অদক্ষ দাইয়ের হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন নারী
Published: 16th, February 2025 GMT
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার জিনদপুর ইউনিয়নের মেরকুটা গ্রামের গৃহবধূ আছিয়া খাতুন কয়েক মাস আগে বাড়িতে দাইয়ের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করেন। এর পরই তাঁর শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। উপায় না পেয়ে সারারাত অপেক্ষা করে ভোরে তাঁকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ততক্ষণে তাঁর রক্তচাপ কমে আসে। পরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় এভাবে অদক্ষ দাইয়ের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন প্রসূতিরা। বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) এক জরিপে দেখা গেছে, গ্রামের ৮৫ শতাংশ নারী সন্তান প্রসবের জন্য দাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩১ লাখ নারী সন্তান প্রসব করেন। এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিকে, ৫৩ শতাংশ বাসাবাড়িতে। ১৬ লাখ ৪৩ হাজার সন্তান প্রসব হয় বাসাবাড়িতে অদক্ষ দাইয়ের হাতে। হাসপাতাল ও বাসায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি লাখে ১৭২ নারী প্রাণ হারান।
বেড়েছে প্রসূতির মৃত্যু
দেশে চলতি দশকের শুরুতে প্রসূতির মৃত্যু বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্মের বিপরীতে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৬৮। যদিও আগের বছরগুলোয় তা কমতে শুরু করেছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একলামশিয়া বা খিঁচুনি, ফুল না আসা ও প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণের কারণে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে যানবাহন সমস্যা, হাসপাতালে সময়মতো সেবা না পাওয়ার আশঙ্কা এবং ছুটির দিনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, গুণগত বা নির্ধারিত সেবা না পাওয়া মাতৃমৃত্যু বেড়ে যাওয়ার বিশেষ কারণ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নারীপক্ষর প্রকল্প পরিচালক সামিয়া আফরিন বলেন, প্রসব বেদনা যে কোনো সময় উঠতে পারে। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সময়মতো চিকিৎসক মেলে না। দাইরা নিঃস্বার্থভাবে প্রসূতির পাশে যে কোনো সময় এসে দাঁড়ান। দাইদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে প্রসূতির বিপদচিহ্ন জানাতে তাদের প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে এবং প্রসবকালীন সহায়তার জন্য হাসপাতালের চিকিৎসকের সঙ্গে দাইদের যোগসূত্র ঘটাতে হবে।
বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২ বছরভিত্তিক মাতৃমৃত্যুর চিত্র দেখিয়েছে। এতে দেখা যায়, গত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে ২০০২ ও ২০০৭ সালে আগের বছরের তুলনায় মাতৃমৃত্যু বেশি ছিল। আবার ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় মাতৃমৃত্যু বেশি দেখা যায়।
মাতৃমৃত্যুর অনুপাত কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করলেও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বলছে, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হ্রাসের উন্নতির পথে এখনও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। এগুলো হলো অল্পবয়সী প্রসূতির মাতৃসংক্রান্ত জটিলতা, বাল্যবিয়ে ও পরবর্তীকালে গর্ভধারণ।
কমছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার
বিগত সময়ে দেশে যেসব সাফল্য ছিল, তার মধ্যে অন্যতম জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিকল্পিত পরিবার গঠন। কিন্তু সেই সাফল্যে ভাটা পড়েছে। মেরী স্টোপস বাংলাদেশের লিড অ্যাডভোকেসি মনজুন নাহার বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে যাওয়ার পেছনে সরকারি সেবার মান ও মনোযোগ কমে যাওয়া দায়ী। এ ছাড়া অসচেতনতা, দারিদ্র্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রবণতা কমছে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার কমলে গর্ভপাত ও গর্ভপাতের কারণে মৃত্যু বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের অর্ধেকই পিল। বাকি অর্ধেকের মধ্যে আছে ইনজেকশন, কনডম, নারী ও পুরুষের বন্ধ্যাকরণ, ইমপ্লান্ট ইত্যাদি। কমিউনিটিগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর স্বল্পতাসহ কয়েকটি কারণে ব্যবহার না করায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে সন্তান প্রসবের হার যেমন বেড়েছে, তেমনই গলির দোকান থেকে গর্ভপাতের ওষুধ খাবার কারণেও রক্তক্ষরণ হয়ে অনেক প্রসূতি মারা যাচ্ছেন। আবার শুধু যে সন্তান প্রসবের সময়েই মায়েরা মারা গেছেন, তা নয়। আর্লি প্রেগন্যান্সিতেও নানান জটিলতার কারণে মায়েদের মৃত্যু বেড়েছে।
বিবিএসের সর্বশেষ ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমে দাঁড়ায় ৬২ দশমিক ১ শতাংশে। ২০১৫ সালের পর এই হার সর্বনিম্ন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি নেওয়ার হার ৬১ শতাংশ এবং সনাতন পদ্ধতি নেওয়ার হার ১ শতাংশের বেশি। শহরের তুলনায় গ্রামে পদ্ধতি ব্যবহারের
হার কম। এ হার শহরে প্রায় ৬৪ শতাংশ, গ্রামে প্রায় ৬২ শতাংশ।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতেও নারী না থাকায় ‘আনএক্সপেক্টেড প্রেগন্যান্সি’ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুন নাহার বলেন, পরিবার থেকে শুরু করে সর্বত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। পুরুষের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভধারণ করতে হয় অনেক নারীকে। আবার অনেককেই পুরুষের সিদ্ধান্তে ‘অনিরাপদ গর্ভপাত’ করাতে হয়। এতে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়।
এদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এখনও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে কমেনি। অথচ বাল্যবিয়ে ও কিশোরীর গর্ভধারণ (১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীর) মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান জন্ম দেওয়া নারীর মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সেহেরীন ফারহাদ সিদ্দিকা বলেন, দেশে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ রক্তক্ষরণ। কিন্তু অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে অনেক মা মারা যান। এ ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকলে এমনটা হতো না। নারীর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে সন্তান ধারণ করতে হতো না। জাতীয় পর্যায় থেকে পরিবার পর্যন্ত সর্বত্র
লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে হবে। তাহলে যে কোনো দুর্যোগ বা সংকটে নারী সুস্থ থাকবেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ত ম ত য র অন ব যবহ র র হ র কম পর ব র গ রহণ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মাঠ নিয়ে শ্রাবণের আফসোস
আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেও বসুন্ধরা কিংসের গোলরক্ষক মেহেদী হাসান শ্রাবণ নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফেডারেশন কাপের ফাইনালে আবাহনীর বিপক্ষে টাইব্রেকারে কিংসের জয়ের নায়ক ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। শুনেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়
সমকাল: দু’দিনের ফাইনালের অভিজ্ঞতাটা কেমন হলো?
শ্রাবণ: (হাসি) না, এটা খুব কঠিন ছিল। আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছি এক দিন ফাইনাল খেলব, জিতব এবং উদযাপন করব। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে খেলা অনেকক্ষণ বন্ধ ছিল। বাকি ১৫ মিনিট আরেক দিন। এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। একই চাপ দু’বার নিতে হলো।
সমকাল: এই মাঠের সমস্যার কারণেই কি এমনটা হয়েছে?
শ্রাবণ: অবশ্যই। এত বড় একটা টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা যে মাঠে, সেখানে ফ্লাডলাইট নেই। যদি ফ্লাডলাইটের সুবিধা থাকত, ওই দিনই খেলাটা শেষ করা যেত। আমার মনে হয়, দেশের ফুটবলের কিছু পরিবর্তন করা উচিত। বিশেষ করে আমরা যখন জাতীয় দলের হয়ে বিদেশে খেলতে যাই, তখন দেখি অন্যান্য দেশের মাঠ খুব গতিশীল। আমাদের দেশের মাঠগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের না। প্রায় সময়ই সমস্যা হয়। আমরা স্লো মাঠে খেলি। বিদেশে গতিশীল মাঠে খেলতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের লিগটা যদি আন্তর্জাতিক মানের মাঠে হতো।
সমকাল: পেনাল্টি শুটআউটের সময় কী পরিকল্পনা ছিল আপনার?
শ্রাবণ: আমি আগেও বলেছি যে অনুশীলনের সময় আগের ম্যাচের টাইব্রেকার নিয়ে কাজ করেছি। কে কোন দিকে মারে, সেগুলো ট্রেনিংয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কোচ। কোচের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি এবং সফল হয়েছি।
সমকাল: এমেকার শট ঠেকানোর পর মার্টিনেজের মতো উদযাপন করেছেন। এটি কি আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল?
শ্রাবণ: না, সেভ দেওয়ার পর মাথায় এলো। তাই এমি মার্টিনেজের মতো উদযাপন করেছি। বলতে পারেন, এটি কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তৎক্ষণাৎ মাথায় এলো।
সমকাল: জাতীয় দল আর ক্লাব– দুটোর অভিজ্ঞতা যদি একটু বলতেন।
শ্রাবণ: ক্লাব আর জাতীয় দল– দুটো ভিন্ন বিষয়। ক্লাব হচ্ছে শুধু একটা ক্লাবকে প্রতিনিধিত্ব করা। আর জাতীয় দল তো পুরো বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা। যারা ক্লাবে ভালো পারফরম্যান্স করে, তাদেরই জাতীয় দলে ডাকে। আর জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা একজন প্লেয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন।
সমকাল: আপনি একটি সেভ করেছেন। কিন্তু আবাহনীর মিতুল মারমা পারেননি। জাতীয় দলে বেস্ট ইলেভেনে থাকতে পারবেন?
শ্রাবণ: না না, ব্যাপারটা এমন না। ও (মিতুল) সেভ করতে পারেনি আর আমি পারছি– এটি কিন্তু বড় বিষয় না। ও কিন্তু সেমিফাইনালে সেভ করে দলকে ফাইনালে এনেছে। বরং অনুশীলনে কোচ যাঁকে ভালো মনে করেন, তাঁকেই শুরুর একাদশে রাখেন।
সমকাল: একজন গোলরক্ষক হিসেবে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
শ্রাবণ: আমি চাই দেশসেরা গোলরক্ষক হতে। আমার স্বপ্ন আছে, বিদেশে লিগে খেলব।