বিশ্বে বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজ ও পানামা খাল। ১৫০ বছর আগে ১৬৪ কিলোমিটার সুয়েজ খাল খনন করতে সময় লেগেছে মাত্র ১০ বছর। বিশ্ব রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ পানামা খালও খনন করতে সময় লেগেছে ১০ বছর। এটি ১২০ বছর আগে খনন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অথচ সাড়ে ১০ বছরে মাত্র তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি খাল খনন করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এতে সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রতিদিন আড়াই ফুট করে খাল খনন করলেও, খালটির খনন ১০ বছরে শেষ হওয়ার কথা।
সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অনুমোদনের ১০ বছর সাত মাস পর খালটির খননকাজ এগিয়েছে ৮০ শতাংশ। ২ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার খালের মধ্যে দুই কিলোমিটার খনন শেষ হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দাবি, শুরুতে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ, ভূমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা ও মামলাসহ নানা জটিলতার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। তারা প্রকল্পটি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার প্রত্যাশা করছেন।
চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৯৫ সালে প্রণীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে তিনটি নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন ছিল একটি। মাস্টারপ্ল্যানে থাকা এই খালটি খননের উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। খালটি খননের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব কর্মসূচি (ডিপিপি) তৈরি করে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হলে ওই বছরের ২৪ জুন জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের জুনে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এ সময়ে কাজই শুরু করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে না পারায় ব্যয় বেড়েছে পাঁচগুণ। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয় অনুমোদন দেয় একনেক। তিন দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ ধরা হয়। এই সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এখন ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় হয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি হবে ৬৫ ফুট প্রস্থ। খালের দুই পাশে ২০ ফুট করে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি রাস্তা হবে এবং ছয় ফুট প্রস্থের দুটি করে ওয়াকওয়ে হবে। প্রকল্পটির ১৫ দশমিক ১৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শেষ হয়েছে। সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়ালের মধ্যে ৫ কিলোমিটার, সাড়ে ৫ কিলোমিটার ড্রেনের মধ্যে চার কিলোমিটার, ৯টি ব্রিজের মধ্যে ছয়টি, ৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ও ২ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার খালের মধ্যে ২ কিলোমিটার খাল খননকাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের দশমিক ৫০ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়াল, ১ দশমিক ১ কিলোমিটার ড্রেন, তিনটি সেতু, ২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ ও দশমিক ৯৩ কিলোমিটার খাল খননকাজ বাকি আছে। খালটির ওয়াইজরপাড়া, বলিরহাট এবং নূর নগর হাউজিং থেকে বারইপাড়া হাইজ্জারপুল পর্যন্ত খাল খননকাজ বাকি রয়েছে।
নগরের বহদ্দারহাট বারইপাড়া হাইজ্জারপুল থেকে শুরু হয়ে খালটি নূর নগর হাউজিং, ওয়াইজরপাড়া, বলিরহাটের বলি মসজিদের উত্তর পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশবে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, খাল খনন শেষ হলে পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ শুলকবহর, চান্দগাঁও, নাসিরাবাদ, মোহরা, পূর্ব ও পশ্চিম ষোলশহর, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া ও চাক্তাই সংলগ্ন এলাকার মোট আটটি ওয়ার্ডের ১০ লাখ বাসিন্দা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে বলে তাদের প্রত্যাশা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৪ সালে প্রকল্পের অনুমোদন হলেও প্রকল্পটির মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে মূলত ২০২২ সালে। সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো.
প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় অর্থছাড় হচ্ছে না। মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতার কারণে খাল খননকাজ দীর্ঘায়িত হয়েছে। আশা করছি, ২০২৬ সালের মধ্যে খাল খননকাজ শেষ হবে।’
বহদ্দারহাট বারইপাড়া এলাকার শিক্ষক আবদুর রহিম বলেন, ‘একটি খাল খননে ১১ বছর লাগা আজব ব্যাপার। শুধু খাল খনন নয়, সিটি করপোরেশনের সব কাজই হয় কচ্ছপগতিতে। এতে সময় আর টাকার অপচয় হয়।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র খ ল খনন ১০ বছর শ ষ হয় দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
অক্সিডেন্টাল টাকা নিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি স্থানীয়রা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ২৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শনিবার। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মাগুরছড়ার ফুলবাড়ী চা বাগানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ১ নম্বর গ্যাস অনুসন্ধান কূপে খননকালে ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল আশপাশের এলাকা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আগুনের লেলিহান শিখা ৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়। পুড়ে কয়লা হয়ে যায় লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের আশপাশের গাছপালা, মারা যায় বহু পশুপাখি। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় চা বাগান, বিদ্যুৎ লাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, রিজার্ভ গ্যাস, পরিবেশ প্রতিবেশ ও ভূমিস্থ পানিসম্পদ। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আজও ভাসে মৌলভীবাজার জেলাবাসীর মনে। অথচ সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কূপ খননকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি সরকার। উল্টো নিজেদের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার বীমার টাকা তুলে ভেগেছে অক্সিডেন্টাল।
১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেডের। অনুসন্ধান শুরুর পর তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ হবে এলাকা– এই ভেবে কমলগঞ্জ তথা মৌলভীবাজারের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তেল-গ্যাসের সন্ধানে ৩ হাজার ৭০০ মিটার কূপ খননের লক্ষ্য নিয়ে কাজও শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ৮৪০ মিটার খননের পরই ঘটে দুর্ঘটনা। টানা ১৫ দিন আগুন জ্বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিশেষজ্ঞ রিচার্ড চাইল্ড রিসহ চার সদস্যের একটি দল আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে পুরো কূপের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস।
বিভিন্ন সময় তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ গ্যাস পুড়ে যায়; যার দাম ছিল প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষতি ছিল আরও ১১ হাজার কোটি টাকার। বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে মোট ক্ষতির পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অগ্নিকাণ্ডে মাগুরছড়া ও আশপাশের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় দেখা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে ২৯টি চা বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়। লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৯ দশমিক ৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার। ওই ঘটনার সরকারি তদন্তে ক্ষতি বাবদ ধরা হয় ৫০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫ হাজার ৪৫০টি বৃক্ষ। ধারণা করা হয়, আগুনের কারণে ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৮৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফুট রেলপথও ধ্বংস হয়। এতে রাজস্ব ছাড়া ক্ষতি হয়েছে ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। সড়কপথের ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি ১৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা। মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজগুলোতে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা হারে মোট ক্ষতি হয় ১২ লাখ টাকা।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন বিস্ফোরণের পর জ্বলতে থাকা কূপের উৎস মুখ বন্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয় পরের বছর ৯ জানুয়ারি। তার আগেই ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে বিদায় নেয়। এতে দেশজুড়ে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
মাগুরছড়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তারা এক মাসের মধ্যেই তাদের প্রতিবেদন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন বীমা কোম্পানিতে জমা দিয়ে সেই সময়ই অক্সিডেন্টাল তাদের বীমাকৃত যন্ত্রাংশ, রিগ ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। অথচ যে অক্সিডেন্টালের কারণে এত বড় ক্ষতি হলো, তাদের কাছ থেকে সরকার বা এলাকাবাসী এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কখনও পুষিয়ে ওঠার নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
এদিকে মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ কমলগঞ্জে মানববন্ধন করবে পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি, কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবি জানিয়েছে তারা।