প্রবাসী আয়ে শীর্ষে এখন যুক্তরাষ্ট্র, করারোপের ঘোষণায় বেড়েছে দুশ্চিন্তা
Published: 23rd, May 2025 GMT
২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটি থেকে প্রবাসী আয় প্রেরণের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ করারোপের প্রস্তাব করেছেন। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় আসা কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাত–সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ।
আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, প্রবাসী আয় প্রেরণের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে বিশ্ববাজারে উৎস দেশের বড় বাঁকবদল হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে বড় বড় এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে গন্তব্য দেশে প্রেরণ করছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় প্রেরণে করারোপ করা হলে আবারও তা উৎস দেশ থেকে গন্তব্য দেশে প্রেরণ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ১৪৪ দশমিক ৪৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট প্রবাসী আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশ। গত জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকে দেশে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছে ৮০১ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৬২৭ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
এদিকে গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ৩৩ কোটি ৭ লাখ ডলার। তাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২৭ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের পর গত জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই থেকে। দেশটি থেকে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এসেছে প্রায় ১০৯ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়। একই প্রান্তিকে সৌদি থেকে এসেছে প্রায় ১০৫ কোটি ডলার; যুক্তরাজ্য থেকে ৯৭ কোটি ডলার; মালয়েশিয়া থেকে ৬৩ কোটি ডলার; কুয়েত থেকে ৪৬ কোটি ডলার; ওমান থেকে ৪৪ কোটি ডলার; ইতালি থেকে ৪০ কোটি ডলার এবং কাতার থেকে এসেছে ৩১ কোটি ডলার।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির পেছনে যেসব বিষয় বড় ভূমিকা রেখেছে, তার মধ্যে অন্যতম হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক পথের ব্যবহার কমে আসা, ব্যাংকগুলোর প্রতিযোগিতামূলক বিনিময় হার ও প্রণোদনার সহজলভ্যতা; ঈদুল ফিতরে প্রবাসীদের বাড়তি অর্থ পাঠানো। ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ডলারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যে পার্থক্য কমে আসায় এই বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানো বেড়েছে।
গত আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে প্রবাসী আয় আসার দিক থেকে শীর্ষে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বৈশ্বিক বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রবাসী আয় কিনে নেয়। পরে সেসব আয় একত্র করে নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে তা গন্তব্য দেশে পাঠায়। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রামসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রিগেটেড (সমন্বিত) পদ্ধতিতে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে প্রেরণ করে।
বাংলাদেশে প্রবাসী আয় প্রেরণে শীর্ষে উঠে আসা যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে প্রবাসী আয় প্রেরণে করারোপের ঘোষণা দেওয়ায় তাই এ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলোর একটি প্রবাসী আয়। এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি প্রবাসী আয় আসে। এমন সময়ে দেশটি যদি প্রবাসী আয় প্রেরণের ওপর কর আরোপ করে, তা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হবে। তাই এখন থেকেই আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে, কীভাবে প্রবাসীদের প্রণোদনা দেওয়া যায়। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও তার প্রভাব কম পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় প্রেরণে কর
বাণিজ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপের পর এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ নামে হাউস বাজেট কমিটিতে অনুমোদিত আইনের আওতায় এই কর আরোপ করা হবে।
এই আইনে মার্কিন নাগরিক ছাড়া সব অভিবাসীর পাঠানো প্রবাসী আয়ে করারোপ করা হবে। গ্রিন কার্ডধারী ও এইচ-১বি ভিসাপ্রাপ্তরাও এর আওতায় পড়বেন। কর আরোপের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সীমা নির্ধারণ করা হয়নি, অর্থাৎ ছোট অঙ্কের অর্থ পাঠালেও কর প্রযোজ্য হবে। ফলে বাংলাদেশিদের প্রেরিত প্রবাসী আয়েও এই কর প্রযোজ্য হবে। সিএনবিসি টিভি ১৮ ডট কমের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বছর র প রথম র প রব আয় র প কর র প র প কর প রব স
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতের বিধিনিষেধে আখাউড়া স্থলবন্দরে রপ্তানি কমেছে ৪০%
ছয় ধরনের পণ্য আমদানিতে ভারতের বিধিনিষেধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে রপ্তানি ৪০ শতাংশ কমেছে। লোকসানের মুখে বন্দরের রপ্তানি ব্যবসা। এতে প্রতিদিন বন্দরে ৪০ লাখ টাকার লোকসান হচ্ছে। গত পাঁচ দিনে দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্দরে আগের মতো আর কর্মব্যস্ততা নেই।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ভারতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হলে স্থলবন্দরের রপ্তানি ব্যবসা বিরাট হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত দুই অর্থবছর বন্দর দিয়ে ৮৮০ কোটি টাকার পণ্য ভারতে রপ্তানি করা হয়েছে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, বিধিনিষেধ আরোপ করা পণ্যের কোনো গাড়ি এখন পর্যন্ত বন্দরে আসেনি। তবে ভারতের নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপনের কারণে বন্দরে ৪০ শতাংশ রপ্তানি কমেছে।
গত শনিবার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের ছয় ধরনের পণ্য আমদানির বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ভারত। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে যে তৈরি পোশাক; ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয় ও কোমল পানীয়; প্রক্রিয়াজাত খাদ্য; প্লাস্টিক পণ্য; সুতা ও সুতার উপজাত এবং আসবাব রপ্তানি করা যাবে না। নিষিদ্ধ করা পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক ও কাঠের আসবাব বাদে বাকি সব ধরনের পণ্য আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানি করা হয়। এই বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার আগতলায় পণ্য যায়।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, বন্দর দিয়ে একেক দিন একেক ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়। সে হিসেবে বিস্কুট প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৫ টন ও মাসে ১০ থেকে ১৫ টন; কোমল পানীয় প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ টন ও মাসে গড়ে ১০০ টন; প্লাস্টিকের পণ্য আড়াই থেকে তিন টন ও মাসে ৭০ টন; প্লাস্টিকের দরজা মাসে গড়ে ২০ গাড়িতে ৪০ টন, প্লাস্টিকের পাইপ মাসে গড়ে ৮-১০ গাড়িতে ২৫ থেকে ৩০ টন এবং মাসে ৩০ থেকে ৪০ গাড়িতে ১৩৫ থেকে ১৮০ টন সুতা আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানি করেন ব্যবসায়ীরা।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পণ্য ভারতে বেশি রপ্তানি করেন আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী মেসার্স জে আর ট্রেডিং ও মেসার্স পূর্বা অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আবু সুফিয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিস্কুট প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ টন, কোমল পানীয় জুস মাসে ৭০ থেকে ৮০ টন, প্লাস্টিকের পণ্য মাসে ৪০ থেকে ৫০ টন, প্লাস্টিকের দরজা মাসে ১৬ থেকে ১৮ টন, প্লাস্টিকের পাইপ মাসে দুই থেকে আড়াই টন এবং ১৩৫ থেকে ১৮০ টন সুতা ভারতে রপ্তানি করি। এখন সব বন্ধ।’
স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, আখাউড়া স্থলবন্দর দেশের প্রধান রপ্তানিমুখী বন্দর। সিমেন্ট, তাজা মাছ, শুঁটকি মাছ, পাথর, বর্জ্য তুলা, আমের পানীয়, প্লাস্টিকের আসবাব, মেলামাইন সামগ্রী, পিভিসি পাইপ ও দরজা, থ্রেসিং মেশিন ও ডিফরমেট বার জাতীয় পণ্য রপ্তানি করা হয়। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৪২৯ কোটি টাকার ৫৪ হাজার ৪৪২ টন পণ্য এবং ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ৪৫৩ কোটি টাকার ৩৮ হাজার ৮৮৭ টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
মিতু এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও আখাউড়া স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি নিছার উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের বিধিনিষেধের কারণে রপ্তানি বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার লোকসান হচ্ছে।
এদিকে রাজস্ব খাত সংস্কার নিয়ে জারি করা অধ্যাদেশের বিরোধিতা করে আন্দোলন করছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচি দিচ্ছেন তাঁরা। রপ্তানিমুখী কার্যক্রম এই আন্দোলন তথা কর্মসূচির আওতাভুক্ত নয়। তাই এর কোনো প্রভাব পড়ছে না।
আখাউড়া স্থলবন্দরের শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আন্দোলনের আওতামুক্ত। বন্দরের কার্যক্রমে স্বাভাবিক আছে এবং কোনো প্রভাব পড়ছে না।