সম্প্রতি সিপিবি ও বাসদ নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এ তিন দলের নেতাদের ঐকমত্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা ও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক চক্রে সবসময় বামপন্থিরা বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকেই কাছের দল মনে করেছে। বিএনপির সঙ্গে বামপন্থিদের এই দূরত্বের মূল কারণ হচ্ছে– দলটি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত জামায়াতের সঙ্গে একটি ঐক্য সবসময় বজায় রেখেছে। একসঙ্গে সরকার গঠন করেছে। শুধু জামায়াত নয়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির একটি সমঝোতা, একসঙ্গে চলার প্রবণতা বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই পরিলক্ষিত। ফলে বিগত সময়ে বামপন্থি দলগুলোর বড় অংশ নানা ইস্যুতে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চলতে, কথা বলতে, মতবিনিময় করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। 

কিন্তু বিগত ১৫ বছরে বাস্তব নানা কারণে বিএনপির সঙ্গে বামপন্থিদের একটি বোঝাপড়া এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে। বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে দুটো বিএনপি বর্জন করেছে সেগুলোর ব্যাপারে সিপিবি-বাসদসহ বাম ঘরানার অধিকাংশ দল একই অবস্থান নিয়েছিল। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মতো সিপিবি-বাসদও অংশ নিয়েছে।  বিএনপির দক্ষিণপন্থি ঝোঁকের কারণে ওই বামপন্থি দলগুলো এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বিএনপির সঙ্গে সরাসরি ঐকমত্য পোষণ করে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করেনি। এ সময়ে তাদের জোটসঙ্গী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হলেও সিপিবি-বাসদসহ অন্য কিছু বাম দলকে নিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ব্যানারে স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রেখে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। 
এই প্রেক্ষাপটে সিপিবি-বাসদের সঙ্গে বিএনপির এই বৈঠক এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। উভয় পক্ষ আন্তরিক হলে হয়তো তাদের এ বোঝাপড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক হিসাবনিকাশ পাল্টে দিতে পারে। সত্য, এ নিয়ে সমর্থন ও সমালোচনার ঝড় বইছে সিপিবি-বাসদ সমর্থকদের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার প্রকাশও ঘটেছে। এটিও অনস্বীকার্য, ৫ আগস্ট-পরবর্তী কতগুলো ঘটনা ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে যুগপৎ আন্দোলনকারী এ দুই ধারাকে আবারও একসঙ্গে বসতে বাধ্য করেছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সখ্য কারও নজর এড়ানোর কথা নয়। পাশাপাশি এটিও লক্ষণীয়, গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির ভূমিকাকে অস্বীকারের প্রবণতা সরকার ও জামায়াতের মধ্যে দেখা গেছে। নির্বাহী বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আওয়ামী ঘরানার লোকগুলোকে বিদায় করে দিয়ে জামায়াতের লোক পদায়নে সরকারকে বেশি আগ্রহী মনে হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব যারা এনসিপি নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, তারা আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়– এমন বার্তাও নানাভাবে প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতা, একাত্তরকে নানাভাবে অস্বীকার করার প্রবণতা, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মারকগুলো ভেঙে ফেলা, জাতীয় পার্টির অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া, সিপিবি অফিস গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা; জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পরিবর্তন, অন্তর্বর্তী সরকারের আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় প্রকাশ সিপিবি-বাসদ তো বটেই, বিএনপিকেও ভীত করেছে। বিএনপি নেতারা মাঝেমধ্যে ২০০৭ সালের সেই ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র ছায়া এ সরকারের মধ্যে দেখছেন। অন্যদিকে উগ্রবাদীদের উত্থান, আস্ফালন বামপন্থিদের ভীত করেছে। বিভিন্ন বাম দল ও সংগঠন বর্তমান সরকারের সঙ্গে আমেরিকার সখ্য, জামায়াতসহ ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানকে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্য হিসেবে দেখছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের দুই পরাজিত শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তাদের এই বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় বাড়াবাড়ি থাকতে পারে, কিন্তু তা তাদের বিএনপির দিকে ঝুঁকে যেতে বাধ্য করেছে।

বিএনপি পরবর্তী সরকার গঠন করবে– এটি সবাই ধারণা করছে। পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বিএনপি নেতৃত্বও গুরুত্ব সহকারে নিতে চাচ্ছে। জনগণের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের যতটুকু দায়বোধ, তার চেয়ে অনেক বেশি দায় থাকে নির্বাচিত সরকারের। বিএনপি বিষয়টি বারবারই বলছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ধারণা দিচ্ছে, দেশে প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। অর্থনীতির এ সংকট যদি সত্যিই প্রধান উপদেষ্টা প্রতিশ্রুত সময় অনুযায়ী নির্বাচন হয়, শেষমেশ নির্বাচিত সরকারকেই তা মোকাবিলা করতে হবে। তাই নির্বাচন দ্রুত হওয়া নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথা বেশি থাকাই স্বাভাবিক। 
শেখ হাসিনা তাঁর শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে নির্বাচন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক দুর্নীতিসহ নানা গণবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশের রাজনীতির বহু উপাদান নষ্ট কিংবা ধ্বংস করে দিয়েছেন। এটি করতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তাদের দলটিই জনবিচ্ছিন্ন; বলতে গেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে। কবে কখন দলটি ঘুরে দাঁড়াবে; আদৌ এই দলের কোনো ভবিষ্যৎ আছে কিনা, তা অস্পষ্ট, অজানা। রাজনীতির ময়দানে ফিরে আসতে পারলে জনগণ তাদের কীভাবে গ্রহণ করবে, তাও ভাবনার বিষয়। 

এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি প্রশ্নে; বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা নস্যাত করতে সব দেশপ্রেমিক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষশক্তির ঐক্যবদ্ধ সম্মিলন জরুরি। কাজটির উদ্যোগ বামপন্থিরাই নিতে পারে। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের টেকসই গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ন্যূনতম সমঝোতায় প্রকট বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে সমাজকে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সব রাজনৈতিক দল ও নানা মতধারার জনগণের ঐক্যের মতো জরুরি কাজটিও বামপন্থি দলগুলো এই মুহূর্তে করতে পারে। এটি তাদের 
বিরাট সুযোগ। 
বিএনপি ও সিপিবি-বাসদের এই সভা হতে পারে এই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের বড় ভিত্তি। 

রুস্তম আলী খোকন: কলাম লেখক ও সংগঠক
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ব মপন থ দ র র জন ত ক সরক র র অবস থ দলগ ল আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়, আগে প্রয়োজন গণপরিষদ

কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, যে গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল তা কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে গণঅভ্যুত্থান হয়নি, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে জনগণের ব্যানারে সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিল। কী অভিপ্রায়ে গণঅভ্যুত্থান হলো সে বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য তৃনমূল পর্যায়ে এ অন্তর্বর্তী সরকারকে যেতে হবে। জনগণের কথা শুনে তাদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢাকায় বসে সংস্কার কমিশন গঠন করে সিদ্ধান্ত নিলে তা জনগণের অভিপ্রায় পূরণ হবে না।

আজ শুক্রবার দুপুরে তিনি বগুড়া প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন।

ফরহাদ মজহার আরও বলেন, বাংলাদেশের জন্য নতুন সংবিধান না, নতুন গঠনতন্ত্রের প্রয়োজন। গঠনতন্ত্র মানে কিন্তু আইন না, তবে সংবিধান মানে হচ্ছে আইন। আর আমরা কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসক না। ইংরেজরা আইন প্রণয়ন করে আর জনগণ গঠনতন্ত্র করে। আর এ পার্থক্যটাই মনে রাখতে হবে। তার মানে আপনি যখনই সংবিধান বলবেন আপনি ঔপনিবেশিক একজন শাসক। তখন আপনি লুটেরা মাফিয়াতন্ত্রের ন্যায় একজন শাসক। আপনি একটা আইন দিয়ে গরীবদের শাসন করবেন। তাই আগে গঠনতন্ত্র তৈরি করে গণপরিষদ নির্বাচন করা প্রয়োজন, তারপর জাতীয় নির্বাচন।

গঠনতন্ত্র মানে জনগণ নিজেরাই অংশগ্রহণ করবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তারা পরস্পরের সঙ্গে কীভাবে বাস করবে এটা তারা তৈরি করবে। সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারবে, তরুণদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে আবার যারা ক্ষমতায় আসবে তারা আগের সরকারের মতোই লুটপাট করবে। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। এ জন্য সাধারণ মানুষ ও তরুণদের অংশগ্রহণে আগে গণপরিষদ নির্বাচন, তারপরে জাতীয় নির্বাচন।

তিনি বলেন, তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এক. কোন মানুষের অধিকার হরণ করা যাবে না; মানুষকে মর্যাদা দিতে হবে। দুই. প্রাকৃতিক কোনো কিছু দখল করা যাবে না, তিন মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয় এমন কোন আইন করা যাবে না।

ফরহাদ মজহার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মানবিক করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রক্সি ওয়ারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমি কোনভাবেই চাইবো না করিডোর দেওয়া হোক। করিডোর কখনও আমাদের দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। এসব কারণে বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণকে সেনাবাহিনীর সদস্য করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন। সেনাবাহিনীকে জাতীয় সেনাবাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পুরো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনই বাতিলের চক্রান্ত কেন
  • জাকসু নির্বাচনে মামলার আসামিদের না রাখার দাবি
  • রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের আদালতের মুখোমুখি করার উদ্যোগ নিতে হবে:
  • নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়, আগে প্রয়োজন গণপরিষদ: ফরহাদ মজহার
  • জাতীয় নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়, আগে প্রয়োজন গণপরিষদ
  • সংস্কার ও নির্বাচন উভয়টি প্রয়োজন: তারেক রহমান
  • বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আর গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র একই: গয়েশ্বর
  • পুলিশের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে: সলিমুল্লাহ খান
  • গণতন্ত্রে যাওয়ার ওপরে নির্ভর করছে বাংলাদেশের অস্তিত্ব: মির্জা ফখরুল