শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে কানাডা।

বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে আজ সোমবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে হাইকমিশনার অজিত সিং বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় কানাডা বাংলাদেশের পাশে রয়েছে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের বেশি সময়ের ঐকমত্যের পর রাজনৈতিক দলগুলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এ স্বাক্ষর করে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির সাক্ষী থাকা কানাডিয়ান হাইকমিশনারসহ অন্য কূটনীতিকগণ একে বাংলাদেশের রাজনৈতিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষরের প্রশংসা করে অজিত সিং বলেন, মূল গণতান্ত্রিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের রূপরেখা ‘জুলাই সনদ’-এ দেওয়া হয়েছে, যা জাতীয় ঐক্য, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছ শাসনকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে।

শুক্রবার স্বাক্ষরের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’–এ স্বাক্ষর ঐক্যের ধ্বনিকে প্রতীকায়িত করেছে, যা জাতিকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পথে দিকনির্দেশনা দেবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং রাজনৈতিক অংশীদারদের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতি বজায় থাকবে।

কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পালাবদলের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রশংসা করেছেন। তাঁরা জোর দিয়ে বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার জনগণের আস্থা জোরদার এবং দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী কানাডা শাসনব্যবস্থা, শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা ও মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে। হাইকমিশনের এই অঙ্গীকার বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সুশাসন গড়ে তুলতে কানাডার অব্যাহত সহায়তারই প্রতিফলন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক র জন ত ক

এছাড়াও পড়ুন:

সেনা ছাড়াই গাজায় যুদ্ধ চালানোর পরিকল্পনা এঁটেছে ইসরায়েল

ইসরায়েলের ট্যাংকের পিছু হটা কিংবা যুদ্ধবিমানের আওয়াজ নীরব হয়ে যাওয়ার মানেই গাজা যুদ্ধের অবসান নয়। ইসরায়েলি আগ্রাসনে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, লাখো বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, প্রায় ২০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।

কিন্তু গাজার বাসিন্দাদের সবচেয়ে বড় বিপদ হয়তো সামনে অপেক্ষা করছে। কারণ, ইসরায়েল এমন আরেকটি রূপে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়, যেখানে সরাসরি সেনা উপস্থিতির দরকার নেই। 

ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ যে শূন্যস্থান তৈরি করেছে, সেখানে ভয়ংকর এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। ভেঙে পড়া সামাজিক আর মানুষের তীব্র দুর্ভোগকে পুঁজি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আবির্ভূত হচ্ছে।

এই দলগুলো একসময় দখলদারদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের’ বাহিনী হিসেবে নিজেদের দাবি করত। কিন্তু এখন তারা ক্রমে নিজেদের মানুষদের দিকেই অস্ত্র তাক করছে। মাতৃভূমির প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসার বদলে তারা সহিংসতার মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণাকে তারা গোষ্ঠীতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির মুদ্রায় পরিণত করছে। 

আরও পড়ুনগাজা যুদ্ধে কে ‘জয়ী’ হলো, কে ‘বিজয়ী’ হলো?১৫ অক্টোবর ২০২৫

গাজা দীর্ঘদিন ইসরায়েলি বাহিনীর দখলে ছিল। এখানকার বাসিন্দাদের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এক দমবন্ধ জীবন যাপন করতে হয়েছে। তবু নিজেদের দেয়ালের মধ্যে তাঁরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিলেন।

গাজার লোকেরা ইসরায়েলি বিমান হামলায় ভয় পেতেন, অপরাধী গোষ্ঠী বা প্রতিবেশীর বন্দুকের ভয় তাঁদের ছিল না। আজ তঁাদের ভয় বহুগুণ বেড়েছে। সেটা দখলদারির দিক থেকে যেমন, আবার নিজেদের লোকদের দিক থেকেও। 

গাজা সিটির সাবরা এলাকায় সাংবাদিক সালেহ আলজাফারাউইয়ের হত্যাকাণ্ড এই নতুন পর্যায়ের অন্যতম অশুভ লক্ষণ। ২৮ বছর বয়সী এই প্রতিবেদক দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার দলিল তৈরি করেছিলেন।

তিনি তাঁর কাজের জন্য বারবার মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিলেন। শান্তিচুক্তির কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি নিহত হলেন। ইসরায়েলি সেনার গুলি কিংবা ড্রোন হামলায় নয়, তিনি নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীদের হাতে। 

আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধবিরতিতে কে জিতল—ইসরায়েল নাকি হামাস?১০ অক্টোবর ২০২৫

এই হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিল যুদ্ধ এখনো অন্য রূপে চলছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের একে অপরের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে, ভয় ও রক্তপাতের এক চক্র তৈরি করেছে। এটি সৈন্যদের উপস্থিতি ছাড়াই ইসরায়েলি স্বার্থের পক্ষে কাজ করছে। 

এখানে ইসরায়েলের যুক্তি স্পষ্ট। দীর্ঘদিন ধরেই তারা একটি পুরোনো ঔপনিবেশিক কৌশল ‘ভাগ করে শাসন করার’ ওপর নির্ভর করছে। একটি সমাজ যদি অভ্যন্তরীণ সহিংসতার বৃত্তে ঢুকে পড়ে, সেই সমাজ আর দখলদারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থানকে নিজেদের হীনস্বার্থে উৎসাহিত করে, ইসরায়েল দুটি লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এক. ফিলিস্তিনিদের ঐক্য দুর্বল করা। দুই. নিজেদের সেনাবাহিনীর ওপর বোঝা কমানো। এই কৌশল সরাসরি ব্যয় ও আন্তর্জাতিক নজরদারি এড়ায়, কিন্তু গাজা সেই একইভাবে রক্তাক্ত হতে থাকবে। 

গাজায় বর্তমানে যেসব সশস্ত্র গ্যাং ভীতি ছড়াচ্ছে, তারা জন্মভূমির প্রতিরোধযোদ্ধা নয়, বরং ইসরায়েলের রাজাকার গোষ্ঠী। তারা ভিন্ন নামে ইসরায়েলের দখলকে সহায়তা করছে। যুদ্ধের সময় তাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সেই সব জায়গায় কাজ করার জন্য, যেখানে ইসরায়েল সব সময় প্রকাশ্যে কাজ করতে পারত না। 

ইসরায়েলের স্বার্থে যেসব ফিলিস্তিনি কাজ করে, তাদের নিয়ে ইসরায়েলিদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ব্যবহার করার পর ছুড়ে ফেলা। উদ্দেশ্য সিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজাকারদের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা। 

আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধবিরতির পর নেতানিয়াহুর সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ১১ অক্টোবর ২০২৫

যে লোকটা এখন নিজেদের মানুষের বুকে বন্দুক তাক করছেন, তিনি নিজেকে শক্তিশালী বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু তার পরিণতি সব সময়ের জন্য এক। নিজের দেশের জনগণ ও দখলদার—সবাই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। 

ফিলিস্তিনিদের জন্য এর পরিণতি কোনোভাবেই বিপর্যয়ের চেয়ে কম কিছু নয়। ভয়ের পরিবেশে মুক্তি নির্মাণ করা যায় না। প্রতিরোধ যখন নৈতিক স্বচ্ছতা হারায়, যখন এটিকে নিপীড়কদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আলাদা করা যায় না, তখন এটি তার বৈধতা হারায়। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম কখনো শুধু খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার জন্য ছিল না; এটি সব সময় মর্যাদা, ন্যায় ও স্বাধীনতার জন্য ছিল। 

ইসরায়েল হয়তো আশা করছে যে তারা প্রক্সিদের দিয়ে যুদ্ধ জারি রাখবে। তারা এমন এক গাজার কথা কল্পনা করছে, যেখানে ফিলিস্তিনিরা দখলদারদের বিরুদ্ধে না লড়ে নিজেদের মধ্যে লড়বে। ফিলিস্তিনিদের এখনো তাদের পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে। তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পথকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবং ফিলিস্তিনি সংগ্রাম যেকোনো গোষ্ঠীর চেয়ে বড়, সেটা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। 

আমাল আবু সিফ ফিলিস্তিনি লেখক ও গবেষক

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

[লেখাটি ১৮ অক্টোবর ২০২৫ প্রথম আলো ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়। আজ ২০ অক্টোবর ২০২৫ অনলাইনেও প্রকাশিত হলো।]

সম্পর্কিত নিবন্ধ