পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিতে বোরো ধানের আবাদ
Published: 24th, April 2025 GMT
এ বছর প্রায় ৫০ দশমিক ৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। এই তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। ২০০৫ সালে বোরো ধান আবাদের আওতায় জমি ছিল ৪০ দশমিক ৬৪ লাখ হেক্টর। ২০১০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ৭৮ লাখ হেক্টর, ২০২০ সালে ৪৮ দশমিক ১৫ লাখ হেক্টর, ২০২৩ সালে ৪৮ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর।
বাংলাদেশে পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি ও দুর্বল ‘ডেটা ইনটিগ্রিটি’ প্রবল। তাই বোরো ধান আবাদের আওতায় জমির পরিমাণ ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধির এই তথ্য নিয়ে সন্দেহ করার কারণ আছে। অস্থির চালের বাজারের অস্থির সময়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বিবিএস, ডিএইয়ের মধ্যে তথ্যবিতর্ক পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে বোরো ধান আবাদের আওতায় জমির পরিমাণকে তথ্য-উপাত্ত ও বাস্তবতার নিরিখে চ্যালেঞ্জ করে এই লেখা।
২০০৫ সালে বাংলাদেশে আবাদি জমি ছিল ৮১ লাখ হেক্টর। ২০২৫ সালে এসে এই পরিমাণ জমি নিশ্চয় নেই। বছরে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ হারে (কোনো কোনো গবেষকের মতে ১ শতাংশ) আবাদি জমি কমলেও গত ২০ বছরে কমেছে ১২ শতাংশ। সেই হিসাবে বর্তমানের নিট ফসলি জমি হওয়ার কথা প্রায় ৭১ লাখ হেক্টর। বোরো ধানের আওতায় ৫০ লাখ হেক্টর বাদ দিলে অন্যান্য ফসলের আওতায় জমি অবশিষ্ট থাকে মাত্র ২১ লাখ হেক্টর। ওভারলেপিং ক্রপ যেমন শর্ষে ও আলু বিবেচনায় নিলেও বাকি ২১ লাখ হেক্টর জমিতে অনেকগুলো ফসলের হিসাব মেলানো কঠিন হচ্ছে।
ভেতো বাঙালির ভাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেচনির্ভর উচ্চফলনশীল বোরো ধান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বোরো ধান এখন দেশের প্রধান ধানের মৌসুম। বোরো মৌসুমে মোট জাতীয় উৎপাদনের ৬০ শতাংশ উৎপাদিত হয়। যদিও ব্যাপকভিত্তিতে বোরো ধানের আবাদ বেশি দিনের নয়। সেচপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের আগের জামানায় ধানের প্রধান মৌসুম ছিল আমন ও আউস। উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ফলে আউস ধানের আবাদ কমতে থাকে এবং অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে সেচনির্ভর বোরো ধানের। কিন্তু যৌক্তিক কারণেই বোরো ধানের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ার সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। ২০১০ সালের পর থেকে বোরো ধানের আবাদ বৃদ্ধির তথ্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।
বোরো মৌসুমে মাঠভরা বোরো ধান দেখা গেলেও জলবায়ু পরিবর্তন, সেচের পানির সংকট ও আন্তফসল প্রতিযোগিতার ফলে আস্তে আস্তে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বোরো চাষ। এ ছাড়া তুলনামূলক লাভ–ক্ষতির হিসাব ও বিকল্প ফসলের সম্ভাবনা বিবেচনা করে কৃষক অতিরিক্ত সেচনির্ভর বোরো ধান চাষ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাওয়ার তথ্য গবেষণা প্রবন্ধ ও গণমাধ্যামে আছে। তাই বোরো ধানের আবাদ অব্যাহতভাবে বাড়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে রবি মৌসুমে বাংলাদেশে ফসলের বৈচিত্র্য বেড়েই চলেছে। কৃষক নানা রকম উচ্চমূল্য ফসলের দিকে ঝুঁকবে, এটাই স্বাভাবিক। ধান চাষ করে অব্যাহত লোকসানের কবলে পড়ে কৃষকেরা শুধুই বিকল্প আবাদ খুঁজছে। বোরো ধানের ফলন বেশি হলেও উৎপাদন খরচ সবচেয়ে বেশি। প্রতি হেক্টর জমিতে সেচ বাবদ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। হেক্টরপ্রতি নিট মুনাফা শীতকালীন অন্যান্য ফসলের চেয়ে অনেক কম। কৃষক বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকবে, এটাই স্বাভাবিক। মনে হতে পারে, বোরো ধানের আওতায় জমির হিসাব একটু গরমিল হলে কৃষি অর্থনীতির, খাদ্যনিরাপত্তার কী এমন ক্ষতি হবে। না, বৈশ্বিক ‘রাইস ইকোনমিতে’ বাংলাদেশের সঠিক তথ্যটাও খুব প্রয়োজন বৈশ্বিক বাজার পরিকল্পনায়।
বাংলাদেশ ‘গ্লোবাল রাইস ইকোনমি’র প্রধান অভিনেতা, পার্শ্ব অভিনেতা বা খলনায়ক নয়। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী ও চালের ভোক্তাদেশ। উৎপাদন তথ্যের গরমিল আন্তর্জাতিক বাজারে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে বাংলাদেশ হঠাৎ ২৬ লাখ টন চাল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করেছিল, যেটা বৈশ্বিক আমদানি–রপ্তানি পরিকল্পনায় ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক চালের বাজারে বাংলাদেশের পরিচিতি আমদানিকারক হিসেবে নয়।
ভুট্টার ব্যাপক আবাদ বোরো ধানের আওতায় জমির পরিমাণকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এ বছর শীতকালীন ভুট্টার আবাদ হয়েছে ৫ দশমিক ২৮ লাখ হেক্টর, যেটা ২০০৫ সালের তুলনায় প্রায় ৪ লাখ হেক্টর বেশি। সাধারণত গম ও বোরো ধানের জমি প্রতিস্থাপিত হয়েছে ভুট্টা দিয়ে। গমের আওতায় জমি কমেছে প্রায় ১ লাখ হেক্টর। কাজেই যৌক্তিক কারণে অন্তত ৩ লাখ হেক্টর বোরো ধানের জমি চলে গেছে ভুট্টা আবাদে।
সারা দেশে গত ২৫ বছর স্থায়ী ফলবাগান (আম, লিচু, পেয়ারা, ড্রাগন ফল, কুল) বেড়েছে। শীতকালীন ডাল ফসলের আবাদ বেড়েছে। শীতকালীন সবজির আবাদ বেড়েছে। মসলা ফসলের আবাদ বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাণিজ্যিকভিত্তিকে ফুলের আবাদও বেড়েছে। এসব শস্য বহুমুখীকরণের প্রভাব অবধারিতভাবে পড়ার কথা বোরো আবাদে। তাহলে রবি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ অব্যাহতভাবে বড়ার গাণিতিক যুক্তিটা কী?
সম্প্রতি ফসলি জমিতে পশুখাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব ও প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশে অন্তত ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক লাখ হেক্টর জমিতে পশুখাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে। গরুর মাংসের বাজারমূল্য ভালো হওয়ায় দেশে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি গরু মোটাতাজাকরণ করা হচ্ছে। সবুজ ঘাসের অব্যাহত জোগান দিতে গিয়ে ফসলি জমিতে ঘাসের চাষ বাড়ছে। এর ফলে বোরো ধানের আওতায় জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তিন ফসলি জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোনো আইন নেই। তাই প্রতিবছর নতুন পুকুর করতে ধানের জমি হারিয়ে যাচ্ছে। ধান চাষের চেয়ে মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় এবং ঝুঁকি কম হওয়ায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ধানের জমি। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম অভিঘাত নদীভাঙন। পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা অববাহিকায় প্রতিবছর ৮-১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি বিলীন হয়। নতুন চর জেগে উঠলেও সেখানে মাটির গুণাগুণ অনুযায়ী কিছু ফসল (শর্ষে, গম, ভুট্টা, সবজি) হলেও বোরো ধানের আবাদ কমই হয়।
জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন ফসলের আওতায় আবাদি জমির পরিমাণ জরিপ নিয়ে কাজ করেছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, স্পারসো, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। ফ্রি ভার্সনের যে স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করা হয়, সেটাতে ত্রুটিমুক্ত ফলাফল পাওয়া যায় না। কিছু গবেষক তাঁদের গবেষণাপত্রে ধান চাষের আওতায় জমির পরিমাণ নির্ণয় করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিছু টেকনিক্যাল সীমাবদ্ধতা আছে। রবি মৌসুমে শস্যবৈচিত্র্য এত বেশি যে স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করা যায় না। খণ্ড খণ্ড জমিতে কোনোটাতে বোরো ধান, কোনোটাতে রসুন, গম, যব অথবা ভুট্টা। কাজেই জরিপের ক্ষেত্রে ম্যানুয়াল সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কৃষি বিভাগ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাঠকর্মীরা নিয়মিত ফসল আবাদের তথ্য দেন, কিন্তু সেখানেই বড় ত্রুটি রয়ে যায়।
গবেষণা প্রবন্ধ ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখ যায়, বাংলাদেশে ছয়টি জলবায়ু হটস্পটে বোরো ধানের আবাদ বিঘ্নিত হচ্ছে। হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের আবাদ বিঘ্নিত হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চল বোরো চাষের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। লবণাক্ততার অব্যাহত বৃদ্ধি ও স্বাদুপানির সংকটে এখানে বোরোর আবাদ সংকটের মুখে। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটে বোরো চাষ বিঘ্নিত হওয়ার খবর। খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চল পানিসাশ্রয়ী বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকছে। এত গবেষণা, পরিসংখ্যান, যুক্তি ও বাস্তবতার পরও বোরো ধান আবাদের আওতায় জমি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
উন্নয়নের অতিরঞ্জিত বয়ান শুনে আত্মতৃপ্ত হওয়ার এক সর্বনাশা নেশায় পেয়ে বসেছিল এই জাতিকে। জিআইএস, রিমোট সেন্সিং ও এআইয়ের যুগেও তথ্য-উপাত্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বাহাস সত্যিই হাস্যকর। সবকিছুতেই চ্যাম্পিয়ন হতে হবে, পদক পেতে হবে কেন? কেনই–বা বাম্পার ফলন আর রেকর্ড উৎপাদন সেলিব্রেশন করতে হবে প্রতিবছর? ট্রেড ও ট্যারিফ যুদ্ধের বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকতে হলে ডেটা ইনিটিগ্রিটি খুব দরকার। চাল উৎপাদনের ভুল তথ্য দিয়ে শক্তিশালী ‘রাইস পলিসি’ প্রণয়ন অত্যন্ত কঠিন হবে। ‘হালের গরু গোয়ালে না থাকলেও কেতাবে থাকতে হবে,’ এই দিন তো আর নেই। ইউএসডিএ অথবা এফএওর রিপোর্টের সঙ্গে আমাদের রিপোর্ট মিলে না। বাম্পার উৎপাদনও হবে আবার বিশ্ববাজারে আমদানির ঝুলি নিয়ে যেতে হবে—এ কেমন কথা?
ভবিষ্যতে ‘রাইস সিকিউরিটি’ পরিকল্পনা প্রণয়নের ধান চাষের আওতায় জমির সঠিক পরিমাণ জানা খুব জরুরি। ধানের পাশাপাশি পেঁয়াজ, আলু, তৈল–জাতীয় ফসল, ভুট্টা, পশুখাদ্য ফসল সত্যিকারের কত হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান থাকা অত্যাবশ্যক। কাজেই ম্যানুয়াল পদ্ধতি, জিআইএস, ক্রপিং সিস্টেম বিশ্লেষণ ও ভূমি ব্যবহারের ধারা বিবেচনায় নিয়ে ধান চাষের আওতায় জমির সঠিক পরিসংখ্যান উপস্থাপনের সময় এখনই।
ড.
মো. রওশন জামাল কৃষিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স খ য ন ব যবহ র ব কল প দশম ক উৎপ দ আমদ ন য ফসল ফসল র
এছাড়াও পড়ুন:
মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের
এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।
চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।
টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর।
গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।
দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত।
শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।
মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।
সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।