ইরানকে ঘিরে ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের ধারণা নতুন নয়। পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ইরানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস দীর্ঘ এবং বহুবার তাদের কার্যক্রম ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এই ইতিহাস একদিকে পশ্চিমের ‘গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা’র ভাষ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, অন্যদিকে ইরানের জনগণের মধ্যে জন্ম দিয়েছে এক গভীর অবিশ্বাস।

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সাম্প্রতিক সামরিক সংঘাত যখন আরো তীব্র হয়ে উঠেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন; ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি মার্কিন বাহিনীর জন্য ‘একজন সহজ লক্ষ্য’।

মঙ্গলবার ১৭ জুন ট্রাম্প তার নিজের সোশ্যাল মিডিয়া ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, “আমরা এখনই তাকে সরাচ্ছি না (হত্যা করছি না!), তবে আমাদের ধৈর্য শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

আরো পড়ুন:

তেহরানের ‘জেন জি’: আমার ঘরই আমার কবর হোক, তবু উদ্বাস্তু হয়ে বাঁচব না

মিডল ইস্ট আই-এর বিশ্লেষণ
‘সাম্রাজ্যবাদী দালাল’? ইরানের শাহপুত্রকে পাকিস্তানিরা কীভাবে দেখে

এই হুমকি এসেছে এমন এক সময়ে যখন ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের ইরানবিরোধী অভিযানকে মার্কিন বিমান ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করছে। এ পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) শিবিরের ভেতরে স্পষ্ট মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।

মাগা শিবিরে বিভাজন: যুদ্ধ না রেজিম চেঞ্জ?
রক্ষণশীল ভাষ্যকার টার্কার কার্লসন ও ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন, অন্য অনেক মাগা-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এই সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এটি শুধু ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের জন্য নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ‘রেজিম চেঞ্জ’ অর্থাৎ ইসলামী শাসনব্যবস্থা বদলানো।

ব্যাননের পডকাস্ট ওয়ার রুমে কার্লসন বলেন, “আপনি আমাকে কখনোই বোঝাতে পারবেন না যে ইরানিরা আমার শত্রু। এটা তো একেবারে ‘অরওয়েলিয়ান’। আমাকে আপনি বলে দিচ্ছেন কাকে ঘৃণা করতে হবে, আমি সেটা মানি না।”

ইরানের শাসকদের বিরোধিতা বনাম জনগণের প্রতি সহানুভূতি
পশ্চিমা বিশ্লেষক ও রাজনীতিকদের অনেকেই ইরানের বর্তমান শাসকদের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সমালোচনা করেন। তবে ইতিহাসে পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই হস্তক্ষেপ করেছে; ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের অনেক আগেই।

ইতিহাস: ইরানে পশ্চিমা রেজিম চেঞ্জের পদচিহ্ন
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’ নামক গোপন অভিযানের মাধ্যমে ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের পতন ঘটনা, যিনি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেছিলেন।

এরপর পশ্চিমা সমর্থিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ফের ক্ষমতায় আসেন, যার দমন-পীড়নই শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের জন্ম দেয়।

এই ইতিহাস পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি ইরানিদের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস জন্ম দিয়েছে; এমনকি যারা সরকারের সমালোচক, তারাও বাইরের হস্তক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করে।

ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য কী? ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ কী নির্দেশ করে?
শুক্রবার ইসরায়েল ইরানে যে সামরিক হামলা শুরু করেছে, তার কোডনেম দেওয়া হয়েছে ‘অপরাশেন রাইজিং লায়ন’। 

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইংরেজিতে এক ভিডিওবার্তায় ইরানি জনগণকে উদ্দেশ করে বলন, “আমি আশা করি এই সামরিক অভিযান আপনাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করবে।”

নেতানিয়াহুর এই বক্তব্য থেকে অনেকেই অনুমান করছেন ইসরায়েলের উদ্দেশ্য শুধু ইরানের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস নয়, বরং দেশটির শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করা এবং জনগণের অসন্তোষকে উসকে দিয়ে সরকার পতনের সম্ভাবনা তৈরি করা।

ইরানকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ ও প্রতীকবাদের লড়াই: ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ ও ট্রাম্পের হুমকি
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে নতুন মোড় নিতে শুরু করেছে। শুধু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নয়, এই যুদ্ধে লড়াই হচ্ছে ইতিহাস, প্রতীক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের ওপরও। ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক হুমকিতে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে।

‘রাইজিং লায়ন’: ইতিহাস ও প্রতীকের যুদ্ধ
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানে এই সামরিক অভিযান চালানোর লক্ষ্য হলো ইসলামি শাসনের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি প্রতিহত করা। তবে তিনি আরো বলেন, এই অভিযান ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর পথও উন্মুক্ত করতে পারে।

‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামটিও নিছক কৌশলগত নয়; এটি এক ঐতিহাসিক প্রতীকের উল্লেখ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সিংহ ও সূর্য ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী প্রতীক।

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের আগে সিংহ-তলোয়ার সম্বলিত পতাকা ছিল ইরানের জাতীয় পতাকা, যা পাহলভি রাজবংশের শাসনকাল পর্যন্ত ব্যবহার হতো।

শুক্রবার নেতানিয়াহু ইংরেজিতে ইরানিদের উদ্দেশে বলেন, “এখন সময় এসেছে ঐতিহাসিক পতাকার চারপাশে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং এক নির্মম ও দমনমূলক শাসন থেকে স্বাধীনতার জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়ার।”

প্রতীকী হামলা: সিংহ দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পতাকা বিদ্ধ
ইসরায়েলের পারস্য-ভাষী সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে ১৭ জুন একটি চিত্র পোস্ট করা হয়, যেখানে দেখা যায় একটি সিংহ একটি তলোয়ার দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পতাকা বিদ্ধ করছে।

এটি অনেকেই দেখেছেন বিপ্লব-পূর্ব ইরানের প্রতি ইঙ্গিত, যেন ইরানিদের মধ্যে নস্টালজিয়া জাগিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন উস্কে দেওয়া যায়।

তবে কাতারের নর্থওয়েস্টান ইউনিভার্সিটির গণমাধ্যম বিশ্লেষক মার্ক ওয়েন জোনস বলেন, “ইসরায়েলি রাজনীতিকরা সিংহের গুরুত্ব নিয়ে যা বলছেন, তাতে ইরানিরা প্রভাবিত হবে; এমন ভাবাটা একেবারেই সরল দৃষ্টিভঙ্গি।”

জোনস আরো বলেন, “ইসরায়েলের এই বার্তাগুলো দেশীয় শ্রোতা-দর্শকের জন্যও তৈরি করা, যেন তারা ‘নিজেদের সিংহ হিসেবে কল্পনা করে এবং তারা যেন ভাবে তারা ‘পবিত্র ভূমি’ দখল করছে।”

ট্রাম্প কী বলছেন খামেনিকে নিয়ে?
যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রেজিম চেঞ্জ’ ঘোষণা করেননি, তবে তিনি কার্যত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনিকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।

বুধবার হোয়াইট হাউস লনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “আমরা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ চাই।”

ট্রাম্প আরো বলেন, “৪০ বছর ধরে ওরা বলে আসছে, আমেরিকার মৃত্যু হোক! ইসরায়েলের মৃত্যু হোক! যাকে পছন্দ করে না, তার মৃত্যু হোক! তারা ছিল স্কুলের বুলিদের মতো। আর এখন তারা আর বুলির মতো নেই।”

তিনি শেষ করেন এই বলে যে, “আমরা কোনো যুদ্ধবিরতি চাই না। আমরা চাই ‘পুরোপুরি জয়’। আপনি জানেন ‘জয়’ কী? কোনো পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে না।”

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাঠানো এসব বার্তা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, মনের ভেতরে যুদ্ধ চালানোর প্রচেষ্টাও বটে। তবে ইতিহাস বলছে, বাইরের প্রতীক বা হুমকি নয়, ইরানের পরিবর্তন যদি আসে, সেটা আসবে জনগণের ভেতর থেকে, তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা থেকে।

পশ্চিম কি অতীতে ইরানে রেজিম চেঞ্জ ঘটিয়েছে? সংক্ষেপে উত্তর, “হ্যাঁ।”

ইতিহাসে ইরানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৫৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থান, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে।

১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, যিনি ইরানি তেল শিল্পকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় ইরানের তেল শিল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ মালিকানাধীন অ্যাংলো-ইরানিয়ান ওয়েল কোম্পানি (বর্তমানে বিপি) হাতে। 

জ্বালানি তেল শিল্পকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ইরানে বিপুল জনপ্রিয়তা পেলেও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবল অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

এ সময় ছিল ঠাণ্ডা যুদ্ধের শীর্ষকাল এবং ওয়াশিংটনে উদ্বেগ ছিল যে, মোসাদ্দেক হয়তো সোভিয়েত ঘেঁষা হতে পারেন।

অপারেশন অ্যাজাক্স: রেজিম চেঞ্জের ক্লাসিক উদাহরণ
এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং ব্রিটিশ এমআই-৬ মিলে শুরু করে একটি গোপন অভিযান, যার কোডনেম ছিল ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’।

অপারেশন অ্যাজাক্সের মূল কার্যক্রম ছিল, অর্থ দিয়ে ভুয়া বিক্ষোভ সংগঠিত করা ও স্থানীয় সংবাদপত্রে মিথ্যা প্রচার চালানো এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ইরানের শাহপন্থি সেনা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটানো। 

১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট এই ষড়যন্ত্র সফল হয়। মোসাদ্দেক ক্ষমতাচ্যুত হন।

ইরানের তৎকালীন রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, যিনি অল্প সময়ের জন্য দেশ ছেড়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানে ফেরেন এবং পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

এই অভ্যুত্থান ইরানসহ গ্লোবাল সাউথের বহু দেশের কাছে পশ্চিমা ভণ্ডামির উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে প্রমাণিত হয়ে যায়, তেলের জন্য এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে গণতন্ত্রকেও ছুঁড়ে ফেলা যেতে পারে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালারা।

ইরানিদের চোখে ১৯৫৩ সালের ওই অভ্যুত্থান ছিল এক গভীর বিশ্বাসঘাতকতা, যার ফলে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবেও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

১৯৫৩ সালের মোসাদ্দেক-বিরোধী অভ্যুত্থান হলো ইরানে পশ্চিমা রেজিম চেঞ্জের প্রামাণ্য ইতিহাস। আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল যখন ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা ‘পুরোপুরি বিজয়ে’র কথা বলে, ইরানের জনগণ ও নেতৃত্ব তাদের ঐতিহাসিক ব্যথা ও অভিজ্ঞতা থেকেই প্রতিক্রিয়া জানায়।

এই ইতিহাস আজও ইরানের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব এবং পশ্চিমের প্রতি অবিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি করে রেখেছে।

১৯৫৩ সালের পর কী ঘটেছিল?
মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে ১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থানের পর ইরানে মোহাম্মদ রেজা পাহলভি পুনরায় ক্ষমতায় আসেন এবং হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে তার শাসন একসময় চরম দমন-পীড়ন ও বৈষম্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

সাদা বিপ্লব
ষাটের দশকে শাহ একগুচ্ছ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করেন, যাকে বলা হয় হোয়াইট রেভ্যুলিউশন  বা সাদা বিপ্লব। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ভূমি সংস্কার, নারীদের ভোটাধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা সীমিতকরণ।

এই সংস্কারগুলো ছিল ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া, জনগণের অংশগ্রহণ বা মতামতের ভিত্তিতে নয়। এতে কিছু মধ্যবিত্ত উপকৃত হলেও ধর্মীয় নেতা ও দরিদ্র জনগণ ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন।

সাভাক: গোপন পুলিশ ও দমননীতি
শাহের শাসনে সাভাক নামে এক ভয়ংকর গোপন পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধীদের যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, পত্রিকা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ, নির্যাতন ও গুপ্ত হত্যার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে ওঠে। এই দমন-পীড়ন সারা দেশে ভয় ও রোষের পরিবেশ সৃষ্টি করে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিদেশ নির্ভরতা
যদিও কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল, তবে এর সুফল কেবল একটি ক্ষুদ্র এলিট শ্রেণি ভোগ করতো। গরিব ও গ্রামাঞ্চলের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন শাহ। আর পশ্চিমা কোম্পানি ও মার্কিন সরকারের প্রতি তার অনুগত আচরণ জাতীয় গর্বে আঘাত হানে। 

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক: বিপ্লবের সূচনা
দমন, বৈষম্য এবং ধর্মীয় অবমাননার প্রতিবাদে সারা দেশে গণ-আন্দোলন শুরু হয়। মাসব্যাপী ধর্মঘট, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে দেশ অচল হয়ে পড়ে। এই সময়ে বহু মানুষ নিহত হন কিন্তু দমন ব্যর্থ হয়। শাহ ক্রমাগত জনসমর্থন হারান।  

শাহর পলায়ন ও ইসলামী বিপ্লব
১৯৭৯ সালের জানুয়ারি, ইরান ছেড়ে পালিয়ে যান শাহ। এরপর আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ১৫ বছরের নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে আসেন এবং বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ইরানে রাজতন্ত্র ধ্বংস হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান, যেখানে ধর্মীয় নেতা (সর্বোচ্চ নেতা) রাজনীতির কেন্দ্রে আসেন।

খোমেনির মৃত্যু, উত্তরাধিকার খামেনি ও যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি
ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি দীর্ঘ অসুস্থতার পর ১৯৮৯ সালে হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুর পর তখনকার ইরানের দ্বিতীয় নেতা সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, যিনি এর আগে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

খামেনি ১৯৮৯ সালের ৪ জুন থেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদে আছেন, যা তাকে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

খামেনির প্রতিক্রিয়া: ‘এই জাতি কখনো আত্মসমর্পণ করবে না’
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণের পর প্রথম টেলিভিশন ভাষণে খামেনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

ট্রাম্পের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ চাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় খামেনি বলেন, “এই দাবিটি অহংকারপূর্ণ এবং অগ্রহণযোগ্য। এই জাতি কখনো আত্মসমর্পণ করবে না। আমেরিকার জানা উচিত, যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপের ফলাফল হবে অপূরণীয় ক্ষতি।”

ট্রাম্পের জবাব: ব্যঙ্গাত্মক ‘শুভকামনা’
এই বক্তব্যের কিছুক্ষণের মধ্যেই হোয়াইট হাউসের লনে দাঁড়িয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি সাংবাদিকদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, “আমি বলি, শুভকামনা।”

এক বাক্যের প্রতিক্রিয়াটি অনেকের কাছে ব্যঙ্গাত্মক ও উস্কানিমূলক মনে হয়েছে।

খামেনির হুঁশিয়ারি ও ট্রাম্পের উপহাসসূচক মন্তব্য ইঙ্গিত দেয়, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখন শুধু কূটনৈতিক নয়, চরম ব্যক্তিগত পর্যায়েও পৌঁছেছে। উভয় নেতা নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনগণকে চরমপন্থার দিকে উসকে দিচ্ছেন, যার ফলে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে।

খামেনির মন্তব্য ও ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এই সংঘাত কেবল অস্ত্রের নয়; মনস্তত্ত্ব, প্রতীক, অহংকার এবং শক্তির লড়াই। এই প্রেক্ষাপটে একটি ভুল পদক্ষেপ বা উস্কানি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার ফলাফল হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ও ভয়াবহ।

ঢাকা/রাসেল

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল ম হ ম মদ ম স দ দ ক ও য ক তর ষ ট র য ক তর ষ ট র ও য ক তর ষ ট র র ও য ক তর জ য ১৯৫৩ স ল র ১৯৭৯ স ল র আয় ত ল ল হ ইসর য় ল র স ব ধ নত র জন ত ক জনগণ র র জনগণ ন র ইজ র জন য আম র ক ন র জন সরক র ইসর য গ রহণ ইসল ম ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন ১৮ কোটি মানুষের দাবি: জামায়াত

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন দেশের ১৮ কোটি মানুষের দাবি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, এই সনদ নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে, আর প্রয়োজনে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। তবে তা অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই হতে হবে।

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। আলোচনায় জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদও উপস্থিত ছিলেন।

আরো পড়ুন:

হবিগঞ্জে আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

৩ দাবিতে জাস্টিস ফর জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলন

রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে। ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনের পর দলগুলোর ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সময়মতো বাস্তবায়ন হয়নি। পরে আন্দোলনের মাধ্যমে তা সংবিধানে যুক্ত হয়।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে বিচারপতি খায়রুল হকের প্রভাবিত রায়ের মাধ্যমে। জামায়াত মনে করে, বিচার বিভাগকে বিতর্কের মুখে না ফেলে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।

হামিদুর রহমান আযাদ জানান, ঐকমত্য কমিশনের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি চারটি বিকল্প প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে সংবিধানিক আদেশের প্রস্তাবটিই সবচেয়ে শক্তিশালী। এই আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের ২২টি আর্টিকেল বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মত দেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষমতা সংসদের নেই। এ জন্য গণভোট প্রয়োজন। জনগণের ইচ্ছাই দেশের সর্বোচ্চ আইন।

ডাকসু নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণকে উদাহরণ হিসেবে টেনে তিনি বলেন, তরুণ সমাজ এখন নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে এবং জুলাই বিপ্লবের চেতনার সঙ্গেই তারা একাত্ম।

ঢাকা/এএএম/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা জরুরি
  • জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিসহ কয়েকটি দাবিতে রাজধানীতে সাত দলের বিক্ষোভ-সমাবেশ
  • চট্টগ্রামে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর যৌথ মহড়ায় ‘ইনক্যাপ সিরিমনি’
  • পিআরেরও দু–একটা সাইড এফেক্ট আছে, কিন্তু অধিকাংশই ভালো দিক: ইসলামী আন্দোলন
  • আস্থা রাখতে চাই, ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে: টুকু
  • ‘আমরা ভুগছি আর রাজনীতিবিদেরা ধনী হচ্ছেন, তাই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকার ফেলে দিয়েছি’
  • জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন ১৮ কোটি মানুষের দাবি: জামায়াত
  • পটুয়াখালীতে সালিস বৈঠকে অংশ নিলে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিএনপি
  • রোহিঙ্গা সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে
  • জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ