শান্তি নিয়ে তোড়জোড়ের মধ্যে ইউক্রেন যেভাবে যুদ্ধে মাটি হারাচ্ছে
Published: 14th, January 2025 GMT
হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ইউক্রেন আসন্ন মাসগুলোর জন্য কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দীর্ঘ ফ্রন্টলাইনের কয়েক জায়গায় রাশিয়ার সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে ইউক্রেনের সেনাদের পিছু হটতে হচ্ছে। যুদ্ধ করার মতো অভিজ্ঞ সেনার ঘাটতি যেমন আছে, আবার সামনের দিনগুলোতে এখনকার মতো সামরিক সহায়তা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
কিয়েভে জেলেনস্কি সরকার মস্কো ও ওয়াশিংটনের দিক থেকে কোন সংকেত আসে, তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। প্রায় প্রতিদিনই একটা ‘ন্যায্য শান্তির’ আকাঙ্ক্ষার কথা তারা পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। রাশিয়ার কাছ থেকে দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধারের চিন্তা অনির্দিষ্টকালের জন্য থেমে গেছে।
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও রুশ বাহিনী নির্বিকারভাবে দোনেৎস্ক অঞ্চলে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চলকে রাশিয়া অবৈধভাবে নিজেদের অংশ বলে ঘোষণা দিয়েছে তার একটি হলো দোনেৎস্ক। রাশিয়া সেটিকে পুরোপুরি দখলে নেওয়ার জন্য এগোচ্ছে।
রুশ বাহিনী ফসলের মাঠ ও রাস্তা দখল করতে করতে দোনেৎস্কের শিল্পাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
উন্মুক্ত উৎস ওয়ারম্যাপারের তথ্য অনুযায়ী, ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক, লুহানস্কসহ ইউক্রেনের মাত্র ১৮ শতাংশ জায়গা দখল করেছে। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসে রাশিয়া ইউক্রেনের ৪৫০ বর্গকিলোমিটার ভূমি দখলে নিয়েছে।
পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনের ইউনিটগুলোর সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। এ সপ্তাহে একজন কমান্ডার বলেছেন, রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো দিক থেকে যেভাবে গোলাবর্ষণ করছে, তাতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পক্ষে কেন্দ্রীভূত থেকে পাল্টা গুলি ছোড়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুদ্ধসংক্রান্ত ব্লগলেখক মিক রায়ান লিখেছেন, ‘কৌশলগত অস্ত্র, ড্রোন, দূরপাল্লার অস্ত্র—দুই পক্ষই প্রায় সমপর্যায়ের। কিন্তু মূল পার্থক্যটা হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জনবল।’
রুশ বাহিনী এখন পোকরোভস্ক শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। কুরাখোভ শহরের নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়ে নিয়েছে। তোরেতস্ক শহরের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে।
পোকরোভস্ক শহরের কাছে ইউক্রেনীয় ব্যাটালিয়নের কমান্ডার বলছেন, রুশ বাহিনী গোলাবর্ষণ ও গ্লাইড বোমার হামলা তীব্র করেছে।
ট্রাম্প নিজে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লড়াই বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু সম্প্রতি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি কত তাড়াতাড়ি এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারবেন, ‘আমি আশা করি ছয় মাস হবে। না, আমি মনে করি, আমি ছয় মাসের আগেই আমি এটা করতে পারব।’কিয়েভের এখনকার লক্ষ্য হচ্ছে, তাদের যেটুকু ভূখণ্ড নিজেদের রয়েছে, তার সুরক্ষা দেওয়া। গত সপ্তাহে জার্মানিতে ইউক্রেন ডিফেন্স গ্রুপের সভায় মিত্রদের উদ্দেশে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ বলেছেন, এই বছর ইউক্রেনের অগ্রাধিকার হবে ফ্রন্টলাইনকে স্থিতিশীল করা এবং এর প্রতিরক্ষার সক্ষমতা শক্তিশালী করা।
কন্টাক্ট গ্রুপের সদস্যরা গত তিন বছরে ইউক্রেনের জন্য ১২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি নিরাপত্তাসহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ সপ্তাহে অংশীদারেরা আরও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মধ্যে আগামী বছর ৩০ হাজার ড্রোন এবং আরও বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে।
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, ‘জোটের সবাইকে অবশ্যই সবকিছু নিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে হবে। ইউক্রেনের হাতকে দর–কষাকষির জন্য এতটা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে পুতিন একদিন তাঁর ভয়াবহ যুদ্ধ পরিসমাপ্তি ঘটাতে বাধ্য হন।’
এই ‘একদিন’ শব্দটিই জরুরি প্রশ্ন। অস্টিন বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন কোন পথে যাবে, তা নিয়ে আমি আগে থেকেই অনুমান করতে পারি না।’
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস এমনটা বলেছেন যে ট্রাম্প প্রশাসন কন্টাক্ট গ্রুপের সভাগুলোতে আসা বন্ধ করেও দিতে পারে। সেটা যদি ঘটে, তাহলে আমাদের বিকল্পভাবে এটা অব্যাহত রাখা দরকার হবে।’
সংঘাত অবসানের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হওয়া এখন সম্ভবপর বলে মনে হচ্ছে না। রাজনীতি বিজ্ঞানী আর্কাদি মোশেস ১৯ফর্টিফাইভে লিখেছেন, ‘কারণটা খুব সরল। মস্কো কোনো ধরনের সমঝোতার জন্য প্রস্তুত নয়। মস্কো জয়ের জন্য খেলছে, ড্রয়ের জন্য খেলছে না।’
মোশেস আরও বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে বা আলোচনার টেবিলে সফলতা পাওয়া যায়, তবে তা হতে হবে প্রশ্নাতীত। পুতিনের দৃষ্টিতে, ইউক্রেনকে পরাজয় বরণ করতে হবে এবং পশ্চিমকে ইউক্রেনের ও তার নিজস্ব পরাজয়কে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিতে হবে।’
ট্রাম্পের ইউক্রেন দূত নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক মার্কিন জেনারেল কেইথ কেলগ। গত সপ্তাহে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, ১০০ দিনের মধ্যে এ সংঘাত অবসানে একটা নিরেট ও টেকসই সমাধান করতে তিনি সক্ষম হবেন।
ট্রাম্প নিজে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লড়াই বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু সম্প্রতি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি কত তাড়াতাড়ি এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারবেন, ‘আমি আশা করি ছয় মাস হবে। না, আমি মনে করি, আমি ছয় মাসের আগেই আমি এটা করতে পারব।’
কিন্তু ক্রেমলিনের অপরবর্তনীয় লক্ষ্যের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পন কীভাবে মিলবে, সেটা স্পষ্ট নয়।
ফিউটুরা ডকট্রিনা ব্লগার রায়ান বিশ্বাস করেন, ‘যা–ই ঘটুক না কেন, পুতিন এটা নিশ্চিত করবেন, যাতে ১০০ দিনের (ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম ১০০ দিন ) উদ্দেশ্যটা ব্যর্থ হয়। তিনি ভাবছেন, যুদ্ধের গতি তাঁর হাতে। ফলে এখনই আলোচনার টেবিলে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা তাঁর নেই।’
ইউক্রেনের কাছে একটি শান্তিচুক্তি কী হলে গ্রহণযোগ্য হবে, তার কিছুটা ইঙ্গিত ভলোদিমির জেলেনস্কি শুক্রবার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সন্দেহাতীতভাবে আমাদের জনগণ ও দেশের জন্য একটা নিখাদ ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পক্ষে দাঁড়াব।’
জেলেনস্কির অগ্রাধিকার হচ্ছে, ইউক্রেন সমস্যাটি সরাসরি ট্রাম্পের হাতে তুলে দেওয়া। ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ইউক্রেন ‘সর্বোচ্চ স্তরে’ কথাবার্তা বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থান পরিষ্কার: ইউক্রেনের সবাই ইউক্রেনের জন্য ন্যায্য শর্তে যুদ্ধের অবস্থান চায়।’
টিম লিস্টার ও দারিয়া তারাসোভা-মার্কিনা সিএনএনের সংবাদকর্মী
সিএনএন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।