হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ইউক্রেন আসন্ন মাসগুলোর জন্য কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দীর্ঘ ফ্রন্টলাইনের কয়েক জায়গায় রাশিয়ার সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে ইউক্রেনের সেনাদের পিছু হটতে হচ্ছে। যুদ্ধ করার মতো অভিজ্ঞ সেনার ঘাটতি যেমন আছে, আবার সামনের দিনগুলোতে এখনকার মতো সামরিক সহায়তা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।

কিয়েভে জেলেনস্কি সরকার মস্কো ও ওয়াশিংটনের দিক থেকে কোন সংকেত আসে, তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। প্রায় প্রতিদিনই একটা ‘ন্যায্য শান্তির’ আকাঙ্ক্ষার কথা তারা পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। রাশিয়ার কাছ থেকে দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধারের চিন্তা অনির্দিষ্টকালের জন্য থেমে গেছে।

ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও রুশ বাহিনী নির্বিকারভাবে দোনেৎস্ক অঞ্চলে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চলকে রাশিয়া অবৈধভাবে নিজেদের অংশ বলে ঘোষণা দিয়েছে তার একটি হলো দোনেৎস্ক। রাশিয়া সেটিকে পুরোপুরি দখলে নেওয়ার জন্য এগোচ্ছে।

রুশ বাহিনী ফসলের মাঠ ও রাস্তা দখল করতে করতে দোনেৎস্কের শিল্পাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

উন্মুক্ত উৎস ওয়ারম্যাপারের তথ্য অনুযায়ী, ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক, লুহানস্কসহ ইউক্রেনের মাত্র ১৮ শতাংশ জায়গা দখল করেছে। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসে রাশিয়া ইউক্রেনের ৪৫০ বর্গকিলোমিটার ভূমি দখলে নিয়েছে।

পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনের ইউনিটগুলোর সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। এ সপ্তাহে একজন কমান্ডার বলেছেন, রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো দিক থেকে যেভাবে গোলাবর্ষণ করছে, তাতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পক্ষে কেন্দ্রীভূত থেকে পাল্টা গুলি ছোড়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুদ্ধসংক্রান্ত ব্লগলেখক মিক রায়ান লিখেছেন, ‘কৌশলগত অস্ত্র, ড্রোন, দূরপাল্লার অস্ত্র—দুই পক্ষই প্রায় সমপর্যায়ের। কিন্তু মূল পার্থক্যটা হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জনবল।’

রুশ বাহিনী এখন পোকরোভস্ক শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। কুরাখোভ শহরের নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়ে নিয়েছে। তোরেতস্ক শহরের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে।

পোকরোভস্ক শহরের কাছে ইউক্রেনীয় ব্যাটালিয়নের কমান্ডার বলছেন, রুশ বাহিনী গোলাবর্ষণ ও গ্লাইড বোমার হামলা তীব্র করেছে।

ট্রাম্প নিজে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লড়াই বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু সম্প্রতি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি কত তাড়াতাড়ি এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারবেন, ‘আমি আশা করি ছয় মাস হবে। না, আমি মনে করি, আমি ছয় মাসের আগেই আমি এটা করতে পারব।’

কিয়েভের এখনকার লক্ষ্য হচ্ছে, তাদের যেটুকু ভূখণ্ড নিজেদের রয়েছে, তার সুরক্ষা দেওয়া। গত সপ্তাহে জার্মানিতে ইউক্রেন ডিফেন্স গ্রুপের সভায় মিত্রদের উদ্দেশে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ বলেছেন, এই বছর ইউক্রেনের অগ্রাধিকার হবে ফ্রন্টলাইনকে স্থিতিশীল করা এবং এর প্রতিরক্ষার সক্ষমতা শক্তিশালী করা।

কন্টাক্ট গ্রুপের সদস্যরা গত তিন বছরে ইউক্রেনের জন্য ১২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি নিরাপত্তাসহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ সপ্তাহে অংশীদারেরা আরও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মধ্যে আগামী বছর ৩০ হাজার  ড্রোন এবং আরও বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে।

গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, ‘জোটের সবাইকে অবশ্যই সবকিছু নিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে হবে। ইউক্রেনের হাতকে দর–কষাকষির জন্য এতটা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে পুতিন একদিন তাঁর ভয়াবহ যুদ্ধ পরিসমাপ্তি ঘটাতে বাধ্য হন।’

এই ‘একদিন’ শব্দটিই জরুরি প্রশ্ন। অস্টিন বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন কোন পথে যাবে, তা নিয়ে আমি আগে থেকেই অনুমান করতে পারি না।’

জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস এমনটা বলেছেন যে ট্রাম্প প্রশাসন কন্টাক্ট গ্রুপের সভাগুলোতে আসা বন্ধ করেও দিতে পারে। সেটা যদি ঘটে, তাহলে আমাদের বিকল্পভাবে এটা অব্যাহত রাখা দরকার হবে।’

সংঘাত অবসানের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হওয়া এখন সম্ভবপর বলে মনে হচ্ছে না। রাজনীতি বিজ্ঞানী আর্কাদি মোশেস ১৯ফর্টিফাইভে লিখেছেন, ‘কারণটা খুব সরল। মস্কো কোনো ধরনের সমঝোতার জন্য প্রস্তুত নয়। মস্কো জয়ের জন্য খেলছে, ড্রয়ের জন্য খেলছে না।’

মোশেস আরও বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে বা আলোচনার টেবিলে সফলতা পাওয়া যায়, তবে তা হতে হবে প্রশ্নাতীত। পুতিনের দৃষ্টিতে, ইউক্রেনকে পরাজয় বরণ করতে হবে এবং পশ্চিমকে ইউক্রেনের ও তার নিজস্ব পরাজয়কে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিতে হবে।’

ট্রাম্পের ইউক্রেন দূত নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক মার্কিন জেনারেল কেইথ কেলগ। গত সপ্তাহে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, ১০০ দিনের মধ্যে এ সংঘাত অবসানে একটা নিরেট ও টেকসই সমাধান করতে তিনি সক্ষম হবেন।

ট্রাম্প নিজে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লড়াই বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু সম্প্রতি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি কত তাড়াতাড়ি এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারবেন, ‘আমি আশা করি ছয় মাস হবে। না, আমি মনে করি, আমি ছয় মাসের আগেই আমি এটা করতে পারব।’

কিন্তু ক্রেমলিনের অপরবর্তনীয় লক্ষ্যের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পন কীভাবে মিলবে, সেটা স্পষ্ট নয়।

ফিউটুরা ডকট্রিনা ব্লগার রায়ান বিশ্বাস করেন, ‘যা–ই ঘটুক না কেন, পুতিন এটা নিশ্চিত করবেন, যাতে ১০০ দিনের (ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম ১০০ দিন ) উদ্দেশ্যটা ব্যর্থ হয়।  তিনি ভাবছেন, যুদ্ধের গতি তাঁর হাতে। ফলে এখনই আলোচনার টেবিলে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা তাঁর নেই।’

ইউক্রেনের কাছে একটি শান্তিচুক্তি কী হলে গ্রহণযোগ্য হবে, তার কিছুটা ইঙ্গিত ভলোদিমির জেলেনস্কি শুক্রবার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সন্দেহাতীতভাবে আমাদের জনগণ ও দেশের জন্য একটা নিখাদ ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পক্ষে দাঁড়াব।’

জেলেনস্কির অগ্রাধিকার হচ্ছে, ইউক্রেন সমস্যাটি সরাসরি ট্রাম্পের হাতে তুলে দেওয়া। ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ইউক্রেন ‘সর্বোচ্চ স্তরে’ কথাবার্তা বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থান পরিষ্কার: ইউক্রেনের সবাই ইউক্রেনের জন্য ন্যায্য শর্তে যুদ্ধের অবস্থান চায়।’

টিম লিস্টার ও দারিয়া তারাসোভা-মার্কিনা সিএনএনের সংবাদকর্মী
সিএনএন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে

জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তাহলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে।

আজ সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি সভায়’ এই সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরে সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।

তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে। এসব সুপারিশ জমা দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আজ জরুরি বৈঠকে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ