টিউলিপ সিদ্দিককে কেন পদত্যাগ করতে হলো
Published: 15th, January 2025 GMT
১৯৯৬ সালে আমি বাংলাদেশের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর অর্থনৈতিক কৌশল নিয়ে আলোচনা করার জন্য ঢাকা সফর করি। এটি কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। তাঁর বিপরীতে তাঁর ছোট বোনের মেয়ে লেবার পার্টির দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক বরং আকর্ষণীয়।
খালার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জেরে তিনি শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন। শেখ হাসিনার প্রতি ন্যায্যতা দেখাতে বলতে হয়, তাঁর অস্বাভাবিক আচরণের পেছনে অজুহাত ছিল। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ফোকাসে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
ক্যারিশম্যাটিক বিপ্লবী নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দমনমূলক ও সমাজতান্ত্রিক শাসক হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি দল তাঁর বাসভবনে হামলা চালায় এবং তাঁকে সপরিবারে ১৭ সদস্যসহ গুলি করে হত্যা করে। সে সময় ২৭ বছর বয়সী শেখ হাসিনা ইউরোপ সফরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের লাগাম ধরেন।
শেখ হাসিনার প্রথম কার্যকাল পাঁচ বছর স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ পরপর চারটি নির্বাচনী বিজয়ের পর গত আগস্টে টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তবে এসব নির্বাচনী ফলাফলের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। রাস্তাজুড়ে গণবিক্ষোভের মুখে তাঁকে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হয়েছে। ওই আন্দোলনে প্রায় ২ হাজার মৃত্যু এবং ২০ হাজার লোক আহত হয়েছিল। তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে যান।
দুর্নীতি দমন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার সমুন্নত করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে শেখ হাসিনা সরে এসেছিলেন। একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক বলেছেন, তিনি বিভ্রান্তিকর বুদ্বুদে বাস করতেন।
ড.
ইস্যুটি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের জন্য দারুণ কোনো মুহূর্ত ছিল না। যদিও মন্ত্রীর মানদণ্ড-সংক্রান্ত স্বাধীন উপদেষ্টা দেখতে পেয়েছেন, টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রিত্বের শর্ত ভঙ্গ করেননি। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য সুনামগত ঝুঁকির ব্যাপারে তাঁর ও সরকার উভয়ের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’
এটা স্পষ্ট, টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান ঘটেছে। কিন্তু লেবার পার্টি ও কিয়ার স্টারমার তাঁকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এমনকি এখন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টিউলিপ যদি আবার সরকারে যোগ দিতে চান তাহলে ভবিষ্যতে তাঁর জন্য ‘দরজা খোলা থাকবে’। টিউলিপ ধারাবাহিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। খালার বিরুদ্ধে আনা কারসাজিতে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে টিউলিপ মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু তিনি কি প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচন, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিষয়ে শেখ হাসিনার খ্যাতির ব্যাপারে জানতেন না? তিনি কি খালার সহযোগীদের সম্পত্তি নিজের কাছে তুলে দেওয়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি?
এ ছাড়া টিউলিপ ও লেবার পার্টির কীভাবে অজানা থাকতে পারে যে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বের ১৭০ জনেরও বেশি বিশ্বব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘নিরবচ্ছিন্ন বিচারিক হয়রানি’ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছিলেন? কেবল বিশ্বাসপ্রবণ কেউ এটা ভাবতে পারে, টিউলিপ ও লেবার পার্টি শেখ হাসিনার দুর্নীতির ব্যাপারে জানত না। মুহাম্মদ ইউনূস টিউলিপকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘হয়তো আপনি হাসিনার দুর্নীতির ব্যাপারে বুঝতে পারেননি; কিন্তু এখন তা পেরেছেন। আপনার বলা উচিত– দুঃখিত, আমি এটা তখন জানতাম না। আমি এর জন্য লোকদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি এটা করেছি, আর সে কারণে পদত্যাগ করছি।’ টিউলিপ সিদ্দিক হয়তো ক্ষমা চাননি; তবে তিনি পদত্যাগ করে অন্তত বিলম্বে হলেও সঠিক কাজটি করেছেন।
ফ্রান্সিস পাইক: ইতিহাসবিদ; দ্য স্পেকটেটর থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য কর ছ ন র র জন
এছাড়াও পড়ুন:
পশ্চিমবঙ্গের চার শ্রমিককে বিদেশি বলে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা ভারতের
আসাম রাজ্যের পর গোটা ভারত থেকেই বাংলাদেশি বলে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো (পুশইন) হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তা–ই নয়, প্রমাণের অভাবে আবার তাঁদের অনেককে ফিরিয়েও আনতে হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চল থেকে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গেরই সংবাদমাধ্যম।
দক্ষিণ ও মধ্য বাংলার দুই জেলা বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের চার পরিযায়ী শ্রমিক মহারাষ্ট্রে কাজ করতে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে মহারাষ্ট্র পুলিশ তাঁদের ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে তুলে দেয়। এরপর বিএসএফ তাঁদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। এ চারজনই আবার মুসলমান।
মুম্বাইয়ে কাজ করতে যাওয়া মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের এই চার পরিযায়ী শ্রমিককে মহারাষ্ট্র পুলিশ বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়। কোনো রকম যাচাই না করেই তাঁদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয় বিএসএফ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজ্য পুলিশের উদ্যোগে গতকাল রোববার বিকেলে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) কাছ থেকে ওই তিন নাগরিককে ফেরত নিয়ে বিএসএফ তাঁদের কোচবিহার জেলার পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
চারজনের মধ্যে তিনজনই মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তাঁরা হলেন হরিহরপাড়ার তরতিপুর গ্রামের বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন মণ্ডল, ভগবানগোলার মহিষাস্থলি গ্রামপঞ্চায়েতের হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা মেহবুব শেখ ও বেলডাঙার কাজিশাহার বাসিন্দা মিনারুল শেখ। অন্যজন পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বর থানার কুলুট গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফা কামাল। তাঁরা প্রত্যেকেই পরিযায়ী শ্রমিক। মহারাষ্ট্রের মুম্বইয়ে তাঁরা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। হেফাজতে নেওয়ার পাঁচ দিন পর তাঁদের উদ্ধার করা হলো বলে জানানো হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র ‘পুবের কলম’ আজ সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তাঁদের কাছে বৈধ নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দুই প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র ‘পুবের কলম’ আজ সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তাঁদের কাছে বৈধ নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দুই প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। দুই দিন ধরে তাঁরা কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ থেকে কিছুটা দূরে জিরো পয়েন্টে ছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় মুঠোফোন থেকে ভিডিও বার্তায় ওই চার শ্রমিক তাঁদের দুর্দশার কথা জানান। তারপরেই তাঁদের ফেরানোর তৎপরতা শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলামসহ অন্য জনপ্রতিনিধিরা। পুলিশও বিষয়টি বিএসএএফকে জানায়।
হরিহরপাড়ার বাসিন্দা শামীম রহমান গণমাধ্যমে বলেন, ‘স্থানীয় তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতাদের বিষয়টি জানানো হয়। তারপর তাঁদের ফেরানোর তৎপরতা শুরু হয়। তাঁরা উদ্ধার হয়ে ঘরে ফিরছেন ভেবে ভালো লাগছে।’
সূত্রের খবর, বাংলাদেশি সন্দেহে চারজনকে আটক করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে ১০ জুন বিএসএফের হাতে তুলে দেয় মহারাষ্ট্র পুলিশ। তাঁদের মুম্বাই থেকে আগরতলা ও পরে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জে পাঠানো হয়। ওই শ্রমিকদের টাকা, মুঠোফোনও কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হরিহরপাড়ার তরতিপুর গ্রামের বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন দুই বছর ধরে মুম্বাইয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গতকাল সকালে তাঁর স্ত্রী পিংকি বিবি হরিহরপাড়ার বিধায়ক নিয়ামত শেখের সঙ্গে দেখা করেন। বিধায়কের মাধ্যমে বৈধ নথি সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম ও প্রশাসনের কর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। তারপরই তাঁদের ঘরে ফেরানোর তৎপরতা শুরু হয়।
হরিহরপাড়ার বিধায়ক নিয়ামত শেখ বলেন, নাজিমুদ্দিন এ দেশেরই নাগরিক। তাঁর বৈধ নথি ও নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র রয়েছে।
বিধায়ক নিয়ামত শেখ আরও বলেন, ‘তাঁর মতো আরও তিনজনকে বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় কেন্দ্রের বিএসএফ। গতকাল বিকেলে তাঁরা বিএসএফের হেফাজতে আসেন। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি তাঁরা ঘরে ফিরবেন।’
এ বিষয়ে মুর্শিদাবাদ পুলিশের তরফে গতকাল জানানো হয়, আটক ব্যক্তিদের কাগজপত্র রোববার বিএসএফের হাতে তুলে দেয় রাজ্য পুলিশ। এরপরে বিএসএফ যাবতীয় কাগজপত্র রাজ্য পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে যাচাইয়ের পরে তা বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) হাতে তুলে দেয়।
এরপর বিএসএফ সবাইকে ফেরানোর ব্যবস্থা করে এবং কোচবিহার পুলিশের হাতে তুলে দেয়। মুর্শিদাবাদ ও বর্তমানের জেলা পুলিশের একটি দল ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে ইতিমধ্যে কোচবিহারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আজ সোমবার তাঁদের নিজে নিজে জেলায় ফেরানো হবে বলে জানা গেছে।
চারজনের মধ্যে তিনজনই মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তাঁরা হলেন হরিহরপাড়ার তরতিপুর গ্রামের বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন মণ্ডল, ভগবানগোলার মহিষাস্থলি গ্রামপঞ্চায়েতের হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা মেহবুব শেখ ও বেলডাঙার কাজিশাহার বাসিন্দা মিনারুল শেখ। অন্যজন পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বর থানার কুলুট গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফা কামাল।বাঙালি বলে হেনস্তা পশ্চিমবঙ্গে
তবে শুধু দরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিকই নন, পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত অনেকেই সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, তাঁদের অন্যভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে।
দিল্লির এক অধ্যাপিকা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক মাসে চারবার দক্ষিণ কলকাতার প্রধান পাসপোর্ট অফিসে গিয়েও তিনি তাঁর ২০০৭ সালের পুরোনো পাসপোর্ট নবায়ন করতে পারেননি।
এই অধ্যাপিকা বলেন, ‘আমাকে পুলিশের তরফে বলা হয়েছে, এখানে প্রচুর বাংলাদেশি ঢুকেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সে কারণে আমাদের যাঁদের প্রায় ২০ বছর ধরে বৈধ ভারতীয় পাসপোর্ট রয়েছে, তাঁদেরও সহজে পাসপোর্ট নবায়ন করা হচ্ছে না।’