খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-কুয়েটে মঙ্গলবার ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে যেই ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়াছে, উহা উদ্বেগজনক। পূর্বের ন্যায় শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের মহড়া কেবল নিন্দনীয়ই নহে, একই সঙ্গে শিক্ষার পরিবেশের জন্যও মন্দ বার্তাবহ।
ইতোপূর্বে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যেইরূপ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করিয়াছিল, সেই কারণে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠনরূপে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হইয়াছে। গণঅভ্যুত্থানের ‘স্পিরিট’ হইল শিক্ষাঙ্গনে সকল ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সহাবস্থান বজায় থাকিবে এবং প্রত্যেকে স্বীয় কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনা করিতে পারিবে। কিন্তু বুধবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করিয়া কুয়েটে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটিয়াছে। আমরা মনে করি, শিক্ষাঙ্গনকে এই ধরনের সংঘাতমুক্ত করিতেই হইবে।
ইতোমধ্যে কুয়েটের ঘটনার প্রভাব দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়াছে, যেইখানে মঙ্গলবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরস্পরকে দায়ী করিয়া বিক্ষোভ করিয়াছেন ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী। সামাজিক মাধ্যমেও এই ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হইয়াছে। কুয়েটের সংঘর্ষে প্রকাশ্যে অস্ত্র বহনের ছবি যদ্রূপ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হইয়াছে, তদ্রূপ সমকালসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও আসিয়াছে। অস্ত্রের ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করিয়াছে। স্বস্তির বিষয়, অস্ত্র হস্তে থাকা ব্যক্তি যুবদল নেতারূপে চিহ্নিত এবং তাহাকে দল হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছে। তবে কুয়েটের সংঘাতে যেইভাবে বহিরাগতরাও যুক্ত হইয়াছে, উহাও বড় উদ্বেগের বিষয়।
মঙ্গলবারের সংঘাতের পর সেইখানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ও সংঘর্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাসহ পাঁচ দফা দাবি জানাইয়াছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দাবির মুখে অবশেষে বুধবার কুয়েটের সিন্ডিকেটের সভায় সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মঙ্গলবার ঘটনায় জড়িত বহিরাগতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের যেই সিদ্ধান্ত লইয়াছে, উহাকেও আমরা স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি, শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ফিরাইতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, তৎসহিত ছাত্র সংগঠনগুলিরও দায়িত্ব রহিয়াছে।
বিশেষত মঙ্গলবারের কুয়েটের ঘটনার পর ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে পরস্পরকে দোষারোপ করিয়া যেই ধরনের তৎপরতা দেখা গিয়াছে, উহাতে তিক্ততা বৃদ্ধি বৈ হ্রাস পাইবে না। বরং এই ঘটনা হইতে শিক্ষা লইয়া ছাত্র সংগঠনগুলির উচিত হইবে পরস্পর আস্থাশীল হইয়া শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখা। ইতোপূর্বে আমরা দেখিয়াছি, সংঘাতের ফলে শিক্ষাঙ্গনে জীবনহানি ঘটিয়াছে। এমনকি যেই প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়া থাকে, উহা দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কেও প্রশাসন বন্ধ করিয়া দিয়াছে। আমরা প্রত্যাশা করি, যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার পরিবেশ ফিরাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি খুলিয়া দিতে হইবে।
স্মরণে রাখিতে হইবে, শিক্ষাঙ্গনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পূর্বের ধারার ছাত্র রাজনীতি আর দেখিতে চায় না। লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির কারণে ইতোপূর্বে অধ্যয়নের পরিবেশ বিনষ্ট হইয়াছিল। আবাসিক হলগুলি পরিণত হইয়াছিল ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। গণকক্ষ, নির্যাতন কক্ষ তৈয়ারের কারণে হলগুলিতে ছাত্রদের প্রাণহানির অঘটনও ঘটিয়াছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে সেই সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসিয়াছে।
বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে যেই পরিবেশ বিরাজমান, উহা কোনোভাবেই বিনষ্ট করা চলিবে না। এই ক্ষেত্রে দেশের অন্যতম বৃহৎ সংগঠনরূপে ছাত্রদলকে দায়িত্বশীল হইতে হইবে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রশিবিরসহ সকলকেই অগ্রসর হইতে হইবে। সহাবস্থান ও প্রত্যেকের কার্যের স্বাধীনতা পরস্পরকে নিশ্চিত করিতে হইবে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলিও সেই বাস্তবতা মানিয়া লইবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ ত র স গঠনগ ল র ছ ত র র জন ত র পর ব শ স ঘর ষ কর য় ছ হইয় ছ ধরন র র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
রাকসু নির্বাচনে বামদের প্যানেলে নারী একজন, শক্তি ‘ধারাবাহিক লড়াই’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে বাম সংগঠনগুলোর একটা বড় অংশ এক ছাতার নিচে এসেছে। তারা যে প্যানেল দিয়েছে, তাতে জায়গা পেয়েছেন মূলত জোটে থাকা সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারাই। নারী আছেন মাত্র একজন। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুজনকে প্রার্থী করা হয়েছে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিতি তৈরি হওয়াকে এই প্যানেলের ‘বড় শক্তি’ বলে মনে করা হচ্ছে।
রাকসুর ২৩ পদের বিপরীতে ১৬টিতে প্রার্থী দিয়েছে বাম সংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। তাদের প্যানেলের নাম ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’। এই প্যানেলে আছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র গণমঞ্চ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র যুব আন্দোলন, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক–সংশ্লিষ্টতা নেই, এমন শিক্ষার্থী আছেন দুজন। তবে প্যানেলে থাকা দুজন সদস্য সরে দাঁড়িয়েছেন।
এই প্যানেল থেকে সহসভাপতি (ভিপি) পদে লড়বেন ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) কোষাধ্যক্ষ কাউছার আহম্মেদ এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রার্থী করা হয়েছে ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম সরকারকে।
বাম জোটের নেতারা বলছেন, ক্যাম্পাসে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে আসছেন তাঁরা। এর মাধ্যমেই তাঁরা শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত। শিক্ষার্থীদের ‘প্রধান কণ্ঠস্বর’ হিসেবে কাজ করেছেন, করছেন। তাঁদের দাবি, এটাই তাঁদের বড় শক্তি।
প্রার্থীদের প্রায় সবাই জোটের নেতাবামদের এই প্যানেলে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে লড়বেন বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের আহ্বায়ক তারেক আশরাফ। মহিলাবিষয়ক সহসম্পাদক পদে ছাত্র ফ্রন্টের শ্রেয়সী রায়, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর হাসান শাহরিয়ার খন্দকার আলিফ এবং তথ্য ও গবেষণা সহসম্পাদক পদে লড়বেন ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মো. সজীব আলী।
এ ছাড়া সহবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রিসার্চ চাকমা এবং সহপরিবেশ ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শামীন ত্রিপুরাকে প্রার্থী করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদে ছাত্র ফ্রন্টের সদস্য মুনতাসির তাসিন, পরিবেশ ও সমাজসেবা–বিষয়ক সম্পাদক পদে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আজমাইন আতিক ও নির্বাহী সদস্য পদে লড়বেন ছাত্র ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক আহমেদ ইমতিয়াজ।
এই প্যানেল থেকে জোটের বাইরে দুজনকে প্রার্থী করা হয়েছে। তাঁরা হলেন সহমিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক প্রার্থী ফাহিম মুনতাসির এবং নির্বাহী সদস্য পদে লড়বেন আসাদ সাদিক।
দাবি আদায়ের মাঠে থাকা ‘বড় শক্তি’শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে বাম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সব সময় মাঠে দেখা গেছে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও তাঁরা তৎপর থেকেছেন। সংখ্যায় কম থাকলেও আন্দোলনের জায়গায় পিছিয়ে ছিলেন না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন অপকর্ম ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও বাম নেতারা ছিলেন সোচ্চার।
শিক্ষার্থীদের আবাসন, খাদ্য, পরিবহনসংকট, ফি কমানো, নারীদের নিরাপত্তাসহ নানা ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছে বাম সংগঠনগুলো। জুলাই আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল তারা। এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ফুয়াদ রাতুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের একজন।
বাম নেতারা বলছেন, নব্বই–পরবর্তী বাম রাজনীতির ক্রান্তিকাল চলছে। এর পর থেকে আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়ে গেছে। সেই ছায়া পড়েছে প্রগতিশীল রাজনীতিতে। অন্য সংগঠনগুলোতে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাম রাজনীতি করলে সেই সুবিধা পাওয়া যায় না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে বাম সংগঠনগুলো যে সব সময় সক্রিয় থেকেছে, এটাকেই রাকসু নির্বাচনে একটা বড় শক্তি মনে করছেন তাঁরা।
বামদের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ও ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পক্ষে আন্দোলন করায় আমরা ক্যাম্পাসে পরিচিত। সে হিসেবে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে পরীক্ষিত। বিগত দিনে আমরা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের প্রধান কণ্ঠ ছিলাম। আমাদের তারা মূল্যায়ন করবে। আমাদের এই লড়াই–ই বড় শক্তি।’