মজবুত, কল্যাণমুখী ও ভবিষ্যৎমুখী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পাকিস্তানের সহযোগিতা প্রয়োজন। এ জন্য একযোগে কাজ করতে হবে।
পাকিস্তানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে জসীম উদ্দিন বলেন, এমন বৈঠক নিয়মিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেড় দশক পর হলো। তাই এক বৈঠকেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করছি না। তবে পাকিস্তান আলোচনায় সদিচ্ছা দেখিয়েছে।
শিল্প-বাণিজ্য-কৃষি
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ঢাকা-ইসলামাবাদ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর জোর দিচ্ছে। পাকিস্তানের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি, বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজ, শুল্ক বাধা দূর এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জসীম উদ্দিন বলেন, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বন্যা প্রতিরোধে দু’দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ওপর জোর দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড.
পরিবহন
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সম্প্রতি দু’দেশের মধ্যে সরাসরি নৌ যোগাযোগ (শিপিং রুট) চালু হয়েছে। পুনরায় সরাসরি ফ্লাইট চালু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগগির বিমান যোগাযোগ চালু করা সম্ভব হবে।
গাজা ইস্যু
বৈঠকে পূর্ব এশিয়ার দুই দেশ মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছে। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর গণহত্যা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে তারা। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সমর্থনও চেয়েছে বাংলাদেশ।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি
বৈঠকে উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন সুযোগ সন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে দুই দেশ। জসীম উদ্দিন জানান, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। দুই দেশের শিল্পী, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, লেখক ও শিক্ষাবিদদের সফরের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উভয় পক্ষ থেকেই উৎসাহিত করা হয়েছে।
সম্পর্ক জোরদারের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস পাকিস্তানের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা অনুসন্ধানে জোর দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার আমনা বালুচ সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা জানান।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দু’দেশের মধ্যে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমাদের সেগুলো অতিক্রমের উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এ সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আশা প্রকাশ করেন, এপ্রিলের শেষে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি সবসময় পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পক্ষে। বিশেষ করে সার্ক কাঠামোর মধ্যে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সার্ক, ওআইসি এবং ডি-৮ এর মতো বহুপক্ষীয় ও আঞ্চলিক ফোরামে একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে।
এ সময় এসডিজি-বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ, ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকায় এসে খুশি বালুচ
পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর বালুচ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক করেন। এর পর তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঢাকায় এসে আমি খুশি। আলোচনা খুব চমৎকার হয়েছে। বাংলাদেশের খাবার, এখানে কেনাকাটা কেমন হয়েছে– জানতে চাইলে বলেন, ‘খুব ভালো হয়েছে’।
ইসহাক দার ঢাকায় আসছেন ২৭ এপ্রিল
ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরসূচিও চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি ২৭ ও ২৮ এপ্রিল ঢাকা সফর করবেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সহয গ ত ইউন স র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।
সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।
পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।
বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।
এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)