সংস্কারের নামে দেশে নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান। তিনি বলেন, ‘চাল, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। চারদিকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। আমরা মনে করি, অতি শিগগির একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের মাধ্যমেই মানুষের মৌলিক অধিকার, সামাজিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।’

আজ সোমবার দুপুরে নোয়াখালীর হাতিয়া এ এম উচ্চবিদ্যালয় মাঠে দেশবিরোধী অপতৎপরতা রুখতে ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি আয়োজিত জনসমাবেশে এ কথাগুলো বলেন মাহবুবের রহমান। হাতিয়া উপজেলা বিএনপি এই জনসমাবেশের আয়োজন করে।

সমাবেশে উপস্থিত দলীয় নেতা-কর্মী ও সমবেত জনতার উদ্দেশে মাহবুবের রহমান বলেন, ‘আমাদের নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা রাজপথে ছিলাম বলেই গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আজকের এই স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ কারও একক অর্জন নয়, এটা বাংলাদেশের আপামর মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে।’

মাহবুবের রহমান বলেন, ২০২৪-এর স্বৈরাচারমুক্ত আন্দোলনে বিএনপির ৪২২ নেতা-কর্মী শাহাদাতবরণ করেছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা গত ১৭ বছরে গুম-খুন, হামলা, মামলা ও নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁর বাবার মতো বাকশাল কায়েম করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলার আপামর মানুষ একটি সুসংগঠিত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তা নস্যাৎ করে দিয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সমাবেশে মাহবুবের রহমান বলেন, পতিত স্বৈরাচারের দোসররা বিগত সময়ে এত অপকর্ম করার পরেও তারা এখনো প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, অনতিবিলম্বে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে হাতিয়ার সাধারণ মানুষ এর কঠিন জবাব দেবে।

মাহবুবের রহমান আরও বলেন, ‘হাতিয়া একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল, কিন্তু এখানকার সাধারণ মানুষের জনদুর্ভোগের শেষ নেই। যাতায়াতের জন্য ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। ভালো কোনো হাসপাতাল নেই। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, বাংলাদেশের মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে হাতিয়া হবে একটি পর্যটন এলাকা। এখানকার জলপথ ও স্থলপথের যাতায়াতব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হবে। এ ছাড়া যেসব এলাকায় নদীভাঙন রয়েছে, সেখানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। হাতিয়াবাসীর বাণিজ্যিক উন্নয়নের জন্য এখানে একটি নৌবন্দর করা হবে। হাতিয়ার মানুষ চিকিৎসার জন্য যাতে মাইজদী ও ঢাকা না যাওয়া লাগে, সে জন্য উন্নত মানের হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে।’

উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এ কে এম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে জনসমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন হাতিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দীন চৌধুরী, সভাপতি আলা উদ্দিন, সাবেক আহ্বায়ক শওকত হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক লিচানুল আলম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা কাদের হালিমী, হাতিয়া পৌরসভা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোকাররম বিল্লাহ, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মোজাম্মেল হোসেন ওরফে আজাদ প্রমুখ।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

‘সেবার রাজনীতি’ যেভাবে ‘খয়রাতি মন’ তৈরি করে

উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে ছাত্র সংসদ (ডাকসু ও জাকসু) নির্বাচনের পর দেশজুড়ে নাগরিক সমাজে অনেক ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। যে বিতর্কগুলো জাতীয় নির্বাচনের বেলায়ও প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সে জন্য সমাজে এসব আলোচনা হওয়া দরকার আছে।

সব বিতর্ক একসঙ্গে আলোচনায় না এনে আলাদাভাবে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে পারি আমরা। যেমন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দান-অনুদানের কদর ও নির্বাচনে তার প্রভাব নিয়ে কথা হচ্ছে। আপাতত এ বিষয় এবং এর রাজনৈতিক–অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে পারি আমরা।

ডাকসু, জাকসু ও রাকসু হলো শিক্ষার্থীদের ইউনিয়ন। পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর–কষাকষি করে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস জীবন স্বস্তিকর করাই এসব ইউনিয়নের প্রকৃত লক্ষ্য। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাত্রদের দাবিদাওয়া আদায় করে দেওয়াই ছাত্র সংসদের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থায় সংসদের বিধান সে জন্যই রাখা হয়েছে। এটা অনেকটা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ‘সিবিএ’র মতো।

কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে একাধিক শ্রমিকসংগঠন থাকতে পারে; কিন্তু শ্রমিকেরা তাদের মধ্য থেকে কালেকটিভ বার্গেনিং এজেন্ট বা সিবিএ হিসেবে বেছে নেয় কয়েকজন কর্মীকে। ডাকসু, জাকসু ও রাকসুতেও শিক্ষার্থীদের তা–ই করার কথা।

ডাকসু, জাকসু ও রাকসুর কাজ হলো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেওয়া। এখন প্রশ্ন হলো ইউনিয়ন নেতৃত্ব যদি সরকার, রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দাবিদাওয়া আদায়ের বদলে নিজেরাই ভিন্ন কোনো উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের জন্য সেবা ও সুবিধা বাড়াতে চেষ্টা করে, তাহলে সমস্যা কী? এর কি বিশেষ কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনী অধ্যায়ের পূর্বাপর অনুসন্ধান করে অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলছেন, বিদ্যাপীঠগুলোতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি বাছাইয়ের নির্বাচনে দান-অনুদানে যুক্ত সংগঠন ও প্রার্থীরা ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর–কষাকষির চেয়ে নিজেরাই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব কিছু পদক্ষেপ নিয়ে সেবাধর্মী সংগঠনগুলো বাড়তি ভোট পেয়েছে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প থেকে শুরু করে হলে পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র বসানো পর্যন্ত অনেক কাজ করছে কোনো কোনো সংগঠন। তাদের বক্তব্য, শিক্ষার্থীরা এসব কাজ পছন্দ করছেন। তাঁরা এরকম দান-অনুদানে যুক্তদের ভোটে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে।

এ রকম যুক্তি ও অনুমান যেহেতু অনেকের কাছে বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, সেই কারণে এই  সিদ্ধান্তে আসাও সহজ হয় যে অতীতে শিক্ষার্থীরা যেসব বিষয় দেখে নেতৃত্ব পছন্দ করতেন, এখনকার পছন্দের মানদণ্ড তার চেয়ে ভিন্ন।

এর ফল হিসেবে পরের অধ্যায় অনুমান করা কঠিন নয়। জাতীয়ভাবেও হয়তো অনেক সংগঠন এখন দান-খয়রাতধর্মী সেবামূলক কাজের দিকে বেশি ঝুঁকবে। সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন তো উঠতে পারে, ক্যাম্পাসে হোক বা অন্যত্র হোক, এসব সেবাধর্মী কাজের খরচ কারা জোগান দেবে বা দিচ্ছে?

শিক্ষার্থীদের পক্ষে ওয়াশিং মেশিন কিনে হলগুলোর তলায় বসানো সম্ভব নয়। হঠাৎ হঠাৎ গরু কিনে জিয়াফত আয়োজনও সহজ নয়। তাহলে নিশ্চয়ই বাইরের কোনো উৎস থেকে তারা এই অর্থ পাচ্ছে বা নিচ্ছে।

শত শত শিক্ষার্থীকে ইফতার করানো বা উপঢৌকন দেওয়াও বাইরের আর্থিক–সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। তার মানে এ ধরনের সেবাধর্মী তৎপরতা শুধুই ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিশুদ্ধ কোনো বিষয় নয়। এর ক্যাম্পাস–বহির্ভূত একটি অন্তর্জাল অবশ্যই আছে; কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের এত অন্তর্জাল খোঁজার ‘টাইম নেই’। সুবিধাটা নগদ নগদ তাঁরা পছন্দ করছেন।

সেবাধর্মী রাজনীতির একটি অনিবার্য পার্শ্বফল হলো সামাজিক বৈষম্য আড়াল হওয়া। সমাজে সম্পদের যে অসম বণ্টন এবং পুঁজির শোষণ রয়েছে, দানের রাজনীতি তাকে ন্যায্যতা ও স্বাভাবিক চেহারা দেয়। দারিদ্র্য ও যাবতীয় সামাজিক দুর্দশা যে একটি কাঠামোগত সমস্যা, সেটি আড়াল করে তথাকথিত এই ‘সেবা’।

যেমন এখন ঢাকা শহরে গণপরিবহনের স্বল্পতা একটি বিশাল সমস্যা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও খোদ রাজধানীতে সে রকম কোনো স্বস্তিকর ব্যবস্থা কোনো সরকার করতে পারেনি বা করেনি। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-দুঃখ আছে। এখন কোনো রাজনৈতিক দল বা তার ছায়ায় পুষ্ট কোনো ‘সামাজিক সংগঠক’ যদি ঢাকায় বিনা মূল্যে ১০০ বাস নামায়, তাতে সাধারণ মানুষ খুব খুশি হবেন।

এ রকম খরচ ও সেবার একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতি থাকতে পারে। নিদেনপক্ষে এর মাধ্যমে সমাজে মতাদর্শিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা তো থাকবেই; কিন্তু বিপন্ন মানুষ, নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের অত কিছু খেয়াল করলে চলে না। যে দল বা সংগঠন এ রকম সেবা দেবে, তারা ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান বা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে, সেটি ভাবার চেয়ে মানুষ দ্রুততার সঙ্গে ওই সেবা নেবেন এবং সেবাদানকারীও তাঁদের পছন্দনীয় হয়ে উঠবে।

এ রকম আরও সেবাদানকারী তখন এগিয়ে আসতে পারে এ রকম কাজে। কারণ ‘পছন্দ’ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে অনেক লোভনীয় জিনিস; কিন্তু তাতে গণপরিবহন–ব্যবস্থার দাবি খুব একটা এগোবে না। একাধিক দল একই সেবা দিতে নামলে ওই দাবি বরং হারিয়ে যাবে।

আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন, ফলাফল ও তরুণ মনের চাওয়া১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কিন্তু এ রকম মডেল রাষ্ট্রের খুব পছন্দ; অন্যান্য ‘কর্তৃপক্ষের’ও পছন্দ। সমাজে দারিদ্র্য কমানো, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা, বৈষম্য হ্রাস করা, শিক্ষার অধিকার কিংবা স্বাস্থ্যসুবিধা বাড়ানোর দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে এসব বিষয়ে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যেই। আর সরকার গঠিত হয় রাষ্ট্রের সেসব দায় বাস্তবায়নের জন্য।

কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র বা বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র সেসব দায়িত্ব মেটাতে পারছে না। তাতে জন–অসন্তোষ আছে। এ ধরনের রাষ্ট্রে নাগরিকেরা বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইতে পারেন। সে অবস্থায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ‘বিকল্প’ হিসেবে সেবাধর্মী কাজ, দান, অনুদান ও খয়রাত রাষ্ট্রের জন্য একটি ভালো ডিফেন্সলাইন। এতে রাষ্ট্রের গায়ে ক্ষোভের আঁচড় কম লাগে। প্রশাসন তার ব্যর্থতা আড়াল করতে পারে।

যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খাবারের মান ও পরিমাণ বাড়ানো দেশের সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এটা রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দের অগ্রাধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন এমন হতে পারে ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে শক্তিশালী কোনো সংগঠন তাদের মূল দল বা দেশ-বিদেশের সহযোগী বন্ধুদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ এনে নিজেরাই হলে হলে বাড়তি খাবার সরবরাহ করল। এটা শিক্ষার্থীরা খুব পছন্দ করবে। আবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রও খুব পছন্দ করবে।

কেবল ক্যাম্পাসে নয়, কয়েক বছর ধরে গ্রামাঞ্চলেও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধে৵ কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন এভাবে ‘দরিদ্রবান্ধব সেবাধর্মী কাজ’ করছে। জাতীয় নির্বাচন হলে তারও চমকপ্রদ কিছু ফল দেখব আমরা। এ রকম সবকিছুর প্রাপ্তি হিসেবে সেবাধর্মী দান-অনুদানের একটি প্রতিযোগিতাও হয়তো দেখব আমরা চারদিকে। এতে জনসমাজে পদ্ধতিগত বঞ্চনার রাষ্ট্রীয় সমাধানের দাবি ক্রমে অবলুপ্ত হতে বাধ্য। এ রকম সমাধানচিন্তার প্রস্তাবকারীদেরও স্বভাবত সামনে দুর্দিন।

এ রকম আর্থসামাজিক অবস্থা রাষ্ট্রের জন্য একটি সুযোগের মতো। ক্ষমতার রাজনীতিতে উচ্চ আকাঙ্ক্ষী ধনাঢ্য সমাজের জন্যও অনুরূপ। জনসমাজ সেবা পেয়ে খুশি থাকলে শিক্ষা খাত বা স্বাস্থ্য খাতে ব্যায় না বাড়িয়ে বাড়তি টাকা রাষ্ট্র সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র শক্তিশালী করায় বিনিয়োগ করতে পারে। এতে ‘রাষ্ট্র’ ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে এবং সমাজের পুরোনো অধিকারবাদী, পরিবর্তনবাদী রাজনীতিকেও কোনঠাসা করতে পারে।

সেবাধর্মী রাজনীতিতে রাষ্ট্রের লাভ তাই দ্বিবিধ। ফলে আন্তরিকভাবেই এ রকম ‘কাজ’ রাষ্ট্রের সব ‘কর্তৃপক্ষের’ সমর্থন, সহায়তা ও সহযোগিতা পায় ও পাবে। সব দেশে সেটিই হয়। কারণ, একদিকে এতে সব ‘কর্তৃপক্ষের’ সুরক্ষা বাড়ে। অন্যদিকে এতে তাদের শক্তিও বাড়ে। কুলীন সমাজ এ রকম রাষ্ট্রকে দিয়ে খুব সহজে কর্তৃত্ববাদী একটি শাসনও কায়েম করতে পারে।

আরও পড়ুনশিবিরের এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে সুবিধা দেবে কি২০ ঘণ্টা আগে

কুলীন সমাজ ও করপোরেটদের জন্য দান-অনুদান কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক সুবিধা রাষ্ট্রের মতোই ব্যাপক ও সম্পূরক। সে বিষয়েও দু–চার কথা বলা দরকার।

সেবাধর্মী রাজনীতির একটি অনিবার্য পার্শ্বফল হলো সামাজিক বৈষম্য আড়াল হওয়া। সমাজে সম্পদের যে অসম বণ্টন এবং পুঁজির শোষণ রয়েছে, দানের রাজনীতি তাকে ন্যায্যতা ও স্বাভাবিক চেহারা দেয়। দারিদ্র্য ও যাবতীয় সামাজিক দুর্দশা যে একটি কাঠামোগত সমস্যা, সেটি আড়াল করে তথাকথিত এই ‘সেবা’।

‘সেবার রাজনীতি’ জনসমাজকে এই বার্তাই দেয়—‘ধনাঢ্যরা কীভাবে আয় করছেন, রাষ্ট্র সম্পদের সুষম বণ্টনে ব্যর্থ কি না, সেসব দেখার দরকার নেই তোমার। বৃহত্তর সমাজের কথা বাদ দাও। ধনাঢ্যরা তোমাকে যা দিচ্ছেন, তাতে তোমার ভালোই চলে যাবে। তুমি এতে সন্তুষ্ট থাকো। শোকর করো এবং দাতাদের তোমার অভিভাবক হতে দাও।’

এভাবে সেবার পথে, অধিকারবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিনা যুদ্ধে ধরাশায়ী করে কুলীন সমাজ রাষ্ট্র ও রাজনীতির অভিভাবকত্ব পায়। তবে এ রকম ‘সেবাবাদ’ দুইভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষতি করে। রাষ্ট্রকে জনস্বার্থে সম্পদ বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় আরও ন্যায্য ও দক্ষ হতে বাধাগ্রস্ত করে এটা। জনগণের তরফ থেকে এ লক্ষ্যে চাপ কমতে থাকায় রাষ্ট্র ক্রমে একটি ক্ষুদ্র সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর নিজস্ব হাতিয়ারে পরিণত হয়। গুটিকয়েকের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবনকে তখন সমস্যা মনে করা হয় না। এতে রাষ্ট্রের ভেতর সমান্তরাল অর্থনৈতিক বিকাশ সীমিত থেকে যায়।

দ্বিতীয়ত সমাজ ও রাষ্ট্রকে অধিকতর সুষম ও ন্যায়ানুগ করার ক্ষেত্রে জনসমাজের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও আইনি অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত করে দান-অনুদান মডেল। সুবিধাবঞ্চিত সমাজ যেহেতু বাস্তব কারণে সেবা-দান-অনুদান অগ্রাহ্য করতে পারে না; বরং এটা পাওয়ার জন্য ন্যায্য ভিন্নমতও চেপে যায়, সে কারণে এই মডেল গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশও রুদ্ধ করে।

এটা জনসমাজে সৃষ্টিশীল উদ্যমের বদলে ‘খয়রাতি মন’ তৈরি করে চলে, বিশেষ করে সুবিধাগ্রহীতাদের মধ্যে। এ অবস্থায় মানুষ ভাবতে শুরু করে—তার বা তাদের অবস্থার পরিবর্তন বাইরের কোনো শক্তির দয়াদাক্ষিণ্যনির্ভর। নিজেরা বা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান অবস্থার বদলে সক্ষম নয়। তাদের সে রকম লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ারও দরকার নেই। এ রকম মনোভাব সহজে সুবিধাপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাবানদের পুরোনো কর্তৃত্ব ও শক্তিকে উৎপাদন-পুনরুৎপাদন হতে সহায়তা করে চলে।

‘সেবা-মডেল’ সমাজের ক্ষমতা-সম্পর্ক অপরিবর্তনশীল করে রাখতে চায় এবং সেবার আদলে নতুন ধরনের একটি উপনিবেশ-সংস্কৃতি জারি করে ও তাকে প্রতিমুহূর্তে প্রয়োজনীয় মনে করায়। ‘সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিরা’ এতে চিরকাল নির্ভরশীল ও অপরের মুখাপেক্ষী থেকে যায় এবং তাঁদের দেশের ‘প্রতিষ্ঠানগুলো’র প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়নও আর হয় না। এতে সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণের বদলে ‘সুবিধা’ পাওয়ার সর্বব্যাপক আকুতি দেখা দেয়। এসব বিবেচনায় সমাজে ‘সেবা’ বিশেষ ধরনের একটি রাজনৈতিক বিনিয়োগ এবং নিশ্চিতভাবে কৌশলগত ও হেজিমনিক বিনিয়োগও বটে।

আলতাফ পারভেজ, গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদের দেয়ালে ট্রাম্প-এপস্টেইনের ছবি প্রদর্শন, গ্রে
  • ‘সেবার রাজনীতি’ যেভাবে ‘খয়রাতি মন’ তৈরি করে