হাসিনা পালানোর পরও ৬ ঘণ্টায় ১৫ জনকে হত্যা
Published: 5th, February 2025 GMT
৫ আগস্ট ২০২৪। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে ভারতে যান, তখনো ঢাকার অদূরে সাভারে চলছিল গণহত্যা। ধাপে ধাপে চলে পুলিশের গুলিবর্ষণ। পাশাপাশি অন্তত চারটি স্থানে চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটে।
৬ ঘণ্টার ব্যবধানে অন্তত ১৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতদের ১০ জনই শিক্ষার্থী। অন্যরা নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ ও ব্যবসায়ী। গুলিতে গুরুতর আহত হন অন্তত ৩৩ জন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
সন্ধ্যার আগে থানার সামনে মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়ে যায় পুলিশ ও ছাত্র-জনতা। পুলিশের হাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র। আর বিক্ষোভকারীদের হাতে কাঠ-বাঁশের টুকরা, ইটপাটকেল। হঠাৎ ছোট্ট সরু গলিতে নির্বিচার প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণ করে পুলিশ।
এমনকি দিনের শেষে যখন পুলিশ পালিয়ে যায়, তখনো তাদের বহর থেকে চলে গুলিবর্ষণ। সারা দেশে যখন সরকার পতনের আনন্দ, তখন রাত পর্যন্ত আতঙ্ক বিরাজ করে সাভারে।
দুই মাস ধরে সেদিনের ঘটনার অন্তত ৪০০ ভিডিও সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে প্রথম আলো। সেসবের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়েছে একটি প্রামাণ্যচিত্র সাভার গণহত্যা: হাসিনা পালানোর পরের ৬ ঘণ্টা।
মহাসড়কে গুলির পর গুলি‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’, ‘আওয়ামী লীগের আস্তানা, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ এমন নানা স্লোগানে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা যাত্রা শুরু করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বেলা ১১টার দিকে যাত্রা শুরু করা এ মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল গণভবনের দিকে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক ছাড়াও মিছিলে ছিলেন সাভার, আশুলিয়া, বাইপাইল এলাকার আন্দোলনকারীরা।
অন্যদিকে সাভার বাসস্ট্যান্ডে আগে থেকেই অবস্থান নেয় শতাধিক পুলিশ। সঙ্গে ছিলেন অস্ত্রধারী স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সকাল থেকেই অলিগলিতে চলে গুলিবর্ষণ।
এর মধ্যেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অন্ধ সংস্থা মার্কেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হয় ১৭ বছরের মাদ্রাসাশিক্ষার্থী মো.
জাহাঙ্গীরনগরের থেমে থেমে এগোনো মিছিলটি সাভার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায় আড়াই ঘণ্টায়। পরিস্থিতি তখন থমথমে। সেনাপ্রধান বেলা দুইটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, এমন খবরে তাঁরা ঢাকার দিকে এগোতে চান। তখনই কাঁদানে গ্যাস-ছররা গুলি ছোড়ে পুলিশ।
কিন্তু আন্দোলনকারীরা পিছু হটেননি। তাঁদের আটকাতে বেলা ২টা ৭ মিনিটে গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। জীবন বাঁচাতে প্রাণপণ দৌড়াতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। অসংখ্য গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে ধরাধরি করে নিয়ে যেতে দেখা যায় সে সময়ের বেশ কয়েকটি ফুটেজে।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী মো. মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর পাশেই তিনজনকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে দেখেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোখের সামনে একজন গুলি খেয়ে পড়ে গেলেন। তাঁর ঘাড়ে গোল করে ফুটো হয়ে যায়। তাঁর পাশেই একজন পড়ে গেলেন হঠাৎ। তাঁর ডান পাশে আরেকজন পড়ে গেলেন।’
প্রাণঘাতী গুলি কেড়ে নেয় ১৭ বছর বয়সী বার্নিশ মিস্ত্রি মুজাহিদ মল্লিকের প্রাণ। কাছাকাছি সময়ে গুলিবিদ্ধ হন অটোরিকশাচালক মো. সুজন মিয়া। সুজনের বুকে ও কোমরে গুলি লাগে।
গুলিবর্ষণের পর ফাঁকা হয়ে যায় মহাসড়ক। শেখ হাসিনা পালানোর খবরে আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ ফিরে গেলেও অপর একটি অংশ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে নিউমার্কেটের সামনে। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন আল-আমিন।
২টা ৪০ মিনিট। সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে পিছু হটা পুলিশকে দেখা যায় পাকিজা ইউলুপে, রাস্তার পশ্চিম পাশে। তখন তাদের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।
বেলা পৌনে তিনটার দিকে পাকিজা মডেল মসজিদের সামনে গুলিবিদ্ধ হন শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন। একটা বুলেট বুকের বাঁ পাশ দিয়ে প্রবেশ করে পিঠের ডান পাশ দিয়ে আড়াআড়িভাবে বেরিয়ে যায়।
বেলা ২টা ৫৩ মিনিটে পুলিশ ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে থানা রোডের দিকে প্রবেশ করে। তখনো মহাসড়কের দিকে গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হন সড়ক বিভাজকের আড়ালে থাকা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ আহমেদ সিয়াম।
আলিফ আহমেদের মা তানিয়া আক্তার কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ও যখন আইল্যান্ডের (সড়ক বিভাজকের) ওখানে মাথাটা উঁচু করে দেখতে গেছে, তখনই গুলিটা লাগে। এখান দিয়ে ভেদ করে গুলিটা পেছন দিয়ে বের হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ও মাটিতে পড়ে যায়।’
থানার সামনে হত্যাযজ্ঞবেলা তিনটার দিকে বিজয় উদ্যাপনে ছাত্র-জনতার একটি অংশ চলে যায় ঢাকার দিকে। আরেকটি অংশ সাভারে পুলিশের গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এগিয়ে যায় সাভার থানার দিকে।
‘পলাইছে রে পলাইছে, শেখ হাসিনা পলাইছে।’—এ রকম স্লোগান ভেসে আসে মিছিল থেকে।
৩টা ৫০ মিনিটের দিকে সাভার থানার একটু আগে অবস্থিত চৌরাস্তায় মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায় পুলিশ ও বিক্ষোভকারীরা। ঠিক সাড়ে চারটার দিকে পুলিশ থানার ভেতরে চলে যায়, আটকে দেয় প্রধান ফটক। তখন মাইকে ছাত্রদের শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। বাড়তে থাকে ছাত্র-জনতার সংখ্যা। এরপর পুলিশ থানার মসজিদের ছাদ থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণ।
সে সময় সেখানে ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। সেকেন্ডের ব্যবধানে তাঁর বাঁ হাতে ১৮-১৯টি ও ডান হাতে ২০–২২টি ছররা গুলি লাগে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সঙ্গে সঙ্গেই আমি পড়ে যাই। হাঁটুর যত চামড়া-মাংস ছিল, সব থেঁতলে যায়। তারপর আর কোনো জ্ঞান ছিল না।’
থানার ঠিক উল্টো দিকে হাসপাতালের সীমানায় দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিলেন গুলিতে নিহত লাল টি-শার্ট পরা এক ব্যক্তি। তাঁর পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
আর চৌরাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী সাফওয়ান আখতার। গুলিতে তাঁর ডান হাত ভেঙে যায়। আরেকটি গুলি লাগে বুকের ডান পাশে। বিক্ষোভ দেখতে গিয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ১৫ বছরের এই কিশোর।
ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন শ্রমিক আল আমিন। তাঁর বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগে ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর অটোচালক মো. রফিক নিহত হন বুক ও পেটের মাঝামাঝি লাগা গুলিতে।
তখন চৌরাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ছাত্র-জনতা জড়ো হতে থাকেন মুক্তির মোড়ে।
‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন। সাভারবাসীর অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন।—এসব স্লোগানে মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মুক্তির মোড়।
মুক্তির মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছাত্র-জনতা এগোতে থাকেন চৌরাস্তার দিকে। সাড়ে ৫টার দিকে শতাধিক মানুষ জড়ো হলে উত্তাল হয়ে ওঠে চৌরাস্তা মোড়।
এই সময়টা ছিল অনেকটা যুদ্ধাবস্থা। ‘বৃষ্টির মতো’ গুলি চালায় পুলিশ।
প্রথম আলোর হাতে আসা তখনকার গুলিবর্ষণের দুটি ভিডিওতে দেখা যায়, মুহুর্মুহু গুলির পর দৌড়ে পালাতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা।
একটি ভিডিওর শেষ ১৫ সেকেন্ডের অংশে শোনা যায় অসংখ্য গুলির শব্দ। দেখা যায় প্রাণপণ জীবন বাঁচানোর দৃশ্য। তখন রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিল গুলিবিদ্ধ অসংখ্য দেহ।
গুলিবিদ্ধ হয়ে পুলিশের ঠিক সামনে রাস্তায় পড়ে ছিলেন বাসচালক মানিক হোসেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রায় ৫ মিনিট পর জ্ঞান হারান তিনি।
পুলিশের গুলিবর্ষণ চলে প্রায় আধা ঘণ্টা। তখনকার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা প্রথম আলোকে জানান শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘দৌড় দেওয়ার সময় হঠাৎ মনে হলো, পায়ে একটা ১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের বাড়ি খেলো। তাকিয়ে দেখি যে আমার বুড়ো আঙুলটা ঝুলছে, কাঁপছে। আর গোড়ালির ওখান দিয়ে হাড় বের হয়ে গেছে।’
সেখানে গুলিবর্ষণে চারজন নিহতের খবর নিশ্চিত করেছে প্রথম আলো। তাঁরা হলেন নিশান খান, তানজীর খান মুন্না, আব্দুল আহাদ সৈকত ও মো. মিঠু।
শিক্ষার্থী মো. মিঠুর বুকে গুলি লেগে বেরিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মুক্তির মোড়ে মারা যান তিনি। ঊরুতে লাগা গুলিতে অধিক রক্তক্ষরণে মারা যান শিক্ষার্থী তানজীর খান।
আর গোলাগুলিতে দৌড়ে পালানো নিশান খানের মাথার পেছনে ছিল আঘাতের ক্ষত। হাসপাতালে আনার পর তাঁর মৃত্যু হয়।
একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলাশেখ হাসিনা পালানোর পর পুলিশ যখন থানা বাসস্ট্যান্ড এলাকায়, তখন এক কিলোমিটার দূরে নিউমার্কেট এলাকায় চলে চোরাগোপ্তা গুলিবর্ষণ। ২০ মিনিট ধরে থেমে থেমে গুলি চলে। বেলা পৌনে তিনটার দিকে সেখানে নিহত হন দুই শিক্ষার্থী আব্দুল কাইয়ুম ও শ্রাবণ গাজী।
কাইয়ুমের বন্ধু আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হুট করে দেখলাম কাইয়ুম ধীরগতিতে মাটিতে পড়ে গেল। তখনো বুঝি নাই যে কাইয়ুম গুলিটা খাইছে। যখন মাটিতে পড়ে যায়, তখন ধরাধরি অবস্থায় দেখি ওর পাশে রক্ত বেরোচ্ছে।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা, কাইয়ুমকে গুলি করা হয় বহুতল ভবন সিটি সেন্টার থেকে। সেখানে ছাদে লাল কাপড় পরা ব্যক্তিদের সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি দেখে ভবনটিতে ভাঙচুর চালান বিক্ষুব্ধরা।
এরপর বেলা তিনটার দিকে ল্যাবজোন হাসপাতালের সামনে চোরাগোপ্তা গুলিবর্ষণে আহত হন কয়েকজন। হাসপাতালের পেছনের ভবন থেকে গুলি হয়েছে, সে সন্দেহে সেখানে ভাঙচুর চালান বিক্ষুব্ধরা।
বেলা তিনটার দিকে থানা বাসস্ট্যান্ডে চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটে। সড়ক থেকে পুলিশ গুলি করছিল। আর ভবন থেকে চোরাগোপ্তা গুলি চালানো হয়। সে সন্দেহে সেখানকার পপুলার হাসপাতালে আক্রমণ করেন কেউ কেউ।
মিছিলটি এনাম মেডিকেল হাসপাতাল পার হতেই আবার চোরাগোপ্তা গুলি হয়। বিক্ষুব্ধ কেউ কেউ পাশের একটি বহুতল ভবনে হামলা চালায়। ভাঙচুর করা হয় নিচতলার রেস্তোরাঁয়। যদিও হামলাকারীর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বিকেল সোয়া ৫টার দিকে মুক্তির মোড়ে আবার চোরাগোপ্তা গুলিবর্ষণ চলে। মোড়ের বহুতল ভবন অ্যাভিনিউ জুনায়েদ টাওয়ার থেকে গুলি হয়েছে সন্দেহে সেখানে তল্লাশি চলে। যদিও কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।
শরীরের ওপরের অংশে গুলিসাভার উপজেলা শহরে দুপুর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে উঠে এসেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে। তাঁদের ১৩ জনকেই গুলি করা হয় শরীরের ওপরের অংশে। মাথায় প্রাণঘাতী গুলি লাগে ৪ জনের, ঘাড়ে ১ জনের। বুক থেকে কোমরের মাঝে গুলিবিদ্ধ হন ৯ জন। আর ঊরুতে গুলি লেগে মৃত্যু হয় ১ জনের।
হাসপাতালে আর্তনাদদুপুরের পর থেকে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের আর্তনাদ শোনা যায় সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রবেশপথে পড়ে ছিল গুলিবিদ্ধ মরদেহ। জরুরি বিভাগের মেঝেতেও ঠাঁই দিতে হয় হতাহতদের অনেককে। গুলিবিদ্ধ অনেকে ভয়ে হাসপাতালে আসেন রাত আটটার পর পুলিশ থানা ত্যাগ করলে।
দুপুর থেকে রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন হাসপাতালটির মেডিকেল অফিসার সুলতানা শাহীনূর মমতাজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরীরের ওপরের অংশে গুলিবিদ্ধ রোগী বেশি ছিল। ব্যান্ডেজ দিয়েও রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল না।’
উপজেলা হাসপাতাল থেকে রক্তপাত বন্ধ করে সংকটাপন্ন রোগীদের পাঠানো হয় এনাম মেডিকেল হাসপাতালে—হুইলচেয়ারে, ভ্যানে, অ্যাম্বুলেন্সে, এমনকি মোটরসাইকেলে তুলে।
হাসপাতালটির প্রবেশপথে দেখা যায় লাশের সারি। সন্ধ্যার দিকে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের চাপ আর সামলাতে পারছিল না হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। জরুরি বিভাগের বাইরে হুইলচেয়ারেই চলে চিকিৎসা।
ওই দিন অসংখ্য রোগীকে সামলেছেন এনাম মেডিকেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও সহকারী রেজিস্ট্রার মো. উজ্জল আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্রমাগত রোগী আসতে থাকে। ২২টি অপারেশন থিয়েটার রোগী দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। রাতে ২৫ থেকে ৩০টি বড় অস্ত্রোপচার করা হয়।
পালানোর সময়ও গুলি করে পুলিশঅসংখ্য মানুষকে হতাহত করার পর পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পুলিশ। পেছনের নদী ধরে পালিয়ে যান কেউ কেউ। অনেকেই পোশাক পাল্টে ফেলেন। তখন সন্ধ্যা নামায় পালানোটা সহজ হয়ে যায়।
অধিকাংশ পুলিশ সদস্য থানা রোড ধরে বেরিয়ে যান। তখনো এই বহর থেকে চলে গুলিবর্ষণ।
বহরের সামনে হেঁটে এগোচ্ছিলেন পুলিশের দেড় শতাধিক সদস্য। দ্বিতীয় সারিতে কয়েকটি মোটরসাইকেল। পরের সারিতেই গাড়ির বহর, সংখ্যা ১৩। এখানে ছিল পুলিশের পিকআপ ভ্যান, একটি করে সাঁজোয়া যান, অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, লেগুনা ও ট্রাক।
স্থানীয় লোকজনের দাবি, মাইক্রোবাসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনেককেই নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। যদিও তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশের বহর মহাসড়কে ওঠার পরও পাশের একাধিক গলিতে চলে গুলিবর্ষণ।
রাতে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সাভার উপজেলা শহরজুড়ে। অবশেষে সাভার ক্যান্টনমেন্টের দিকে চলে যায় পুলিশ, অসংখ্য গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির রক্তে ভেজা পথ মাড়িয়ে।
সাভারের এই গণহত্যার ঘটনা কখনো ভোলার নয়। এই গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতে হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ভ র উপজ ল ছ ত র জনত অ য কশন গণহত য র স মন ন র পর পর প ল র একট র ওপর অবস থ র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।