কাঁকালভরা কাঁটা, এমন দৃষ্টিনন্দন গাছ পৃথিবীতে বিরল। লাইন ধরে জন্মানো এ গাছ দেখার জন্য বহুবার রেলসড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি আমি। বাসার পেছনে রান্নাঘর থেকে নিষ্কাশিত ছাইয়ের গাদায় জন্মাতো শৈশবের এই গাছ; গলা সমান লম্বা। গাছের মাথায় হলুদ ফুল ফুটলে তা থেকে অদ্ভুত মৃদু একটা সুবাস ছড়িয়ে পড়ত। খেলার সঙ্গী ছোট বোন হাত বাড়িয়ে এই ফুল চাইত, কিন্তু রাশি রাশি কাঁটার কারণে একটুও কাছে যেতে পারতাম না। ব্যর্থতার গ্লানিতে একসময় কঞ্চি দিয়ে গাছের গায়ে আঘাত করতাম আমরা; ফলে আহত গাছের কাণ্ড থেকে বের হয়ে আসত হলুদ রঙের কষ।
হলুদ রঙের কষ বের হয় বলে অনেকে একে স্বর্ণক্ষীরী বলেন। স্বর্ণক্ষীরী নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন সংহিতায়। তবে এটি সেই গাছ নয়, ২০০০ বছর আগেকার রচিত আদি চরকের নয়। প্রকৃত স্বর্ণক্ষীরী গাছটি গার্সিনিয়া মরেলা। আলোচ্য শিয়ালকাঁটা ‘আর্গেমনি মেক্সিকানা’ গাছটি বিদেশি, মেক্সিকোর। কেউ কেউ মনে করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের। পর্তুগিজরা ১১ শতকে এই গাছ প্রবর্তন করেছে ভারতবর্ষে। গাছকে সঙ্গে আনার সম্ভাব্য কারণ, সিফিলিস রোগগ্রস্ত পর্তুগিজদের জন্য দ্রুত উপশমকারী ওষুধ ছিল এই গাছের হলুদ স্বর্ণক্ষীর। বর্তমানে আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইনসহ বহু দেশে এই ভেষজের বিস্তার ঘটেছে– কোথাও ওষুধ, কোথাও বা আগাছা হিসেবে।
কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলে এ গাছের আঞ্চলিক নাম ‘কাঁটাকাইংলি’ অর্থাৎ কাঁটাকাঙালি। শরীরভর্তি কাঁটা অথচ কাঁটার কাঙাল, সাহিত্যরসসমৃদ্ধ এ এক অনুপম ব্যঙ্গার্থক নাম। বাংলায় সর্বাধিক প্রচলিত এর শিয়ালকাঁটা নামকরণের কী কারণ তা জানা যায় না।
অতি উপকারী, টবে রাখা দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী সর্পিল গাছ সানসেভিরিয়া ট্রাইফাসকিয়েটাকে বলা হয় ‘মাদার-ইন-ল’জ টাং’। শাশুড়ির প্রতি এমন অসম্মান গ্রহণ করতে রাজি নই আমরা। কৃষ্ণচূড়ার লাতিন নাম ডিলোনিক্স রিজিয়ার অর্থ দাঁড়ায় ‘রাজোচিত নখর’। অ্যাবরোমা অগাস্টার ফুল গাছের ডালে উল্টো কমলের মতো ঝুলে থাকে বলে একসময় এর যুক্তিগ্রাহ্য নাম ছিল ‘উল্টোকমল’। জিহ্বা ও কালের কশাঘাতে সেই নাম বদলে গিয়ে হয়েছে ‘উলটকম্বল’, যা প্রহসনমূলক। ইংরেজিতে শিয়ালকাঁটার সাধারণ নাম ‘মেক্সিকান পপি’। লাতিন নাম আর্গেমনি মেক্সিকানার মধ্যে মৃদু সমস্যা রয়েছে। কার্ল লিন্নিয়াস যখন এর দ্বিপদী বৈজ্ঞানিক নাম করেন তখন মনে করা হয়েছিল, এটি এক ধরনের ‘ভূমধ্যসাগরীয় পপি’ এবং এর দ্বারা চোখের চিকিৎসা করা হতো। এর জাতিগত নামে ‘আর্গেমনি’ যুক্ত হয়েছে, যার অর্থ চোখের ছানি বা সাদা স্পট।
শিয়ালকাঁটার তীব্র বিষাক্ত বীজ দেখতে অবিকল সরিষার মতো, যা থেকে ৩০-৪০ শতাংশ তেল উৎপাদিত হতে পারে। এ কারণে একে সূর্যমুখী তেল, তিল তেল ও প্রধানত সরিষার তেলে ভেজাল দেওয়া হয়েছে বহুকাল ধরে। মিশ্রিত তেল ব্যবহারের কারণে অতীতে সারা ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলায় বেশ কয়েকবার মহামারি শোথ রোগ (এপিডেমিক ড্রপসি) দেখা দিয়েছে। এতে পা ফোলা, বমি, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং চোখের গ্লুকোমা রোগ দেখা দিতে পারে; যা পরবর্তীকালে অন্ধ করে দিতে পারে মানুষকে।
১৯২৬ সালে ভারতীয় গবেষক এসএন সরকার তেল থেকে মহামারি বিস্তারের বিষয়টি তুলে ধরেন; যাতে বিষাক্ত পদার্থ ‘স্যাঙ্গুইনারিন’ মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। বাংলা অঞ্চলে ১৯৩৫ সালে প্রায় সাত হাজার লোক এতে আক্রান্ত হয়ে দেড় হাজার প্রাণ হারান। গোয়ালিয়র, কনৌজ, লক্ষ্ণৌ ইত্যাদি এলাকায় ২০০০ সালের পরও মহামারি দেখা দিয়েছে।
সরিষা-ইলিশ আমাদের খুব প্রিয় একটি খাবার। নাম শুনলেই মনে হয় নাসিকায় সুঘ্রাণ এসে ঢুকছে। সেই উপাদেয় রান্নায় সরিষার ভেতর যে শিয়ালকাঁটার বীজ নেই তা আমরা কী করে জানব! এটি কোন মুল্লুক থেকে আমদানি করা সরিষা, সেটি জানাও কঠিন। জানার চেষ্টা করাও অকারণ সময়ক্ষেপণ। যে দেশেরই হোক, সরিষা ক্ষেতে এই গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মাতে পারে এবং খুব সহজেই মিশে যেতে পারে সরিষার সঙ্গে। এই বীজের বিষাক্ততা এত তীব্র যে, ১০০টা সরিষাদানার ভেতর শিয়ালকাঁটার মাত্র একটি দানা থাকলেও তাকে হাসপাতালে যেতে হতে পারে। এ সমস্যার একটি সহজ সমাধান আছে। শিয়ালকাঁটার বীজ দেখতে সরিষার মতো হলেও এর ঘনত্ব একটু কম বলে জলের ওপর ভেসে থাকে। অতএব সরিষা-ইলিশ রান্নার আগে একটু জলে ডুবিয়ে নিয়ে ভেসে থাকা সরিষাগুলো ফেলে দিলেই দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এই গ ছ
এছাড়াও পড়ুন:
এমন রাত বাড়তে থাকলে একসময় ইসরায়েলিরা প্রশ্ন তুলবে, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
আকাশপথে ইরানের চালানো পাল্টা হামলা থেকে ইসরায়েলিরা কতটা সুরক্ষিত? এই প্রশ্নের উত্তর ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজের সাংবাদিক গিদেওন লেভির কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছে আল-জাজিরা।
গিদেওন লেভি আল-জাজিরাকে বলেন, বেশির ভাগ ইসরায়েলি আকাশপথের হামলা থেকে ‘খুব ভালোভাবে সুরক্ষিত’।
তবে গিদেওন লেভি বলেন, এমন হামলা চলতে থাকলে ইসরায়েলিরা একসময় শুধু ক্লান্ত আর ভীতই হবেন না, একসময় যুদ্ধের পর যুদ্ধ নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলবেন। এভাবে তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।
আরও পড়ুনখামেনিকে হত্যার ইসরায়েলি পরিকল্পনা ট্রাম্পের আটকানোর কথা জানিয়ে দেওয়ার মানে কী৩ ঘণ্টা আগেগত শুক্রবার ভোররাতে ইরানে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। চলমান ইসরায়েলি হামলায় ইরানে এখন পর্যন্ত অন্তত ২২৪ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ইরানের অন্তত ২০ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। ইরানও পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরানের হামলায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন।
আকাশপথে চালানো হামলা থেকে ইসরায়েলিদের সুরক্ষার ব্যবস্থা সম্পর্কে সাংবাদিক গিদেওন লেভি বলেন, ইসরায়েলে ‘অ্যালার্ম সিস্টেম’ খুব কার্যকরভাবে কাজ করে। এবার তাঁরা ‘সাইরেন’ বাজার অনেক আগেই ‘অ্যালার্ম’ পাচ্ছেন। ফলে তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করার সময় পাচ্ছেন। যেমন তেল আবিবের বেশির ভাগ এলাকায় অনেকর আশ্রয়কেন্দ্র আছে। তা ছাড়া নতুন প্রতিটি ভবনেই নিজস্ব আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ কক্ষ থাকে। এই দিক থেকে দেখলে ইসরায়েলের সাধারণ জনগণ যথেষ্ট সুরক্ষিত।
ইসরায়েলে ‘অ্যালার্ম সিস্টেম’ মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে আকাশপথে হামলার বিষয়ে লোকজনকে আগাম সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। অন্যদিকে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় আকাশপথে হামলা শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে ‘সাইরেন’ বাজানো হয়।
আরও পড়ুনইসরায়েল প্রশ্নে কেন মোদির অবস্থান নরম, কড়া সমালোচনা কংগ্রেসের৩ ঘণ্টা আগেতবে গিদেওন লেভি উল্লেখ করেন, এই সুরক্ষা সব ইসরায়েলির জন্য সমান নয়। যেমন বেদুইন জনগোষ্ঠী কিংবা ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি নাগরিকেরা এ সুবিধা পান না।
এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলের উত্তরের ফিলিস্তিনের প্রধান শহর তামরার উদাহরণ দেন গিদেওন লেভি। শহরটিতে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ বসবাস করে। এখানে গতকাল রোববার একটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় অন্তত চারজন নিহত হন। এখানে কোনো সুরক্ষা আশ্রয়কেন্দ্র নেই। কিন্তু পাশের একটি এক হাজার জনসংখ্যা–অধ্যুষিত ইহুদি গ্রামে একাধিক আশ্রয়কেন্দ্র আছে বলে জানান গিদেওন লেভি।
সাংবাদিক গিদেওন লেভি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এ রকম রাত যত বাড়বে, ইসরায়েলিরা শুধু ক্লান্ত আর ভীতই হবেন না, বরং একসময় আমরা শেষমেশ নিজেরাই প্রশ্ন করতে শুরু করব—এর কি কোনো মূল্য আছে? আমরা কোথায় যাচ্ছি? এক যুদ্ধ থেকে আরেক যুদ্ধে? এক গোলাবর্ষণ থেকে আরেক গোলাবর্ষণে? কারণ, এবারের পরিস্থিতি গাজা বা লেবাননের মতো নয়। এবার বেসামরিক জনগণের খেসারত হতে পারে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তাই ইসরায়েল কয়েক দিন এটা সহ্য করতে পারবে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে নয়।’
ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার পর ইরানের নতুন সামরিক নেতৃত্বে কারা এলেনইসরায়েলি হামলায় নিহত আইআরজিসি গোয়েন্দাপ্রধান কাজেমি কে ছিলেনইরান-ইসরায়েলের হামলা, পাল্টা হামলা: সর্বশেষ কী জানা গেল