জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর জনমানসে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা ছিল খুবই স্পষ্ট: ‘জুলাই সনদ’ এমন এক সংস্কারের রূপরেখা দেবে, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অধীন নির্বাহী বিভাগের হাতে কেন্দ্রীভূত প্রায় সীমাহীন ক্ষমতা কমিয়ে আনবে, কার্যকর ক্ষমতার ভারসাম্য গড়ে তুলবে এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশে চিরতরে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটাবে।

গত ১৭ অক্টোবর সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ২০টির বেশি রাজনৈতিক দল এই সনদে স্বাক্ষর করেছে। অনুষ্ঠানটি ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর অঙ্গীকার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে রয়ে গেছে একটি গুরুতর অস্পষ্টতা, যা স্পষ্ট না হলে পুরো সনদই শেষ পর্যন্ত কাগুজে ঢাল হয়ে থাকতে পারে।

অস্পষ্টতাটি কী? সংবিধান কি এখনো একতরফাভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব থাকবে? যদি সেই দরজা খোলা থাকে, তবে ভবিষ্যতে কোনো একটি দল আবারও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোট ছাড়াই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জোগাড় করতে পারবে, যা দিয়ে সনদের বাকি সবকিছুই বাতিল করে দেওয়া সম্ভব হবে। সেই অবস্থায় ‘জুলাই সনদ’ কেবল লোকদেখানোর ব্যাপার হয়ে যাবে—রাষ্ট্রকে সত্যিকারের সুরক্ষা দেবে না।

এই ঝুঁকির মূল উৎস বিএনপির দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’, বিশেষ করে উচ্চকক্ষ গঠন ও সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের ভূমিকা নিয়ে তাদের আপত্তি। কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

বর্তমান সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট পেলেই সরকার একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। কিন্তু আমাদের ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংসদীয় আসনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব, এমনকি মোট ভোটের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও না পেয়ে। উদাহরণ হিসেবে, ২০০১ সালের নির্বাচন দেখা যেতে পারে। বিএনপির চারদলীয় জোট সেই নির্বাচনে মোট ভোটের প্রায় ৪৬ শতাংশ পেয়েছিল, কিন্তু ৩০০ আসনের মধ্যে ২১৬টি আসন জিতেছিল-অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি। একই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট, কিন্তু তাদের আসন ছিল মাত্র ৬২টি। আবার ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৩০টি আসন জিতেছিল, মোট আসনের প্রায় ৭৭ শতাংশ।

অর্থাৎ ভোট ও আসনের এই চরম ভারসাম্যহীনতা শুধু সাংবিধানিকভাবে বৈধ একতরফা ক্ষমতা সৃষ্টি করে না; বরং সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে সংবিধানকেও নিজের মতো করে বদলে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে।

১৯৯০-এর পর থেকে বড় বড় রাজনৈতিক অচলাবস্থার পেছনে এই কাঠামোগত অসাম্যই মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যখন কোনো দল আসনে ভূমিধস জয়লাভ করে, তখন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে সংবিধান বদলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছে।

সবচেয়ে বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হচ্ছে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী। আওয়ামী লীগ সরকার তখন একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর ফলাফল আমরা সবাই দেখেছি: দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট, পরপর তিনটি অবাঞ্ছিত ও কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতার চূড়ান্ত একচ্ছত্রীকরণ ও একটি দীর্ঘ সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।

তবে এটাও সত্য যে দলীয় স্বার্থে সংবিধান বদলের পথ আওয়ামী লীগ প্রথম দেখায়নি। দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়ার পর বিএনপি ও তাদের মিত্ররাও নিজেদের সুবিধামতো সংবিধান সংশোধন করেছে। তাদের আনা চতুর্দশ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ায়, যাতে আসন্ন নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁরা নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে বসাতে পারে।

এই হস্তক্ষেপ পরবর্তী সময় বড় রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয়, আওয়ামী লীগের ‘লাঠি-বইঠা আন্দোলন’ নামে পরিচিত সহিংস ন্যক্কারজনক সংঘাত তৈরি করে এবং শেষ পর্যন্ত তথাকথিত এক–এগারো সরকারের জন্ম হয়।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন০২ নভেম্বর ২০২৫

ক্ষমতা ধরে রাখতে চাওয়ার এই তীব্র মানসিকতার বিরুদ্ধেই সাংবিধানিক সংস্কার কমিশনের মূল প্রস্তাব: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ। এই প্রস্তাব অনুযায়ী একটি উচ্চকক্ষ থাকবে, যা গঠিত হবে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো, যেকোনো সাংবিধানিক সংশোধনের জন্য কেবল নিম্নকক্ষ নয়, উচ্চকক্ষেরও সম্মতি লাগবে।

প্রাথমিক প্রস্তাবে শর্ত ছিল উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। কেন এটি জরুরি? কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, কোনো একক দল বা জোটের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ‘ভোট’ পাওয়া বাস্তবে খুবই কঠিন। এই বাধা কার্যত একতরফা সাংবিধানিক সংশোধন অসম্ভব করে দেয়। ফলে কোনো দল তাদের সুবিধামতো ‘রুলস অব দ্য গেম’, অর্থাৎ খেলার নিয়ম, এককভাবে পাল্টাতে পারবে না।

গণতন্ত্রে নীতি, আদর্শ, কৌশল—এসব বিষয়ে মতবিরোধ থাকবে। কিন্তু টিকে থাকতে হলে গণতন্ত্রকে অন্তত একটা জিনিসে স্থির থাকতে হয়: রাজনৈতিক খেলাটির মূল নিয়মগুলো (সংবিধানের কাঠামো ও ক্ষমতার ভারসাম্য) একতরফাভাবে বদলে দেওয়া যাবে না। আপনি কি কখনো এমন ক্রিকেট খেলা খেলতে রাজি হবেন, যেখানে প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়ক মাঝখানে দাঁড়িয়েই নিজের ব্যাটিং সহজ করতে উইকেটের মাপ বদলে দেয়? এটা যদি নিয়ম হয়, তাহলে সেই ম্যাচকে আপনি আর ন্যায্য বলবেন না, আর সেই ম্যাচে অংশগ্রহণও করবেন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক খেলায় ঠিক এই অন্যায্য নিয়মটাই বহুবার প্রয়োগ করা হয়েছে।

যত দিন এই একতরফা সাংবিধানিক সংশোধনের সুযোগ খোলা থাকবে, তত দিন অন্য যেকোনো সংস্কারই আসলে নিরাপদ থাকবে না। সেসব সংস্কার আজ লিখে রাখা যাবে, কিন্তু কাল পরিবর্তন করে দেওয়া যাবে। সেই কাঠামোয় ‘জুলাই সনদ’ বড়জোর প্রতীক হবে, কিন্তু হবে না ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর ঢাল। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের নতুন সংঘাতের ঝুঁকি।

সমস্যা হলো, বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সরাসরি এই ন্যায্যতার নীতির বিপক্ষে অবস্থান করে। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর পক্ষে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর ৯৬ শতাংশের বেশি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি দুটি মূল বিষয়ের বিরোধিতা করেছে: (১) ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন এবং (২) সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা। পরে ঐকমত্য কমিশন, সমঝোতার পথ বের করতে, সাংবিধানিক সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের শর্ত শিথিল করে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার শর্তে নামিয়ে আনে। তারপরও বিএনপি তাদের অবস্থান পাল্টায়নি; বরং স্বাক্ষরের ঠিক আগেই তারা তাদের নোট অব ডিসেন্টে স্পষ্টভাষায় যোগ করে যে সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়।তারপরও সেই নোট অব ডিসেন্ট সংযুক্ত রেখেই ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এখানে বিপদের জায়গা পরিষ্কার। যদি বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসে, যা বাস্তবসম্ভব রাজনৈতিক সম্ভাবনা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে, তাহলে এই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে একতরফা সাংবিধানিক সংশোধনের পুরোনো পথ খোলা থাকবে।

আরও পড়ুনসংবিধান সংস্কারে জগাখিচুড়ির গণভোট৩০ অক্টোবর ২০২৫

কিছুটা স্বস্তির জায়গা আছে, কিন্তু সেটিও শর্তসাপেক্ষ। ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের যে ধাপপদ্ধতি পরবর্তী সময় দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সরাসরি গণভোটের প্রস্তাব—নোট অব ডিসেন্ট ছাড়া সনদটি জনগণের ভোটে অনুমোদনের ধারণা। যদি এমন একটি গণভোটে (অর্থাৎ উচ্চকক্ষের ভূমিকা ও সাংবিধানিক সংশোধনের সুরক্ষা-বিধানসহ) জুলাই সনদ পাস হয়ে যায়, তাহলে যেই-ই পরবর্তী সরকার গঠন করুক না কেন, এই সংস্কার বাস্তবায়ন না করা তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। অর্থাৎ গণভোটটি একধরনের নৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি করবে।

তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়: আমাদের কি এই ঝুঁকি নেওয়া উচিত?

একটি বড় জাতীয় দল হিসেবে বিএনপির উচিত জাতীয় স্বার্থে তাদের দেওয়া এই নোট অব ডিসেন্ট প্রত্যাহার করা। কারণ, বিকল্প দৃশ্যপটটা ভয়ংকরভাবে পরিচিত। আমরা আবার সেই পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাব, যেখানে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ব্যবস্থায় গঠিত নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে যেকোনো দল এককভাবে সংবিধান সংশোধন করতে পারে—ইতিহাস বলছে, মাত্র প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও এমন অবস্থান পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

যত দিন এই একতরফা সাংবিধানিক সংশোধনের সুযোগ খোলা থাকবে, তত দিন অন্য যেকোনো সংস্কারই আসলে নিরাপদ থাকবে না। সেসব সংস্কার আজ লিখে রাখা যাবে, কিন্তু কাল পরিবর্তন করে দেওয়া যাবে। সেই কাঠামোয় ‘জুলাই সনদ’ বড়জোর প্রতীক হবে, কিন্তু হবে না ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর ঢাল। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের নতুন সংঘাতের ঝুঁকি।

ইসলামুল হক যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক।

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ট অব ড স ন ট একতরফ ভ ব জ ল ই সনদ প রস ত ব র জন ত ক ব এনপ র ব যবস থ ক ষমত র অর থ ৎ সরক র আওয় ম গণভ ট অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

মৌলিক সংস্কারে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রাখলে জুলাই সনদ হবে মূল্যহীন

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর জনমানসে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা ছিল খুবই স্পষ্ট: ‘জুলাই সনদ’ এমন এক সংস্কারের রূপরেখা দেবে, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অধীন নির্বাহী বিভাগের হাতে কেন্দ্রীভূত প্রায় সীমাহীন ক্ষমতা কমিয়ে আনবে, কার্যকর ক্ষমতার ভারসাম্য গড়ে তুলবে এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশে চিরতরে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটাবে।

গত ১৭ অক্টোবর সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ২০টির বেশি রাজনৈতিক দল এই সনদে স্বাক্ষর করেছে। অনুষ্ঠানটি ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর অঙ্গীকার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে রয়ে গেছে একটি গুরুতর অস্পষ্টতা, যা স্পষ্ট না হলে পুরো সনদই শেষ পর্যন্ত কাগুজে ঢাল হয়ে থাকতে পারে।

অস্পষ্টতাটি কী? সংবিধান কি এখনো একতরফাভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব থাকবে? যদি সেই দরজা খোলা থাকে, তবে ভবিষ্যতে কোনো একটি দল আবারও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোট ছাড়াই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জোগাড় করতে পারবে, যা দিয়ে সনদের বাকি সবকিছুই বাতিল করে দেওয়া সম্ভব হবে। সেই অবস্থায় ‘জুলাই সনদ’ কেবল লোকদেখানোর ব্যাপার হয়ে যাবে—রাষ্ট্রকে সত্যিকারের সুরক্ষা দেবে না।

এই ঝুঁকির মূল উৎস বিএনপির দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’, বিশেষ করে উচ্চকক্ষ গঠন ও সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের ভূমিকা নিয়ে তাদের আপত্তি। কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

বর্তমান সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট পেলেই সরকার একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। কিন্তু আমাদের ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংসদীয় আসনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব, এমনকি মোট ভোটের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও না পেয়ে। উদাহরণ হিসেবে, ২০০১ সালের নির্বাচন দেখা যেতে পারে। বিএনপির চারদলীয় জোট সেই নির্বাচনে মোট ভোটের প্রায় ৪৬ শতাংশ পেয়েছিল, কিন্তু ৩০০ আসনের মধ্যে ২১৬টি আসন জিতেছিল-অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি। একই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট, কিন্তু তাদের আসন ছিল মাত্র ৬২টি। আবার ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৩০টি আসন জিতেছিল, মোট আসনের প্রায় ৭৭ শতাংশ।

অর্থাৎ ভোট ও আসনের এই চরম ভারসাম্যহীনতা শুধু সাংবিধানিকভাবে বৈধ একতরফা ক্ষমতা সৃষ্টি করে না; বরং সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে সংবিধানকেও নিজের মতো করে বদলে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে।

১৯৯০-এর পর থেকে বড় বড় রাজনৈতিক অচলাবস্থার পেছনে এই কাঠামোগত অসাম্যই মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যখন কোনো দল আসনে ভূমিধস জয়লাভ করে, তখন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে সংবিধান বদলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছে।

সবচেয়ে বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হচ্ছে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী। আওয়ামী লীগ সরকার তখন একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর ফলাফল আমরা সবাই দেখেছি: দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট, পরপর তিনটি অবাঞ্ছিত ও কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতার চূড়ান্ত একচ্ছত্রীকরণ ও একটি দীর্ঘ সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।

তবে এটাও সত্য যে দলীয় স্বার্থে সংবিধান বদলের পথ আওয়ামী লীগ প্রথম দেখায়নি। দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়ার পর বিএনপি ও তাদের মিত্ররাও নিজেদের সুবিধামতো সংবিধান সংশোধন করেছে। তাদের আনা চতুর্দশ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ায়, যাতে আসন্ন নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁরা নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে বসাতে পারে।

এই হস্তক্ষেপ পরবর্তী সময় বড় রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয়, আওয়ামী লীগের ‘লাঠি-বইঠা আন্দোলন’ নামে পরিচিত সহিংস ন্যক্কারজনক সংঘাত তৈরি করে এবং শেষ পর্যন্ত তথাকথিত এক–এগারো সরকারের জন্ম হয়।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন০২ নভেম্বর ২০২৫

ক্ষমতা ধরে রাখতে চাওয়ার এই তীব্র মানসিকতার বিরুদ্ধেই সাংবিধানিক সংস্কার কমিশনের মূল প্রস্তাব: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ। এই প্রস্তাব অনুযায়ী একটি উচ্চকক্ষ থাকবে, যা গঠিত হবে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো, যেকোনো সাংবিধানিক সংশোধনের জন্য কেবল নিম্নকক্ষ নয়, উচ্চকক্ষেরও সম্মতি লাগবে।

প্রাথমিক প্রস্তাবে শর্ত ছিল উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। কেন এটি জরুরি? কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, কোনো একক দল বা জোটের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ‘ভোট’ পাওয়া বাস্তবে খুবই কঠিন। এই বাধা কার্যত একতরফা সাংবিধানিক সংশোধন অসম্ভব করে দেয়। ফলে কোনো দল তাদের সুবিধামতো ‘রুলস অব দ্য গেম’, অর্থাৎ খেলার নিয়ম, এককভাবে পাল্টাতে পারবে না।

গণতন্ত্রে নীতি, আদর্শ, কৌশল—এসব বিষয়ে মতবিরোধ থাকবে। কিন্তু টিকে থাকতে হলে গণতন্ত্রকে অন্তত একটা জিনিসে স্থির থাকতে হয়: রাজনৈতিক খেলাটির মূল নিয়মগুলো (সংবিধানের কাঠামো ও ক্ষমতার ভারসাম্য) একতরফাভাবে বদলে দেওয়া যাবে না। আপনি কি কখনো এমন ক্রিকেট খেলা খেলতে রাজি হবেন, যেখানে প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়ক মাঝখানে দাঁড়িয়েই নিজের ব্যাটিং সহজ করতে উইকেটের মাপ বদলে দেয়? এটা যদি নিয়ম হয়, তাহলে সেই ম্যাচকে আপনি আর ন্যায্য বলবেন না, আর সেই ম্যাচে অংশগ্রহণও করবেন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক খেলায় ঠিক এই অন্যায্য নিয়মটাই বহুবার প্রয়োগ করা হয়েছে।

যত দিন এই একতরফা সাংবিধানিক সংশোধনের সুযোগ খোলা থাকবে, তত দিন অন্য যেকোনো সংস্কারই আসলে নিরাপদ থাকবে না। সেসব সংস্কার আজ লিখে রাখা যাবে, কিন্তু কাল পরিবর্তন করে দেওয়া যাবে। সেই কাঠামোয় ‘জুলাই সনদ’ বড়জোর প্রতীক হবে, কিন্তু হবে না ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর ঢাল। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের নতুন সংঘাতের ঝুঁকি।

সমস্যা হলো, বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সরাসরি এই ন্যায্যতার নীতির বিপক্ষে অবস্থান করে। প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর পক্ষে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর ৯৬ শতাংশের বেশি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি দুটি মূল বিষয়ের বিরোধিতা করেছে: (১) ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন এবং (২) সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা। পরে ঐকমত্য কমিশন, সমঝোতার পথ বের করতে, সাংবিধানিক সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের শর্ত শিথিল করে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার শর্তে নামিয়ে আনে। তারপরও বিএনপি তাদের অবস্থান পাল্টায়নি; বরং স্বাক্ষরের ঠিক আগেই তারা তাদের নোট অব ডিসেন্টে স্পষ্টভাষায় যোগ করে যে সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়।তারপরও সেই নোট অব ডিসেন্ট সংযুক্ত রেখেই ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এখানে বিপদের জায়গা পরিষ্কার। যদি বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসে, যা বাস্তবসম্ভব রাজনৈতিক সম্ভাবনা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে, তাহলে এই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে একতরফা সাংবিধানিক সংশোধনের পুরোনো পথ খোলা থাকবে।

আরও পড়ুনসংবিধান সংস্কারে জগাখিচুড়ির গণভোট৩০ অক্টোবর ২০২৫

কিছুটা স্বস্তির জায়গা আছে, কিন্তু সেটিও শর্তসাপেক্ষ। ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের যে ধাপপদ্ধতি পরবর্তী সময় দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সরাসরি গণভোটের প্রস্তাব—নোট অব ডিসেন্ট ছাড়া সনদটি জনগণের ভোটে অনুমোদনের ধারণা। যদি এমন একটি গণভোটে (অর্থাৎ উচ্চকক্ষের ভূমিকা ও সাংবিধানিক সংশোধনের সুরক্ষা-বিধানসহ) জুলাই সনদ পাস হয়ে যায়, তাহলে যেই-ই পরবর্তী সরকার গঠন করুক না কেন, এই সংস্কার বাস্তবায়ন না করা তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। অর্থাৎ গণভোটটি একধরনের নৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি করবে।

তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়: আমাদের কি এই ঝুঁকি নেওয়া উচিত?

একটি বড় জাতীয় দল হিসেবে বিএনপির উচিত জাতীয় স্বার্থে তাদের দেওয়া এই নোট অব ডিসেন্ট প্রত্যাহার করা। কারণ, বিকল্প দৃশ্যপটটা ভয়ংকরভাবে পরিচিত। আমরা আবার সেই পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাব, যেখানে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ব্যবস্থায় গঠিত নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে যেকোনো দল এককভাবে সংবিধান সংশোধন করতে পারে—ইতিহাস বলছে, মাত্র প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও এমন অবস্থান পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

যত দিন এই একতরফা সাংবিধানিক সংশোধনের সুযোগ খোলা থাকবে, তত দিন অন্য যেকোনো সংস্কারই আসলে নিরাপদ থাকবে না। সেসব সংস্কার আজ লিখে রাখা যাবে, কিন্তু কাল পরিবর্তন করে দেওয়া যাবে। সেই কাঠামোয় ‘জুলাই সনদ’ বড়জোর প্রতীক হবে, কিন্তু হবে না ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর ঢাল। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের নতুন সংঘাতের ঝুঁকি।

ইসলামুল হক যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক।

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ