মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার তৃতীয় দিনেও ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ইসরায়েল। রবিবার (৮ জুন) ঈদের তৃতীয় দিন দফায় দফায় ইসরায়েলের হামলায় ১০৮ ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরো প্রায় ৪০০ জন আহত হয়েছেন। খবর আনাদোলুর। 

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৮টি মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়েছে। একই সময়ে ৩৯৩ আহতকে হাসপাতালে আনা হয়। কিন্তু তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষমতা হাসপাতালগুলোর নেই।

গাজায় শুক্রবার (৬ জুন), ঈদুল আজহার প্রথম দিনে ইসরায়েলি বিমান হামলা ও গোলাগুলিতে ৩৩ ফিলিস্তিনি নিহত হন। শনিবার (৭ জুন), ঈদের দ্বিতীয় দিন ৭২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েল।  

আরো পড়ুন:

গাজায় ঈদের দ্বিতীয় দিন ইসরায়েলের হামলায় নিহত ৭২

ঈদের দিনেও গাজায় নিহত ৪২, খাবার বিতরণ বন্ধ

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই অভিযানে রবিবার (৮ জুন) পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৪ হাজার ৮৮০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ১ লাখ ২৬ হাজার ২২৭ জন।

জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলের ব্যাপক সামরিক অভিযানের ফলে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং প্রায় ৮৫ শতাংশ জনসংখ্যা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

জাতিসংঘের মতে, দীর্ঘ এ সময় ধরে চলা সংঘাতের কারণে মানবিক সংকটে দিন পার করছেন ফিলিস্তিনিরা। খাবার, পানি, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তার অভাবে উপত্যকাটির ২৩ লাখেরও বেশি বাসিন্দা চরম ক্ষুধা ও ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছেন।

গাজায় ইসরায়েলি হামলা নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। জানুয়ারিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে তেল আবিবকে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে রায় উপেক্ষা করে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।

ঢাকা/ফিরোজ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

মুখ ফিরিয়েছে বিশ্ব, গাজা কি নিভে আসছে

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের (৪ জুলাই) এক মাস আগে দেশটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ভেটো (‘না’ ভোট) দিয়ে আটকে দেয়।

প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, গাজায় সব পক্ষকে মেনে চলার জন্য ‘একটি স্থায়ী, নিঃশর্ত ও দ্রুত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা’ দিতে হবে এবং হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর হাতে থাকা সব ইসরায়েলি বন্দীকে সম্মানজনকভাবে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।

নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যদেশের মধ্যে ১৪টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করায় সেটি বাতিল হয়ে যায়।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছিল, গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছাতে যেসব বাধা আছে সেসব বাধা এবং গাজার ওপর আরোপ করা সব নিষেধাজ্ঞা তুলে দিতে হবে; জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা যেন নিরাপদে বাধা ছাড়া ত্রাণ পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এই ভেটোর ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ঘোষণা দেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) চারজন বিচারককে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আনা হচ্ছে।

কারণ, তাঁরা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার চেষ্টা করেছেন। এর আগে একই কারণে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রধান কৌঁসুলিকেও নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

আরও পড়ুনগাজাবাসীর ঈদ: ‘কোরবানি দেওয়ার মতো কিছু নেই শুধু নিজেদের ছাড়া’০৬ জুন ২০২৫

সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শুধু গাজায় যুদ্ধবিরতি থামানোর প্রস্তাবে বাধা দেয়নি, বরং যাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে চান, তাঁদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) প্রধান মিরিয়ানা স্পলিয়ারিচ গাজাকে ‘পৃথিবীর নরক থেকেও ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করেছেন।

ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য হলো গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করা। এই নীতিকে টিকে থাকতে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন এবং আরব দেশগুলোর নীরবতা।

ইসরায়েলের সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের এই সামরিক লক্ষ্য নিয়ে কোনো রাখঢাক করছেন না; বরং স্পষ্ট করেই বলে আসছেন, তাঁরা কী করতে চান।

আরও পড়ুনগাজায় গণহত্যায় যুক্তরাজ্য যেভাবে মদদ দিচ্ছে০৫ জুন ২০২৫

গাজায় মানুষের জীবনধারণের জন্য যেসব মৌলিক জিনিস দরকার, যেমন পানি, বিদ্যুৎ, ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি হাসপাতাল—সবই ইসরায়েল ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন গাজায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছে, এমন হাসপাতাল আছে মাত্র দুটি।

জাতিসংঘ বলছে, এ দুটি হাসপাতালকে নিরাপদ রাখতে হবে, কারণ প্রতিদিন গাজায় বিমান হামলা আর ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে। এদের মধ্যে শিশু আর বৃদ্ধের সংখ্যা অনেক বেশি। জাতিসংঘ আরও জানাচ্ছে, প্রতিদিন গাজায় অপুষ্ট শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে।

এই অপুষ্টির প্রধান কারণ হলো ইসরায়েলের আরোপ করা খাদ্য অবরোধ। আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য সংস্থা এই অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু ইসরায়েল তা গ্রাহ্য করেনি। বরং তারা নিজেরাই কিছু ‘খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র’ চালু করেছে।

এসব জায়গায় বহু ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিকে (যাঁদের মধ্যে নারীও রয়েছেন) ইসরায়েলি ট্যাংকে বসানো মেশিনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

গাজায় খাদ্যসংকটের এই জটিল পরিস্থিতির আরেকটি দিক হলো, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, তাঁর সরকার এমন একটি গোষ্ঠীকে অস্ত্র দিয়েছে, যাদের অনেকেই অপরাধী এবং যাদের সম্পর্কে ধারণা করা হয়, তারা ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধী দলের রাজনীতিক আবিগদর লিবারম্যান ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমকে জানান, প্রধানমন্ত্রী নিজেই একতরফাভাবে আবু শাবাব নামের একটি গোষ্ঠীকে অস্ত্র দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছেন এবং তাদের কাছে অস্ত্র হস্তান্তরও করেছেন।

তাঁর ভাষায়, ‘ইসরায়েলি সরকার একদল অপরাধী ও দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অস্ত্র দিচ্ছে, যাদের অনেকেই আইএস গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।’

বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যাদের ইসরায়েলি সরকার অস্ত্র দিয়েছে, সেই গোষ্ঠীর নেতা ইয়াসির আবু শাহাব একজন সাবেক আইএস কমান্ডার এবং বর্তমানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করছেন।

ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর (ইসরায়েলি অকুপেশন ফোর্সেস) মতে, শাহাবের নেতৃত্বাধীন প্রায় ৩০০ জনের একটি দল গাজায় প্রবেশ করা খাদ্যবাহী ট্রাকগুলোর ‘রক্ষা করার’ কাজ করছে। কিন্তু গাজা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এই দল আসলে ঠিক তার উল্টো কাজ করছে।

তারা এই খাদ্যবাহী ট্রাকগুলো দখল করে নিচ্ছে এবং অপুষ্টিতে ভোগা, ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য বরাদ্দ খাদ্যসামগ্রী লুট করছে।

আরও পড়ুনগাজায় ‘জল্লাদের উল্লাস’ কি থামবে না১০ জানুয়ারি ২০২৫

এই একতরফা জাতিগত নির্মূল কার্যক্রম (যা যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সক্রিয় সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে) তা ইউরোপের অন্তত কিছু জনগণের মধ্যে মতামতের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।

স্টিভ উইটকফের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে, তিনি হামাসের সঙ্গে একরকম চুক্তি করে পরে তা অমান্য করেন এবং দোষ চাপান হামাসের ওপর। তিনি প্রকৃত সত্য গোপন করে ঘটনাকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এই পরিস্থিতির কারণে ইউরোপে জনমত ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করা প্রচারণাকারীদের এখন অনেক কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এত দিন তাঁরা কোনো বাধা ছাড়াই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যেতে পারলেও, এখন কিছু সাংবাদিক সেই প্রচারণার বিরুদ্ধেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।

ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার মতো আরব বিশ্বের বন্ধু কম; বরং এই অঞ্চলের নেতারা ট্রাম্পকে হাত খুলে অর্থ দিয়েছেন, কিন্তু গণহত্যা বন্ধে কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি। গাজায় যখন গণহত্যা চলছে, তখন আমরা দেখলাম, ‘উম্মাহ’র সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাশক্তি যে দেশটির হাতে, সেই দেশের ক্ষমতাধর অভিজাত কর্মকর্তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কিন দূতাবাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার ‘সম্মান’ পাওয়ার আশায়।

সম্প্রতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইউগোভ পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে ইসরায়েল বিষয়ে জনমত পর্যবেক্ষণ শুরু হওয়ার পর এই প্রথমবার সবচেয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড অন্যায্য।

তবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁর ‘গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনা’ ঠিক পথেই রয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করাই হবে বাস্তবতা।

ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার মতো আরব বিশ্বের বন্ধু কম; বরং এই অঞ্চলের নেতারা ট্রাম্পকে হাত খুলে অর্থ দিয়েছেন, কিন্তু গণহত্যা বন্ধে কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি।

গাজায় যখন গণহত্যা চলছে, তখন আমরা দেখলাম, ‘উম্মাহ’র সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাশক্তি যে দেশটির হাতে, সেই দেশের ক্ষমতাধর অভিজাত কর্মকর্তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কিন দূতাবাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার ‘সম্মান’ পাওয়ার আশায়।

ডন থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আব্বাস নাসির ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মুখ ফিরিয়েছে বিশ্ব, গাজা কি নিভে আসছে