গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা এবং বামপন্থিদের উদ্যোগ
Published: 2nd, May 2025 GMT
সম্প্রতি সিপিবি ও বাসদ নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এ তিন দলের নেতাদের ঐকমত্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা ও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক চক্রে সবসময় বামপন্থিরা বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকেই কাছের দল মনে করেছে। বিএনপির সঙ্গে বামপন্থিদের এই দূরত্বের মূল কারণ হচ্ছে– দলটি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত জামায়াতের সঙ্গে একটি ঐক্য সবসময় বজায় রেখেছে। একসঙ্গে সরকার গঠন করেছে। শুধু জামায়াত নয়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির একটি সমঝোতা, একসঙ্গে চলার প্রবণতা বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই পরিলক্ষিত। ফলে বিগত সময়ে বামপন্থি দলগুলোর বড় অংশ নানা ইস্যুতে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চলতে, কথা বলতে, মতবিনিময় করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে।
কিন্তু বিগত ১৫ বছরে বাস্তব নানা কারণে বিএনপির সঙ্গে বামপন্থিদের একটি বোঝাপড়া এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে। বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে দুটো বিএনপি বর্জন করেছে সেগুলোর ব্যাপারে সিপিবি-বাসদসহ বাম ঘরানার অধিকাংশ দল একই অবস্থান নিয়েছিল। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মতো সিপিবি-বাসদও অংশ নিয়েছে। বিএনপির দক্ষিণপন্থি ঝোঁকের কারণে ওই বামপন্থি দলগুলো এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বিএনপির সঙ্গে সরাসরি ঐকমত্য পোষণ করে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করেনি। এ সময়ে তাদের জোটসঙ্গী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হলেও সিপিবি-বাসদসহ অন্য কিছু বাম দলকে নিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ব্যানারে স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রেখে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে সিপিবি-বাসদের সঙ্গে বিএনপির এই বৈঠক এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। উভয় পক্ষ আন্তরিক হলে হয়তো তাদের এ বোঝাপড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক হিসাবনিকাশ পাল্টে দিতে পারে। সত্য, এ নিয়ে সমর্থন ও সমালোচনার ঝড় বইছে সিপিবি-বাসদ সমর্থকদের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার প্রকাশও ঘটেছে। এটিও অনস্বীকার্য, ৫ আগস্ট-পরবর্তী কতগুলো ঘটনা ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে যুগপৎ আন্দোলনকারী এ দুই ধারাকে আবারও একসঙ্গে বসতে বাধ্য করেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সখ্য কারও নজর এড়ানোর কথা নয়। পাশাপাশি এটিও লক্ষণীয়, গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির ভূমিকাকে অস্বীকারের প্রবণতা সরকার ও জামায়াতের মধ্যে দেখা গেছে। নির্বাহী বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আওয়ামী ঘরানার লোকগুলোকে বিদায় করে দিয়ে জামায়াতের লোক পদায়নে সরকারকে বেশি আগ্রহী মনে হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব যারা এনসিপি নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, তারা আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়– এমন বার্তাও নানাভাবে প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতা, একাত্তরকে নানাভাবে অস্বীকার করার প্রবণতা, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মারকগুলো ভেঙে ফেলা, জাতীয় পার্টির অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া, সিপিবি অফিস গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা; জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পরিবর্তন, অন্তর্বর্তী সরকারের আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় প্রকাশ সিপিবি-বাসদ তো বটেই, বিএনপিকেও ভীত করেছে। বিএনপি নেতারা মাঝেমধ্যে ২০০৭ সালের সেই ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র ছায়া এ সরকারের মধ্যে দেখছেন। অন্যদিকে উগ্রবাদীদের উত্থান, আস্ফালন বামপন্থিদের ভীত করেছে। বিভিন্ন বাম দল ও সংগঠন বর্তমান সরকারের সঙ্গে আমেরিকার সখ্য, জামায়াতসহ ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানকে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্য হিসেবে দেখছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের দুই পরাজিত শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। তাদের এই বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় বাড়াবাড়ি থাকতে পারে, কিন্তু তা তাদের বিএনপির দিকে ঝুঁকে যেতে বাধ্য করেছে।
বিএনপি পরবর্তী সরকার গঠন করবে– এটি সবাই ধারণা করছে। পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বিএনপি নেতৃত্বও গুরুত্ব সহকারে নিতে চাচ্ছে। জনগণের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের যতটুকু দায়বোধ, তার চেয়ে অনেক বেশি দায় থাকে নির্বাচিত সরকারের। বিএনপি বিষয়টি বারবারই বলছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ধারণা দিচ্ছে, দেশে প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। অর্থনীতির এ সংকট যদি সত্যিই প্রধান উপদেষ্টা প্রতিশ্রুত সময় অনুযায়ী নির্বাচন হয়, শেষমেশ নির্বাচিত সরকারকেই তা মোকাবিলা করতে হবে। তাই নির্বাচন দ্রুত হওয়া নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথা বেশি থাকাই স্বাভাবিক।
শেখ হাসিনা তাঁর শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে নির্বাচন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক দুর্নীতিসহ নানা গণবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশের রাজনীতির বহু উপাদান নষ্ট কিংবা ধ্বংস করে দিয়েছেন। এটি করতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তাদের দলটিই জনবিচ্ছিন্ন; বলতে গেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে। কবে কখন দলটি ঘুরে দাঁড়াবে; আদৌ এই দলের কোনো ভবিষ্যৎ আছে কিনা, তা অস্পষ্ট, অজানা। রাজনীতির ময়দানে ফিরে আসতে পারলে জনগণ তাদের কীভাবে গ্রহণ করবে, তাও ভাবনার বিষয়।
এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি প্রশ্নে; বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা নস্যাত করতে সব দেশপ্রেমিক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষশক্তির ঐক্যবদ্ধ সম্মিলন জরুরি। কাজটির উদ্যোগ বামপন্থিরাই নিতে পারে। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের টেকসই গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ন্যূনতম সমঝোতায় প্রকট বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে সমাজকে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সব রাজনৈতিক দল ও নানা মতধারার জনগণের ঐক্যের মতো জরুরি কাজটিও বামপন্থি দলগুলো এই মুহূর্তে করতে পারে। এটি তাদের
বিরাট সুযোগ।
বিএনপি ও সিপিবি-বাসদের এই সভা হতে পারে এই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের বড় ভিত্তি।
রুস্তম আলী খোকন: কলাম লেখক ও সংগঠক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ব মপন থ দ র র জন ত ক সরক র র অবস থ দলগ ল আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
এমন তো হবার কথা ছিল না: তারেক রহমান
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জনমনে সৃষ্ট সংশয়, সন্দেহ গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে সংকটপূর্ণ করে তুলতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
শেষ পর্যন্ত কোনো অগণতান্ত্রিক কিংবা অপশক্তির কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের পথে হাটতে হয় কি-না, এমন শঙ্কাও জানিয়েছেন তারেক রহমান। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মাঠে থাকা সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে এমন বিপদের কথাও স্মরণ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
প্রবাসে বিএনপির সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচির অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তারেক রহমান। লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হন তিনি। আজ রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিএনপি।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মানুষের উদ্বেগের কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, ‘পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের শাসন আমলে জনগণের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনোই আগ্রহ ছিল না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় জনমনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসা বাড়ছে, যথাসময়ে কি নির্বাচন হবে?... এমন তো হবার কথা ছিল না।’
বিএনপির বিজয় ঠেকাতে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার ও অপকৌশল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে বলে উল্লেখ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘উদ্বেগ এবং আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশেও বর্তমানে বিএনপির বিজয় ঠেকাতে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার এবং অপকৌশল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।’
দেশে প্রতিনিয়ত একের পর এক নিত্য নতুন শর্ত জুড়ে দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সংকটাপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তবে তাঁর বিশ্বাস, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তিতে বিশ্বাসী নাগরিকেরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রই বিএনপিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
শুধু বিএনপির বিজয় ঠেকাতে গিয়ে পতিত পরাজত পলাতক স্বৈরাচার দেশে ‘ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, তবে বিএনপির প্রতি দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের আস্থা, ভালোবাসা থাকায় সে সংকট কাটিয়েছে তাঁর দল।
তারেক রহমান বলেন, ‘দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি শুরু থেকেই ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে একদিকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পথ বেছে নিয়েছে। অপরদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও যতটুকু সম্ভব, যতটুকু যথাসাধ্য সম্ভব আমাদের অবস্থান থেকে আমরা সহযোগিতা করে আসছি।’
প্রবাসে বিএনপির সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচির অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে