পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকেরা মিলে বিক্ষোভকারীদের ওপর সমন্বিত হামলা চালায়
Published: 14th, February 2025 GMT
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে জুলাই–আগস্ট ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার কীভাবে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের নামিয়ে দিয়েছিল, তার বিবরণ উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সমর্থক ও পুলিশ সদস্যরা সমন্বিতভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভ যতই এগিয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী তত বেশি করে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকদের বিক্ষোভ দমনে অন্তর্ভুক্ত করতে থাকে। এর মধ্যে যুবলীগের সদস্যরাও ছিলেন। আওয়ামী লীগের যুব শাখা হিসেবে সংগঠনটি পরিচিত। তবে অনেক মধ্যবয়সী পুরুষও সহিংসতায় জড়িয়েছিলেন।
ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক অভিযানে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকেরা পুলিশের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলেন কিংবা পুলিশের সারির পেছনে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার অভিযানের পুরোটা সময় তাঁরা পুলিশি ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন। আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা পথচারী মানুষকে থামিয়ে তল্লাশি এবং বিক্ষোভকারীদের আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াসহ নানা কাজ করেছেন। সংগঠিতভাবে, আপাতদৃষ্টে পূর্বপরিকল্পিতভাবে এসব করা হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ একটি সূত্রের খবর, যাত্রাবাড়ী থানায় আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা অবস্থান করেছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের অধীন পুলিশের রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে এই কাজ সহজতর হয়েছিল; যা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের মধ্যে গভীর যোগাযোগ তৈরি করেছিল।
১৮ জুলাই থেকে, বিশেষত আগস্টের শুরুর দিকে বিক্ষোভ যখন জোরালো হয়ে ওঠে, তখন আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকেরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আরও বড় পরিসরে নিজেরাই হামলা চালাতে শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক ওএইচসিএইচআরকে জানান, আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগ সমর্থকদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম হয়েছে। তাঁদের অনেকেই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অবৈধ উদ্দেশ্যে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে ওএইচসিএইচআরকে ৯৫ জন পুলিশ সদস্য, আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের অনুমোদিত সংগঠনের সদস্যের নাম এবং কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিক্ষোভ চলাকালে সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য মানুষকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে ১০ জন তখন সংসদ সদস্য ছিলেন। তালিকায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ১৪ জন। এ ছাড়া যুবলীগের ১৬ নেতা, ছাত্রলীগের ১৬ নেতা এবং পুলিশের সাত সদস্যের নাম রয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ অনুমোদিত সংগঠনের ১৬০ রাজনৈতিক নেতা এবং নিরাপত্তা খাতের কর্মকর্তাদের নাম ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ওএইচসিএইচআরকে তথ্য দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নাগরিকদের মাধ্যমে অন্য নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণের প্ররোচনা বা নির্দেশ দেওয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ–সমর্থকদের হামলাগুলো ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর নিজস্ব প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তাদের সমর্থনে পরিচালিত হয়েছিল। কিছু হামলায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় দলীয় নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুনিশ্চিত প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য, ভিডিও এবং অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশজুড়ে ঘটা এমন কয়েকটি ঘটনা নথিভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকেরা গত ১৯ জুলাই দলটির নেতাদের নেতৃত্বে রাজধানীর উত্তরায় ক্রিসেন্ট হাসপাতালের কাছে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালান। একই দিন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে দলটির কয়েক শ সমর্থক রাজধানীর রায়েরবাগে মুজাহিদনগর কেন্দ্রীয় মসজিদে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান। এ সময় বয়স্ক দুই ব্যক্তি নিহত হন। মসজিদে থাকা অন্যরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় সংঘর্ষে ৩ জন নিহত ও অন্তত ৮০ জন আহত হন।
১৯ জুলাই পুলিশের সঙ্গে মিলে যুবলীগের সমর্থকেরা সংসদ ভবনের সামনে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে বাধা দেন। এ সময় যুবলীগ সমর্থকেরা মানববন্ধন কর্মসূচির প্রধান বক্তাকে মারধর করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলের সামনে পুলিশের সহযোগিতায় সশস্ত্র যুবলীগ–সমর্থকেরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান। রড ও পিস্তলের আঘাতে আহত হন বেশ কয়েকজন, যাঁদের মধ্যে নারীও ছিলেন।
এতে আরও বলা হয়, ৩ আগস্ট কুমিল্লায় সশস্ত্র ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি ও রড নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান। সশস্ত্র ব্যক্তিরা একেকটি দলে ৬০ জন করে ভাগ হয়ে এই হামলা চালান। হামলা ও গুলিতে অসংখ্য বিক্ষোভকারী আহত হন। পুলিশ হামলাকারীদের নিবৃত্ত করার কোনো চেষ্টাই করেনি। পরদিন আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকেরা একই ধরনের হামলা চালান এবং ওই এলাকায় তারা ভবন থেকে গুলি করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন সংসদ সদস্যসহ আগ্নেয়াস্ত্রসজ্জিত আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা মারণাস্ত্র নিয়ে সাভারের আশুলিয়ায় ৪ আগস্ট শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান। এতে তিনটি শিশু ও চারজন ব্যক্তি গুলিতে আহত হন।
একই দিন রাজধানীর মিরপুরে একজন সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকেরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান। পাশ্ববর্তী একটি ভবন থেকেও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এ সময় দুজন গুলিবিদ্ধ হন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট খুলনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার বাড়ি থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এতে ১৭ জন গুলিতে আহত হন। ওএইচসিএইচআরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ওই ঘটনায় আহত একজন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ওএইচস এইচআর ল গ সমর য় আওয় ম য বল গ আগস ট এ সময়
এছাড়াও পড়ুন:
প্রযুক্তি কি ডিমেনশিয়া বাড়িয়ে দিচ্ছে? ৫৭টি ভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে বিস্ময়কর তথ্য
প্রযুক্তির কল্যাণে হুটহাট বড় পরিবর্তন আসা নতুন কিছু নয়। করোনা মহামারির আগে বাসা থেকেও যে অফিস করা সম্ভব, সেটা মানতে চাইতেন না অনেকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হোম অফিস হয়েছে স্বাভাবিক। একই ঘটনা ঘটেছে ডিজিটাল দুনিয়ায়। একসময় যেকোনো তথ্য খুঁজে বের করার জন্য শরণাপন্ন হতে হতো সার্চ ইঞ্জিনের; এআই সেই উত্তর সবিস্তারে দিয়ে দিচ্ছে মুহূর্তেই। ফলে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শুধু জীবনকে সহজতর করছে না, বাঁচিয়ে দিচ্ছে সময় ও পরিশ্রমও। কিন্তু এই বেঁচে যাওয়া সময় ও পরিশ্রম মস্তিষ্কের ওপর ঠিক কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস ও বেলোর ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, এত দিন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানব মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমার যে গুঞ্জন ভেসে বেড়িয়েছে, তার কোনো সত্যতা নেই। ‘নেচার হিউম্যান বিহেভিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ নামে যে হাইপোথিসিস আছে, তার কোনো প্রমাণ নেই গবেষকদের কাছে। বরং পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষদের স্মার্টফোন, কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার তাঁদের স্বাভাবিক স্মৃতিভ্রম অনেকটা স্তিমিত করে।
ডিজিটাল ডিমেনশিয়া কী২০১২ সালে প্রথম ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী ও মনোবিদ ম্যানফ্রেড স্পিৎজার। মূলত যে হারে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে এবং মানুষ যান্ত্রিক পর্দার সামনে প্রতিদিনের বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছে, তাতে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে অনেকটাই। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলোও মনে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে অনেকে। যেমন ফোন নম্বর। একসময় প্রিয়জনের ফোন নম্বর আমাদের মুখস্থ থাকত। এখন ফোন নম্বর ঠাঁই পায় মুঠোফোনের কনটাক্ট লিস্টে। ফোন নম্বর মনে রাখার চেষ্টাই করে না কেউ। আবার অনেকক্ষণ যান্ত্রিক পর্দার সামনে থাকলেও সেখান থেকে শেখার ইচ্ছা থাকে না অনেকের। চোখের সামনে যা আসছে, স্ক্রল করে চলে যাচ্ছে পরের কোনো কনটেন্টে। এতে মনোযোগ হারিয়ে যায় দ্রুত। আর প্রযুক্তির এমন অতিব্যবহার যে স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে, একেই ধরা হয় ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ হিসেবে।
আরও পড়ুনডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহারের সময় ২০-২০-২০ নিয়ম মানাটা কেন জরুরি২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩গবেষণা যা বলছেপ্রায় ৪ লাখ ১১ হাজার পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের ওপর চালানো ৫৭টি ভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে স্মৃতিভ্রম দেখা দেয়, তার অনেকটাই হ্রাস করে প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ফলে স্মৃতিশক্তি কমে আসার আশঙ্কা প্রায় ৫৮ শতাংশে নেমে আসে।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া বরং আরও কিছু সূচকের (যেমন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থা) ওপর নির্ভর করে। মজার ব্যাপার হলো, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার থেকেও বেশি কার্যকর প্রযুক্তির ব্যবহার।
তবে এর সবকিছুই নির্ভর করছে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের ওপর। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা বেশির ভাগ সময়ই অনলাইনে কাটান ইউটিউব ভিডিও অথবা ফেসবুক স্ক্রল করে। এতে তাঁদের মস্তিষ্কের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। মস্তিষ্ক সচল রাখতে পারে এমন কনটেন্টে তাঁদের মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারলে আনন্দ যেমন পাবেন, তেমনই ডিজিটাল দুনিয়া সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে যাবে। এ ছাড়া অনলাইনের হাজারো গুজব ও উসকানি থেকে মুক্ত থাকবেন তাঁরা।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট
আরও পড়ুনমাত্রাতিরিক্ত স্ক্রিনটাইম যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩